আদালতের প্রতি মাহমুদুর রহমানের খোলা চিঠি

mahamudurসুরমা টাইমস ডেস্কঃ সম্পদের হিসেব দাখিল না করার মামলায় সোমবার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের আদেশের পর বিচারক ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ বাসুদেব রায় তাকে দোষী না নির্দোষ জিজ্ঞাসা করলে নির্দোষ দাবী করে তার নিজের লেখা ৫ পৃষ্ঠার চিঠি পড়তে শুরু করেন।
চিঠিতে সরকার বিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য থাকায় প্রথম পৃষ্ঠা পড়ার পর দুদকের আইনজীবীদের হৈ-চৈ করার কারণে তিনি আর তা পড়তে পারেননি। তার চিঠির বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

মাননীয় আদালত, আপনার প্রশ্নে জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অবশ্য চার্জ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে এ জাতীয় প্রশ্ন সম্ভবত: আইনী বাধ্যবাধকতারই অংশ। কিন্তু এটা শেখ হাসিনার সরকারের বাংলাদেশ। আমাকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে চার্জ গঠন হয়ে গেলেই বা এই ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে আমার মতো বন্দী, অসহায় আমজনতা কী করতে পারতাম। সর্ববিবেচনায় একটি অবৈধ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট লুটেরা সরকার ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের মাধ্যমে আপনার কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড় করিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তারই কার্যালয়ের নির্দেশে দুদক সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে দায়ের করেছে। শুরু থেকেই এই মামলা Illegant anddefective ab-initio.
ভোট ছাড়া সরকারের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মার্কিন মল্লুকে প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও এদেশের বোদ্ধা নাগরিকদের কাছে দুর্নীতির বরপুত্র রুপে কুখ্যাত জ্বালানী উপদেষ্টা ড তৌফিক-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক কোম্পানীর নিকট হতে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তদন্ত সংক্রান্ত সংবাদ ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আমারদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়। ক্রোধে ও উন্মত্ত প্রধানমন্ত্রী আমাকে শায়েস্তা করার জন্য তার কার্যালয় থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় আধা-সরকারী পত্র (ডি ও লেটার) প্রেরণ করেন। সেই ডি ও’র হুকুম মোতাবেক কথিত স্বাধীন দুদক তাদেরই আইন ভঙ্গ ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এই বানোয়াট মামলাটির কার্যক্রম আরম্ভ করে। এতেই প্রতিহিংসা পরায়ন প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিভিন্ন বানোয়াট অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকার দলীয়রা আমার বিরুদ্ধে এ যাবৎ অন্তত: ৭০টি মামলা করেছে। সিএমএম আদালতের বদন্যতায় রিমান্ডের নামে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে আমাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসী বাহিনী সরাসরি খুনের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে। এ সকল অপকর্মের কথা তারা গণমাধ্যম স্বীকারও করেছে। ২০১০-২০১১ সালে জেলে একনাগারে ১০ মাস কারাগারে ছিলাম। গত বছর এপ্রিল থেকে জেলে এক বছর পার হয়েছে। আটক অবস্থায় বন্দীর অধিকার নুন্যতম চিকিৎসাও পাচ্ছি না।
একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যতটুকু আইন জানি তাতে প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক কিংবা তার কার্যালয়ের ডিও লেটারের নির্দেশানুযায়ী দেশের কোন নাগরিকেরর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত, হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের সুযোগ দুদক আইনে নেই। আজকের মামলার ক্ষেত্রে কমিশন আইন লংঘন ছাড়াও জালিয়াতির মত ফৌজদারি অপরাধও সংগঠিত করেছে। অতএব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হওয়াই ছিল আইনের শাসন। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই।, আইনের শাসন নেই, এমন কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে কোন জন-প্রতিনিধিত্বশীল বৈধ সরকারও নেই।
