জমিনে খোদায়ী গজব – কখন ফরজ হয় !

Ronyগোলাম মাওলা রনিঃ বাংলাদেশে হয়তো অনেকবারই ‘খোদার গজব’ পড়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে হয়তো কয়েক লাখ বার। মানুষ কিন্তু অতশত জানে না। মানুষ জানে হাতেগোনা দু-একটি ঘটনা। উঠতে বসতে লোকজন সেসব কথা বলে আর প্রতিপক্ষকে ভয় দেখায়। নিকট অতীতে উল্লেখযোগ্য গজব হলো ঘসেটি বেগমের ওপর পতিত আল্লাহর গজব। এই বিশ্বাসঘাতক মহিলার ওপর গজব পড়েছিল ১৭৬০ সালে, ঢাকার কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। আগে পিছে অনেক কাহিনী আছে। তবে মূল কাহিনী হলো- তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার খালা। মীরজাফরের অন্যতম সঙ্গী হিসেবে তিনি বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য বিদেশীদের কাছে বিলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের প্রধান শাকচুন্নি হিসেবেই ইতিহাসে স্বীকৃত হয়ে আছেন। সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর সেরা বেঈমান মীরজাফর ও মীরন মনে করতে থাকেন, এই জঘন্য মহিলা না পারে এমন কোনো কাজ নেই। যে কিনা আপন দেশ, বাবার রাজত্ব ও বোনের ছেলের জীবন অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে, কেবল হিংসার বশবর্তী হয়ে সে পারবে না এহেন কর্ম নেই- কাজেই তাকে মেরে ফেলো। যে কথা সেই কাজ- প্রথমে গ্রেফতার করা হলো এবং অন্তরীণ রাখা হলো ঢাকার ওপারের জিঞ্জিরা দুর্গে। তারপর একদিন পরিকল্পনা করা হলো, তাকে নদীতে ডুবিয়ে মারা হবে। ঘটনার দিন বুড়িগঙ্গায় বজরা ভাসানো হলো। উদ্দেশ্য মাঝনদীতে বজরাসহ ডুবিয়ে মারা হবে ঘসেটি বেগমকে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে কেমন যেন নিষ্ঠুর হয়ে যায়। অদ্ভুত সব বেহিসেবী কাণ্ড করে বসে। হঠাৎ করে সেদিনও কিছু একটা হলো। ঘসেটি বেগমকে ডুবিয়ে মারতে হলো না। সময়টা ছিল বিকেল বেলা। শান্ত নদী। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমল। ঝড় ওঠার আগে সব কিছু ঠাণ্ডা-শীতল আর মনোরম হয়ে উঠল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ে বজরাসহ ঘসেটি বেগম ডুবে মারা গেলেন। জমিনে আল্লাহর গজবের দু’টি ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনা হলো হজরত মুসা আ:-এর জমানার ফেরাউনের পতন এবং তারও বহুকাল পরে সংঘটিত হজরত ইউনুস আ:-এর ঘটনা। এখানে একটি বলব। কিন্তু তার আগে বলে নিই কোন মানুষ গজব চায় এবং গজবে পতিত হয়। স্বভাবমতে, মানুষ সব সময় চায় নিজের হাতে বিচার করতে কিংবা শাস্তি দিতে। বিধি মোতাবেক যখন মানুষ এসব কর্ম করতে পারে না, তখন সে দুনিয়ার বৃহৎ শক্তির আশ্রয় নেয়। যদি সে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে থাকে তবে কাজীর দরবারে যায় বিচারপ্রার্থী হয়ে। কিংবা রাজার কাছে ধরনা ধরে ন্যায়বিচারের জন্য। সে ক্ষেত্রে ঘটনা যদি এমন হয় যে- ন্যায়বিচার তো দূরের কথা, উল্টো বিচারপ্রার্থীর ওপর জুলুম চালানো হয়, ন্যায়বিচার চাওয়ার অপরাধে। সে ক্ষেত্রে মজলুম ব্যক্তি খোদায়ী গজবের জন্য দোয়া করতে থাকে- যেন জুলুমকারীকে আল্লাহ তার ঐশীশক্তি দ্বারা ধ্বংস করে দেন। অন্য দিকে জুলুমকারী যখন অতিমাত্রায় অহঙ্কারী হয়ে ওঠে, তখনই সে নিজেকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে কল্পনা করতে