মন্ত্রী-এমপিদের ভদ্রতার সুচক মাপার বিধান করা হউক
মীর আব্দুল আলীম: অসভ্য জাতি স্বাধীনতার আলোয় সভ্য হয় কিন্তু চার দশকে আমরা কোথায় এসে পৌঁছলাম। কোথায় চলেছি আমরা ? আলো থেকে অন্ধকারে! আজ কেন দেশের নীতিনির্ধারক মন্ত্রী এমপিরাও অশালীন, অভদ্র আচরণ, কু-বক্তব্য, মাস্তানী আর খিস্তি খিউড়ের উর্ধ্বে থাকতে পারছেন না? প্রকাশ্য মঞ্চে, জাতীয় সংসদ অভ্যন্তরে অশ্রাব্য ভাষার প্রয়োগ,গালাগালি, মারমুখী আচরণ আমাদের দেখতে ও শুনতে হচ্ছে। যাকে নিয়ে লেখা শুর” করছি তিনি একাধারে মুক্তিযোদ্ধা এবং সম্মানীত সংসদ সদস্য। সরকারের মাননীয় মন্ত্রী। এরই মধ্যে তিনি বেফাস বক্তব্য এবং আচরনে দেশবাসীর কাছে আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন। যিনি আইন প্রণয়ন করেন; জনগনকে আইন মানতে বাধ্য করেন আর তিনিই যদি আইন লঙ্ঘনের মহাযজ্ঞ চালান তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি!
৯ আগষ্ট ২০১৪ সাল। আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী বক্তব্য শুরু করেন। বক্তব্যের শুর” থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের ওপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত। মঞ্চে ওঠেই তিনি মাইক নিয়ে সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগের নির্দেশ দেন। বক্তৃতার সময় তিনি অকথ্য ভাষায় (আঞ্চলিক) ক্ষোভ ঝাড়েন। মন্ত্রী বক্তৃতায় সাংবাদিকদের আক্রমণ করে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করেন এবং গাল দেন। বিষয়বস্তু আদিবাসী নিয়ে হলেও প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তব্যে তিনি ঘুরে ফিরে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে নানা রকম অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ ও আক্রমণাত্মক কথা বলেন। মন্ত্রীর এ আপত্তিজনক আচরনে সরকারে সম্মান ক্ষুন্নœ করে। এর আগেও সংসদের ভেতরে আর বাইরে কতিপয় মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের ভয়ংকর চেহারা আমরা লক্ষ্য করছি । সেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্টের আক্রোশ বড় হবার কথা নয়, তাই হচ্ছে! পত্রিকার কল্যাণে জানতে পারি, সেদিন মান্যবর সমাজকল্যানমন্ত্রী নাকি বলছিলেন- ‘আমি বলি একটা, তারা লিখে আরেকটা। দুই টাকা খেয়ে তারা আমার পা.. (অকথ্য শব্দ) দিয়ে বাঁশ ঢুকাতে চায়। আমার শ্বশুর বাড়ি সিলেটে। সাংবাদিকদের পেছনে সিলেটের মানুষ লেলিয়ে দিতে আমার সময় লাগবে না। সাংবাদিকরা আমার বা.. (অকথ্য শব্দ) ছিঁড়তে পারবে না। সাংবাদিকদের ঠিক করতে নীতিমালা হয়েছে। ওই দিন কেবিনেট মিটিংয়ে আমি থাকলে সাংবাদিকদের.. (অকথ্য শব্দ) দিয়ে বাঁশ ঢুকাতাম। সাংবাদিকদের এখন এমনভাবে ঠিক করা হবে যাতে নিজের স্ত্রীকে পাশে নিয়েও শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। সাংবাদিকরা বদমাইশ, চরিত্রহীন, লম্পট।’ সরকারে থাকা ভদ্রলো সিলেটের সে মঞ্চে ছিলেন না তা কিন্তু নয়। শিষ্টাচার বর্হিভূত এমন বক্তব্যে তাঁরা বিব্রতও হয়েছেন। বক্তব্য চলাকালে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন উপস্থিত সাংবাদিকরা। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় মন্ত্রী যখন সাংবাদিকদের গালি দিচ্ছিলেন তখন অনুষ্ঠানের অতিথিরাও লজ্জায় মুখ লুকান। সাংবাদিকরাও নাছোড়বান্দা। এক পর্যায়ে সাংবাদিকেরাও তার ওপর চড়াও হলে মন্ত্রী বক্তৃতা বন্ধ করে নিরব থাকেন। এসময় অনুষ্ঠানস্থলে হট্টগোল শুর” হলে মহিলা এমপি কেয়া চৌধুরী ও সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরীও বিব্রতবোধ করেন। পরে তারা সাংবাদিকদের কাছে করোজোওের ক্ষমা চান এবং সাংবাদিকদেও চলে যেতে সহায়তা করেন। তার পরও মন্ত্রী শেষ অবদি তার কথার আক্রমন চালিয়ে যান।
