বিলুপ্তির পথে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা

17193ডেস্ক রিপোর্টঃ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের মাতৃভাষা সংযুক্ত না করায় মাতৃভাষার চর্চা এখনো অনেকটাই কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দিচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ মাতৃভাষায় পড়তে-লিখতে পারে না। এতে আদিবাসী গ্রামগুলোতে মাতৃভাষা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলায় খাসি (খাসিয়া), গারো, ত্রিপুরা, মণিপুরিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বাস করে। জেলার কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, জুড়ী, রাজনগর ও বড়লেখা উপজেলায় ৭৮টি খাসি পানপুঞ্জি (খাসি আদিবাসীদের গ্রাম) রয়েছে। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সাতটি গ্রাম রয়েছে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গলে মণিপুরি সম্প্রদায় এবং জেলার বিভিন্ন চা-বাগানে রয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বাস। প্রতি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা মাতৃভাষা। এরা নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু লেখাপড়ায় মাতৃভাষার চর্চা না থাকায় অনেকেই পড়তে-লিখতে পারে না। এ কারণে তাদের ভাষা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ভাষা হচ্ছে ‘কক্বরক’। এ ভাষাতেই তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। কিন্তু এই ভাষায় লেখাপড়া করার কোনো সুযোগ নেই।

জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ডলুছড়ার বাসিন্দা এবং ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনকদেব বর্মা বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি কোনোভাবেই কক্বরক ভাষায় লেখাপড়া শেখার সুযোগ নেই। আমাদের নিজেদেরও স্কুল পরিচালনার সামর্থ্য নেই। জেলায় আড়াই হাজারের মতো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ আছি। চর্চা না থাকায় কক্বরক ভাষাটি এখন হুমকির মুখে।’

মণিপুরিরা মূলধারার শিক্ষায় অনেকটা এগিয়ে আছে। তারা নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু তাদের মণিপুরি ভাষায় পড়ালেখার সুযোগ কম। তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়নে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (একডো) পরিচালনায় জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মঙ্গলপুর, ভানুবিল-মাঝেরগাঁও ও নয়াপত্তন গ্রামে তিনটি মণিপুরি ভাষা কেন্দ্র (ল্যাংগুয়েজ সেন্টার) আছে। এগুলোতে মূলধারার শিক্ষার পাশাপাশি মাতৃভাষা শেখানো হচ্ছে।

একডোর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, সরকারি কারিকুলামকে অনুসরণ করে মণিপুরি ভাষায় পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছে। মণিপুরি ভাষা শিক্ষার এ কার্যক্রমের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে সরকারিভাবে মণিপুরি ভাষাকে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা কারিতাস সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলায় আলোঘর প্রকল্প পরিচালিত ৫১টি স্কুল আছে। এর মধ্যে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে ২৫টিতে গারো ও খাসি ভাষা শেখানো হয়। ১০টিতে শেখানো হয় সাদ্রি ভাষা (ওঁরাও, মুন্ডা ও খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর ভাষা)।

আলোঘর প্রকল্পের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক পিউস নানোয়ার বলেন, ‘তিন বছর ধরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা শেখানো হচ্ছে। যেখানে একই সম্প্রদায়ের লোক বেশি, সেখানে সেই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁদের ভাষার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বছর থেকে সাদ্রি ভাষাও শেখানো হচ্ছে।

আদিবাসীদের নিয়ে কর্মরত ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেসের (আইপিডিএস) হিউম্যান রাইটস কর্মকর্তা জয়ন্ত লরেন্স রাকসাম বলেন, মাতৃভাষা না জানার কারণে এই ভাষার শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।

আন্তপুঞ্জি সংগঠন কুবরাজের সাধারণ সম্পাদক ও আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, ‘কিছু পুঞ্জিতে নিজেদের উদ্যোগে মাতৃভাষা শেখানো হচ্ছে। তবে মাতৃভাষা এখনো টিকে আছে মৌখিক ব্যবহারেই। সরকারিভাবে এখনো কিছু হচ্ছে না। বইপত্র পড়া বা সংরক্ষণের সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন যেখানে বেশি, সেখানে মূলধারার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের মাতৃভাষাও চালু করা দরকার। তা না হলে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষা করা কঠিন হবে।’