থাকে। সে মনে করতে থাকে, তার বিচার করার সাধ্য কারো নেই- এমনকি আল্লাহরও নেই। মানসিক বিশ্বাস যখন এই পর্যায়ে পৌঁছে তখন তার খামখেয়ালিপনা, অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচার আর জুলুমের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অসহায় মানুষ তখন আসমানের মালিকের কাছে হাত তুলে জুলুমকারীর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানায়- হে আমাদের মালিক! তোমার এক নিকৃষ্ট সৃষ্টি তার জুলুম আর অত্যাচার দিয়ে জমিনের সব প্রাণীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। তোমার আইন ভেঙে সব রহমত আর বরকতের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ন্যায়বিচার ও সুশাসন ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। সবাইকে মজলুম বানিয়ে ফেলেছে। অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার, হাহাকার ও কান্নার রোল যেন তার নিত্যদিনের বিনোদনে পরিণত হয়েছে। মনে হয়, মজলুমের রক্তের লাল রঙ এবং রক্তের উষ্ণতার স্পর্শ না নিয়ে সে খাবার স্পর্শ করে না। হে আল্লাহ! আমাদের দুর্বল চিন্তা এবং অসহায় অবস্থা জুলুমকারীর জাগতিক শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। কাজেই আমরা তার মোকাবেলার জন্য তোমার মদদ চাই। নইলে গজব চাই। হে আল্লাহ! তুমি তোমার গজব দ্বারা অত্যাচারীকে ধ্বংস করে দাও। মজলুমদের করুণ আকুতি মিনতি শুনে জুলুমবাজেরা অহঙ্কারের অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং ঠাট্টা মশকরা শুরু করে। বলে, কই তোদের খোদা আর কোথায়ই বা সেই খোদার গজব! পারলে নিয়ে আয়! আমার যে বড্ড সাধ জেগেছে খোদায়ী গজব দেখার। এ মনোভাব প্রায় হুবহুভাবে সর্বকালের জুলুমবাজেরা পোষণ করে থাকে- যেমনটি বলেছিল ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস খ্রিষ্টজন্মের প্রায় সাড়ে ১২০০ বছর আগে। সময়টা ছিল হজরত মুসা আ:-এর ধর্ম প্রচারকালের সময়ে। আল্লাহর নবী হজরত মুসা আ: জন্ম নিয়েছিলেন ১৩৯১ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে আর মারা গিয়েছিলেন ১২৭১ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে। তিনি বেঁচে ছিলেন ১২০ বছর। হজরত মুসা আ: জীবনকালে মোট নয়জন ফেরাউন মিসর শাসন করেন। তৎকলীন দুনিয়ার সর্ববৃহৎ এবং শক্তিশালী রাজা ছিলেন ফেরাউনরা। সমগ্র মিসরসহ উত্তর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ নিয়ে ছিল তাদের বিশাল সাম্রাজ্য। হজরত মুসা যখন জন্ম নিলেন, তখন মিসর শাসন করতেন তৃতীয় আমেনহোতেপ। এত বড় মহান ও উঁচুমানের শাসক পৃথিবীতে খুব কমই পয়দা হয়েছে। উপকথা অনুযায়ী জন্মের পর শিশু মুসা আ: এই ফেরাউনের রাজপ্রাসাদেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতা লাভ করেন ১৩৯১ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে এবং মারা যান ১৩৫৩ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে। তৃতীয় আমেনহোতেপের পর ক্ষমতায় আসেন ফেরাউন সিমেন খায়ের এবং রাজত্ব করেন ১৩৫৩ থেকে ১৩৫২ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের জন্য। এরপর আসেন চতুর্থ আমেনহোতেপ বা ফেরাউন আখেনাতেন। তার রাজত্বকাল ১৩৫২ থেকে ১৩৩২ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ। এই ফেরাউনও