আমার বিরুদ্ধে দুদক কোন দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। অভিযোগ এনেছে সম্পদের হিসেব না দেওয়ার। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি যে সম্পূর্ণ সততার সাথে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থে আপষহীনভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। সে ব্যাপারে দেশবাসী বিশেষভাবে অবহিত আছেন। আজকের অবৈধ সরকারের কর্তাব্যাক্তিদের মতো আইন ও বিধি বিধানের অপব্যাখ্যা করিনি। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ কর্মচারী, কেবিনেট সচিব আমার জ্বলানী উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে পেট্টবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন। তার রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে আমি কখনেই মাথা ঘামাইনি। তাকে কোনদিন আইনবহির্ভূত কিংবা রাষ্ট্র বা জনস্বার্থ ক্ষুন্নকারী নির্দেশ দেইনি। তিনি এখনো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা। আমার বক্তব্য মিথ্যা হলে তাকে খন্ডনের আহ্বান জানাচ্ছি।
খানিক আগেই উল্লেখ করেছি, দুদক আমার বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। সে সম্পর্কে এবার দু-চারটি কথা। এ বছর ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় এবং পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশে এক ভোটারবিহীন, তামাশার নির্বাচনী নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। স¤্রাজ্যবাদী ভারতের অনুগ্রহপুষ্ট ক্ষমতাসীনরাই আবারও সমনদ দখল করেছে। এই লজ্জাস্কর প্রতিক্রিয়ায় জনগণ ব্যতীত অন্য সবাই যার যার মত ভূমিকা পালন করেছে। জনগণ অবহিত আছেন যে, বিশেষ লুটেরা গোষ্ঠী রাষ্ট্র ও জনগণের কী অবিশ্বাস্য পরিমান সম্পদ লুন্ঠন করেছে। ব্যাংক, বীমা, বিদুৎ, গ্যাস খাত, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সেতু, জমি, নদী, খাল-বিল, খেলার মাঠ কোন কিছুই লুটেরাদের অপরিমেয় ক্ষুধার নিবৃত্ত করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা ফজলে নূর তাপস রাতা-রাতি ৪শ কোটি টাকা মুলধনের ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। মাত্র ক’বছরে তার সম্পদ মাত্র কয়েকশ গুণ বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অপর আত্মীয় নিক্সন চৌধুরী পদ্মসেতু গিলে খেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড: মহিউদ্দিন খান আলমগীর, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সাঙ্গ-পাঙ্গ, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা সব নতুন নতুন ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। যার এক একটির মূলধন ৪শ কোটি টাকা। ভারতের ¯েœহধন্য মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী গোপালগঞ্জের লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এবং প্রধানমন্ত্রীর ¯েœহভাজনরা বিদুৎ সেক্টর কব্জা করে ফেলেছেন। আওয়ামীপন্থি চিহিৃত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, পরিকল্পনামন্ত্রী মোস্তফা কামাল গং শেয়ার বাজার থেকে কমপক্ষে সাধারণ বিনিয়োগকারীরর লক্ষ কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। রতনে রতন চেনে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অফিসিয়াল স্পন্সর ভারতের সাহারা গ্রুপ সে দেশের শেয়ার মার্কেট লুটপাটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই সাহারাগ্রুপের বাংলাদেশী অংশিদার প্রধানমন্ত্রীর নিকট অত্মীয়ই। স¤্রাজ্যবাদী ভারতের সম্প্রদায়িক শাসকশ্রেণীর পদতলে শায়িত সরকারের রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ার দুদক কেবল আমার কাছেই নয়, বাংলাদেশের কোন নাগরিকের কাছেই হিসাব চাইবার নুন্যতম নৈতিক কিঃবা আইনগত অধিকার রাখে না।