মন্ত্রীর এমন কাণ্ডে হতবাক সিলেটবাসী। অনুষ্ঠানের মাইকে যেসব অশ্লীল গালি তিনি ব্যবহার করেছেন তা ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যা কিনা সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করে। এমন গুটি কয়েক মন্ত্রী এমপির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সাধারন জনগন, প্রশাসনের লোক, রাজনৈতিক দলেরর নেতাকর্মী এমন কি সাংবাদিক সমাজও। তবে এমন অশালীন অভদ্রভাবাপন্ন সবাই নন। এটা সত্য অনেক কাঠ খড়ি পুঁড়িয়ে তবেই একজন সংসদ সদস্য হতে পারেন। এদের অনেকেই আমজনতার স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট হলেও গুটি কয়েক মন্ত্রী, এমপির আপত্তিজনক আচরনে সাংসদদেও তথা রাষ্ট্রের সম্মান ক্ষুন্নœ হচ্ছে। গোটা কয়েক গুণধর মন্ত্রী এমপিই সংসদের ভেতরে আর বাইরে ভয়ংকর চেহারা প্রদর্শণ করে চলেছে। সেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্টির আক্রোশ বড় হবার কথা নয়, তাই হচ্ছে! সেদিন মন্ত্রী আরও দম্ভোক্তি করেন, ‘শেখ হাসিনা আমাকে ডেকে বলেছেন হাসানুল হক ইনু ১৪ দলের নেতা, আর তুমি আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা। সাংবাদিকরা যা ইচ্ছে লেখুক, তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি চালিয়ে যাও।’ এ কথায় তিনি (মন্ত্রী) কি বোঝাতে চেয়েছেন? তিনি বক্তৃতায় এও বলেন, তিনি যুদ্ধ করেছি, তাই সাংবাদিক বির”দ্ধে বলার সাহস আছে তাঁর। সাংবাদিকদেও কার কী চরিত্র তা নাকি তিনি জানেন। এমনকি ডিএসবি দিয়ে সাংবাদিকদেও চারিত্রিক ডাটা বের করতেও নাকি তাঁর সময় লাগবে না। এই হচ্ছে আমাদেও মন্ত্রী মহোদয়দেও আচরন!
২৭ জানুয়ারী ২০১৪। মনে আছে পাঠক সমাজকল্যাণমন্ত্রী সেদিন কি কান্ডই না ঘটালেন। স্পট সিলেটের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞ এই মন্ত্রী এক মহাকান্ড ঘটালেন। ঐ কলেজ চত্বরে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান চলছে। বেলা তিনটার দিকে প্রধান অতিথি সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী মন্ত্রী মঞ্চে ওঠেন। তাঁর পাশেই বসেছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি বিজিবি সিলেট সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. জামাল মাহমুদ সিদ্দিক। মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি র”হুল আনামসহ অন্যান্য অতিথিরাও মঞ্চে বসা। মঞ্চে যখন একের পর এক বক্তব্য চলছে, ধূমপান দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও প্রকাশ্যে সিগারেটে আগুন ধরান সরকারের ঐ মন্ত্রী। ধূমপান করছেন ভাবলেশহীনভাবে! চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসিমুখে আয়েশ করে টানতে থাকেন সিগারেট। সিগারেটের সুখ টানেই যেন মন্ত্রীর সকল সুখ। মঞ্চের সামনে হাজারো কোমলমতি শিক্ষার্থী। সঙ্গে তাদের অভিভাবক-শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মঞ্চভর্তি অতিথি। মন্ত্রীর এমন কান্ডে সবাই হতবাক হয়ে যান। এসময় তার পাশে বসে সবকিছুই সহ্য করছিলেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উর্দ্ধতনরাও। কিন্তু কারো সেই সাহস নেই ‘জনসম্মিলনস্থলে প্রকাশ্যে ধূমপান দন্ডনীয় অপরাধ’ আইনের এ বাণী মন্ত্রীর কানে পৌঁছে দেয়ার। মন্ত্রীরও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। রীতিমতো আয়েশ করে সিগারেট টেনে মস্তিষ্কভর্তি নিকোটিন নিয়ে তিনি যখন প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে উঠলেন তখন তার কণ্ঠে ঝরলো গাদা গাদা উপদেশ। এই কোমলমতি ছেলেমেয়েরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তারাই দেশকে এগিয়ে নিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে- এসব কথা উগড়ে দিলেন মন্ত্রী। কিন্তু বুঝলেন না তিনি যে আসনে বসে থেকে যে কান্ড করলেন তা যদি আদর্শ হয়ে যায় সেটা কতো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে দেশের ঘাড়ে চেপে বসবে।