অতিশয় বিখ্যাত ছিলেন এবং তার স্ত্রী ছিলেন আরো বিখ্যাত। সম্রাজ্ঞী নেফারতিতিকে চেনেন না এমন সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছেন। আখেনাতেনের মৃত্যুর পর তার বিখ্যাত বালকপুত্র তুতেনখামান সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল ১৩৩২ থেকে ১৩২৩ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ। এরপর আইয়ো রাজত্ব করেন ১৩২৩ থেকে ১৩১৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ। আইয়োর পর হেরেম হেব ১২৯২ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত এবং তারপর প্রথম রামেসিস রাজত্ব করেন ১২৯০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত। ফেরাউনদের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা প্রথম সেটি ক্ষমতায় আসেন ১২৯০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে এবং রাজত্ব করেন ১২৭৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত। এর পরই আসেন দ্বিতীয় রামেসিস, যার রাজত্বকাল ১২৭৯ থেকে ১২১৩ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় রামেসিসের সাথেই হজরত মুসা আ:-এর দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত বেধেছিল। আমি মিসর গিয়েছি এবং জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক দলিলপত্র দেখেছি। দ্বিতীয় রামেসিসের মমিও সংরক্ষণ করা আছে এবং সেটিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। মমির ওপর চালানো নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ডাক্তারি পরীক্ষাগুলোর বিস্তারিত ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেছি। অনেক কিছুই আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে এবং চেতনার জগৎকে এলোমেলো করে দিয়েছে। মিসরের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকালীন ফেরাউনদের মধ্যে দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন অন্যতম। শুধু কি তা-ই, রাজ্য জয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ও প্রজাপালনে তার অনন্য ভূমিকার জন্য মিসরবাসী আজো তাকে মহান রামেসিস বা রামেসিস দ্য গ্রেট বলে ডাকে। মিসরের সর্বকালের ইতিহাসে মিসরবাসী এখনো তাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশাহ বলে মনে করে। আর এখানেই আমার চিন্তাচেতনা ধাক্কা খায়, যখন নিজেকে প্রশ্ন করি- এত সফল, জনপ্রিয় ও বিখ্যাত একজন বাদশাহর প্রতি কেনই বা আল্লাহর গজব নাজিল হলো? আমার ুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাধানের সমীকরণ যতটুকু মেলাতে পেরেছি, তাই পেশ করলাম সম্মানিত পাঠকদের দরবারে। তৎকালীন মিসরের আদি বাসিন্দাদের বলা হতো কিবতি। অন্য দিকে হজরত ইউসুফ আ:-এর বংশধর যারা এসেছিলেন জেরুসালেম, হেবরন ও নাবলুস এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মিসরে, তাদের বলা হতো বনি ইসরাইল। কালের পরিক্রমায় বনি ইসরাইলরা সংখ্যায় প্রায় ১১ লাখ হয়ে যায় এবং রাজধানীতে বাস করতে থাকেন কিবতিদের দাসদাসী হিসেবে। তখন পর্যন্ত আল্লাহ বনি ইসরাইল জাতিকে ভালোবাসতেন এবং সাধারণ বনি ইসরাইলিদের ওপর কিবতিদের নিত্যদিনকার অত্যাচার-নির্যাতন থেকে তাদের উদ্ধার করতে চাইলেন। মহান আল্লাহ পাক হয়তো ফেরাউনের প্রতি নাখোশ হয়ে থাকতে