মামলার কার্যক্রম সর্বশেষ যেহেতু আদালতে পরিচালিত হচ্ছে তাই সর্বশেষ আদালত সম্পর্কে সামান্য কিছু বলা প্রয়োজন। শেখ হাসিনার আজ্ঞাবাহী, রাজনৈতিদক পক্ষপাতদুষ্ট আদালতের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গী সুবিদিত। দীর্ঘ ১৩ মাস বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে জেলে বন্দি থাকলেও আদালতের প্রাতি আস্থা না থাকায় আজ পর্যন্ত আমি জামিনের আবেদন করি নাই। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে গলাটিপে মেরে ফ্যাসিবাদী, একদলীয় শাসন কয়েম ও মানবাধিকার অবলুপ্ত করে জুলুমবাজ পুলিশী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এক শ্রেণীর “মহা সম্মানিত” বিচারপতিরাই দায়ী। এই আদালতের স্বাধীনতার কোন অলীক কল্পনা নিয়েও আমি এখানে মামলা লড়তে আসি নাই। মামলা লড়ছি প্রধানমন্ত্রীসহ এই বানোয়াট মামলার সকল সংশ্লিষ্টদের মুখোস উন্মোচনের প্রয়াসে। মামলা লড়ছি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং দুদকের বিবেকবর্জিত ও অসৎ কর্মকর্তাদের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশে আইনের মুখোমুখি করবার প্রত্যাশায়। এবং এতোটুকু আশা নিয়ে মামলায় আংশ নেব যে, এক সময় জাতির বিবেক জাগ্রত হবে ও তারা জালিমকে প্রতিহত করতে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসবেন।
আমার বিরুদ্ধে দুদক উত্থাপিত অভিযোগ সবৈর্ব মিথ্যা, মামলার পুরো প্রক্রিয়া Illegant anddefective ab-initio এবং আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আদালতের কাছে চার্জ গঠনের পরিবর্তে মামলা খারিজের আবেদন জানাচ্ছি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতিতে সংযুক্ত থাকার অপরাধে সকল সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ প্রত্যাশা করছি। একজন বিশ্বাসী হিসেবে আশা করি, ইহকালে তো বটেই সেই সঙ্গে পরকালেও মহান আল্লাহতায়ালা এই জালিমদের হিসাব গ্রহণ করবেন। মাত্র কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রখ্যাত সংস্থার জরিপে বিশ্বের ৯৯টি রাষ্ট্রের মধ্যে ফৌজদারি মামলার বিচারের মান বিবেচনায় বাংলাদেশের বিচারের মান ৯৫তম স্থান লাভ করেছে। জাতি হিসেবে এ আমাদের পরম লজ্জার। মাননীয় আদালত আশা করি আমার বিরুদ্ধে দুদক দায়েরকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত, হয়রানিমূলক, বানোয়াট মামলায় ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এদেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে উজ্বল ভূমিকা রাখবে।
আমার মেরুদন্ডের অধিকাংশ হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কাধের হাড়ের একটি ছোট, অস্বাভাবিক বৃদ্ধির যন্ত্রনায় ক্রমেই কাতর হয়ে পড়ছি। দেখতেই পাচ্ছেন Elbow bag লাগিয়ে আদালতে হাজির হতে হয়েছে। আপনার নির্দেশে জেল কর্তৃপক্ষ পিজি হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হলেও সেখানকার ডাক্তার নামধারী দলবাজরা চিকিৎসা না করেই ফিরিয়ে দিয়েছে এই আশায় যে, আমার ডান হাত পঙ্গু হয়ে গেলে জালিমদের অপকর্ম এবং বাংলাদেশকে ভারতীয় উপনিবেশে রুপান্তর করার প্রতিবাদে আর কলম ধরতে পারবো না। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী দখলদাররাও ভিন্ন মতালম্বীর উপর এতোটা অত্যাচার- নির্যাতন চালায়নি। যার শিকার আমি হয়েছি। আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেও জালিম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করবো। স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তুলবো, বাংলাদেশেল ১৬ কোটি জনগণকে তার নিজস্ব সাংস্কৃতির বিপ্লবের দিকে আহ্বান জানাব। আপনার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই আমার অঙ্গীকার।