মন্ত্রীর স্বভাব এমন, আর তিনি কিনা বললেন সাংবাদিকরা বদমাইশ, চরিত্রহীন, লম্পট, অল্প শিক্ষিত। সেদিন মঞ্চে মন্ত্রী এও বলেন- ‘আমার মেয়ে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স। আর যারা পত্রিকায় আমার বির”দ্ধে লেখালেখি করে তারা দু’এক কলম পড়ালেখা করেছে।’ মন্ত্রীর মুখে কি এ কথা মানায়? এাননীয় মন্ত্রী লেখালেখি এমন একটা বিষয় যে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স পাস করেও ভালো লিখবেন তা কিন্তু নয়। এ ক্ষেত্রে মেধা আর বিশেষ লেখনী শক্তির প্রয়োজন। মন্ত্রী এও হয়তো জানেন না যে, আমাদের সংবাদপত্রে গুলোতে ভুড়িভুড়ি সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করা জনবল রয়েছে। আমার জানা মতে কোন এক পত্রিকার উপজেলা পর্যায়ের এক সাংবাদিক আছেন যিনি কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় অনার্স এবং মাস্টাস সম্পন্ন করেছেন আরও দেড় যুগ আগে। মন্ত্রীর এসব বিষয় গুলো যেনে শুনে তবেই মন্তব্য করা প্রয়োজন ছিলো।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মন্ত্রী এমপিদের ভ্রদ্রতার সুচক মাপা হয়। কানাডয় আছে এ প্রথা। সেখনে ভদ্রতার সূচকে সরকারি দলের সাংসদদের গড়পরতা স্কোর হচ্ছে ৫৪ আর বিরোধী দলের সাংসদদের স্কোর ৪৩। সামগ্রিকভাবে কানাডীয়ান এমপিদের ভদ্রতার স্কোর হচ্ছে ৪৯। সেখানকার প্রধানমন্ত্রী এবং কুইবেকো নেতা জিলেট ডুসেপ অবশ্য গড়পরতা এমপিদের চেয়ে বেশি স্কোর করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্কোর হচ্ছে ৫০ আর কুইবেকো নেতার স্কোর ৫১। দলগত বিশ্লেষনে ভদ্রতার সূচকে এনডিপির স্কোর ৪১ আর লিবারেল পার্টির ৪২ । তবে ভদ্রতার সূচকে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার পিটার মিলিকেন। তার স্কোর হচ্ছে ৮০। এমপিদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র এমপি হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির রোনা এমব্রোস। আমাদেও দেশেও মন্ত্রী এমপিদেও ভদ্রতার সূচক মাপার বিধান করা যেতে পারে।
সমাজকল্যান মন্ত্রীর একের পর এক এমন আচরনে এদেশকে কোন সভ্য সমাজ বলার উপায় আছে কি? দেশের যারা নিতিনির্ধারক সংসদ সদস্য, সরকারের মন্ত্রী তারাই আজ ভদ্রতার প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। একজন মন্ত্রীর মুখে যা শোভা পায় না; মানায় না তাই তিনি একের পর এক নির্বিকার চিত্তে বলে এবং করে যাচ্ছেন। জানিনা কোন গন্তব্যে চলেছি আমরা। কবে আমরা সভ্য হবো, কবে দেশটাকে মানুষের বাসযোগ্য করতে পারবো। মাননীয় মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যগণ গালাগালি, খিস্তি খিউড়, ‘ সংসদে নিষিদ্ধ পল্লী’র আলোচনা বাদ দিয়ে জনগণের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজুক; জনগনের বন্ধু হউক। কারও কোলে উঠে নয়, জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি হয়ে সরকার গঠনের পথ উন্মুক্ত করা হোক, এটাই দেশের সকল নাগরিকদের প্রত্যাশা। আমরা আমাদের সম্মানীত মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের শুভবুদ্ধি উদয় হউক। সেই দিনের প্রত্যাশা আমাদের।
(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও সম্পাদক- নিউজ-বাংলাদেশ ডটকম। e-mail-[email protected])