পারেন তার একচোখা দলীয় বা গোত্রীয় নীতির কারণে। ফেরাউন সব কিছু করতেন নিজের জন্য, নিজের গোত্র বা দলের জন্য এবং সর্বোপরি মিসরবাসী কিবতিদের জন্য। অসহায় বনি ইসরাইল জাতির নিত্যদিনকার হাহাকার, অত্যাচার এবং যাতনার কথা তিনি কোনো দিনই শোনেননি। তার বিচার কখনোই ন্যায়ের পথে পরিচালিত হতো না, যদি ফরিয়াদি হতো বনি ইসরাইল জাতির মানুষ। পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, যখন আল্লাহ হজরত মুসা আ:-এর ওপর ওহি নাজিল করে তাকে হুকুম করলেন ফেরাউনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য, তখন তিনি বললেন- নিশ্চয়ই ফেরাউন জমিনের ওপর অহঙ্কারী হয়ে উঠেছে এবং বাড়াবাড়ি করছে। এখানে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, শাসক হিসেবে ফেরাউনের উচিত ছিল সব নাগরিকের সমান অধিকার দেয়া। তাদের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার সমবণ্টন নিশ্চিত করা। অথচ তিনি বনি ইসরাইলের প্রতি ছিলেন একেবারেই উদাসীন। অন্য দিকে বিভিন্ন কারণে তিনি দাম্ভিক ও অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিলেন। হতে পারে- একের পর এক বিজয়, প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন, উঁচু বংশ এবং রাজ্য শাসনে সফলতার কারণে তার নিজের মধ্যে অহমিকাবোধ পয়দা হয়ে গিয়েছিল। সমসাময়িক মিসর এবং আশপাশের রাজ্যগুলোর ওপর বিজয় লাভের পর তার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এক দিকে আরব সাগর, অন্য দিকে লোহিত সাগর, আরেক দিকে সীমাহীন সাহারা মরুভূমির বিশাল বালুকারাশি এবং ভূমধ্যসাগরের জলরাশির তীরবর্তী ভূমিখণ্ডের ওপর একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর রামেসিস হয়তো মনে করেছিলেন- এরপর আর কোনো কিছু নেই- পৃথিবী জয় হয়ে গেছে; হয়তো তিনিই পৃথিবীর অধীশ্বর। যেমন চিন্তা, কর্মও ঠিক তেমন। একসময় অহঙ্কার করে তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবি করে বসলেন। ফেরাউনের পতনের দ্বিতীয় কারণটি হলো, যখন আল্লাহর নবী তার কাছে সত্যের বাণী নিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন কেবল অহঙ্কার ও দাম্ভিকতা করে তিনি সব কিছু অস্বীকার করে ছিলেন। বললেন, খোদা বলে কিছু আছে নাকি! আমিও তো খোদা! আর আমাকে যেসব খোদায়ী গজবের ভয় দেখাচ্ছ, যদি পারো তবে তোমার খোদাকে বলে আমার জন্য গজব নিয়ে আসো। ফেরাউন যখন এসব কথা বলতেন তখন তার পাত্রমিত্ররা উচ্চ কলরবে তাকে সমর্থন জানাত এবং একইভাবে আল্লাহর নবী আঃকে ঠাট্টা-মশকারা করত। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা, আল্লাহ অনেকবার তার গজব পাঠালেন। প্রথমবার ছোট ছোট গজব। তারপর প্রলয়ঙ্করী গজব। ফেরাউন ধ্বংস হলো এবং নির্যাতিত বনি ইসরাইল সম্প্রদায় রক্ষা পেল। এবার আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি- পৃথিবীতে কখন খোদায়ী গজব ফরজ হয়। এতক্ষণ কেবল বলার চেষ্টা করেছি- মাঝে মধ্যে খোদার গজব নাজিল হয় এবং গজবের বিষয়টি বা অবশ্যম্ভাবী নিছক কল্পকাহিনী নয়- এটি মহান আল্লাহর একটি ইচ্ছা, যা তাঁর মজলুম বান্দাদের জন্য হয় অতি উত্তম ও শান্তিদায়ক উপহার এবং জুলুমবাজদের জন্য হয় মহা শাস্তি কিংবা পতনের উপলক্ষ বা কারণ। আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানসম্মান-ক্ষমতা দিয়ে একজনকে অন্যজনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। সমাজের বিবর্তন ও উন্নয়নের জন্যই এ ধরনের শ্রেণিবিন্যাস আল্লাহ করে থাকেন। এখানে বান্দার জন্য ফরজ বা অপরিহার্য হলো সর্বাবস্থায় আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতাকে স্বীকার করা এবং তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি সচেতন আনুগত্য প্রকাশ করা। অর্থাৎ যিনি দরিদ্র হলেন, তিনি যেমন নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে নিজের প্রতি জুলুম না করেন, ঠিক তেমনি তিনি ক্ষমতাবান ও অর্থবান হলেও যেন অহঙ্কার করে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না বসেন। তখনই আল্লাহর গজব অনিবার্য বা ফরজ হয়ে যায়, যখন আল্লাহর বান্দারা উঠতে বসতে নাফরমানি করে বসে। তারা সব সফলতার জন্য কেবল নিজেদের ধন্যবাদ দেয় এবং সব ব্যর্থতার জন্য নিয়তিকে দায়ী করে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় খোদার গজবের সব চেয়ে বড় নমুনা হলো, নিকৃষ্ট লোককে নেতৃত্বে বসিয়ে দেয়া। অর্থাৎ যখন দেখা যাবে বেশির ভাগ পরিবারপ্রধান, সমাজপতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারীরা মন্দ স্বভাবের অধিকারী, তখন বুঝতে হবে ওই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- এই গজবের আওতার মধ্যে থাকলে কী হয়। অনেক কিছুই হয়। এ ধরনের মানুষের মনে শান্তি থাকে না। তারা পৃথিবীর জন্য কিংবা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। অন্যান্য জাতি তাদের ঘৃণা করে। মর্যাদার প্রশ্নে তারা অন্যান্য জাতি কর্তৃক পোষ মানানো জন্তু জানোয়ারের চেয়েও কম মর্যাদা পেয়ে থাকে। গজবের আওতাধীন লোকজনের বড় বৈশিষ্ট্য হলো- তারা দিনরাত নিজেরা নিজেরা কলহ করে এবং ধীরে ধীরে নিজেদের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো ধ্বংস করে ফেলে এবং কুৎসিত এবং নোংরা জিনিসগুলোর বংশবিস্তার করতে থাকে। তারা অন্য জাতির পশুপাখির তুলনায় নিজের জাতির লোকজনকে নীচু জাতের বলে মনে করে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষজনের পরিণতি হয় বহুমুখী। আর শাসকদের পরিণতি হয় বলতে গেলে একমুখী। আল্লাহ তার পরম ধৈর্য ও ধীশক্তির কারণে প্রত্যেক নাফরমানকে একটি নির্দিষ্ট সময় দান করেন তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি তা না হয় তবেই জমিনে আল্লাহর গজব ফরজ হয়ে যায়। কখনো রোগ, কখনো শোক, আবার কখনো মহামারী। এর বাইরে ঝড়বৃষ্টি, বন্যা-বাদল, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, বজ্রপাত, সুনামি কিংবা অনাবৃষ্টি- অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে যুদ্ধ, নানা ধরনের সন্ত্রাস-অপরাধ জেল, জুলুম-হুলিয়া কিংবা আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাও। সৃষ্টিকর্তার গজব থেকে বাঁচার অন্যতম কয়েকটি উপায় হলো, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, যার যার অবস্থানে থেকে ন্যায়বিচার তথা ইনসাফ কায়েম করা এবং কোনো অবস্থাতেই অহঙ্কারী বা দাম্ভিক না হওয়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর গজব থেকে হেফাজত করুন- এই প্রার্থনা রাখছি তাঁর দরবারে যার একটি ‘কুন’ (হও) শব্দে মহাবিশ্বে প্রলয় হয়ে যায়।