যাহাই বন্ধ তাহাই খোলা !

internetযাদের স্বপ্নের বাস্তবিক রূপ আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ তারা এনালগে আটকে থাকলেও সাধারণ মানুষের অধিকাংশ ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার-অপব্যবহারে বেশ পাকাপোক্ত হয়েছে ! সম্প্রতি সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে দেশের বৃহৎ যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটস আ্যাপ, ভাইবারসহ আরও কয়েকটি ব্রাউজিং-চ্যাটিং-টকিং সাইট সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে । যার কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে কোটি মানুষ ! একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যানে আমরা দূর-বহুদূর অগ্রসর হয়েছি বটে কিন্তু নবপ্রজন্মের ক্ষতিও কম হচ্ছে না । যদিও এ দায় বিজ্ঞানের নয় বরং ব্যবহারকারীর তবুও এসব সাইটের ওপর সরকারের যতটা নজরদারীর দরকার ছিল ততোটা গুরুত্ব পায়নি । তাই আবেগের বয়সের প্রজন্ম ইন্টারনেট থেকে শিক্ষার চেয়ে ধ্বংস উপকরণ পাচ্ছে বেশি । ফলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রেও পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব । ধর্ষণ থেকে খুন, চুরি থেকে ডাকাতি, প্রবঞ্চনা থেকে ভন্ডামীসহ আরও অনেক ধরণের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে । আমরা দেশের নিরাপত্তা চাই; তাতে যদি সাময়িক বন্ধ সাইটগুলো চিরতরে বন্ধ করতে হয় তার বিনিময়েও । তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রশ্ন জেগেছে দু’টো । প্রথমতঃ আসলেই কি পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যগুলি ? দ্বিতীয়তঃ ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সকলেই কি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ?

আধুনিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ইন্টারনেট । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সকল ব্রাউজিং ডিভাইস চালিত হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে । দেশের ইন্টারনেটের সমগ্র ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ । বিআরটিএ যেহেতু ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াট আ্যাপপ বন্ধ ঘোষণা করেছে কাজেই এ মাধ্যম দেশের অভ্যন্তরের কেউ ব্যবহার করতে না পারাটাই স্বাভাবিক ছিল । কিন্তু সে স্বাভাবিকতাকে অস্বাভাবিকতা ঢেকে রেখেছে । অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী দিব্যি ফেসবুক চালাচ্ছে । অনলাইন আ্যাপস বাজারে এমন অসংখ্য ব্রাউজার রয়েছে যা দিয়ে বন্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও দেশের অভ্যন্তরে বসে ফেসবুকসহ অন্যান্য সমাজিক যোগাযোগ সাইটগুলি ব্রাউজ করলেও বিআরটিএ তার আওতায় সেগুলোকে পাচ্ছে না । আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সাময়িক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও তার যথাযথ সূফল পাওয়া সম্ভব হবে না কেননা যারা বিজ্ঞানকে অপব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত করছে তারা সকল পথের চোরা গলিগুলো খুব ভালো করেই চেনে-জানে । যে ব্রাউজিং সাইটগুলো বন্ধ কিংবা খোলা রাখার ক্ষমতা বিআরটিএ’র নাই সেগুলোর মাধ্যমেই বোধহয় অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেশি হচ্ছে । অপরাধী যখন সরল পথের পথিককে ধোঁকা দিতে পারে ঠিক তখনই অপরাধকর্ম সাধন করে বলে বিশ্বাস । নয়ত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এত তৎপর থাকা সত্ত্বেও অপরাধী অপরাধ করার সুযোগ পাওয়ার কথা নয় ।

দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ছুঁই ছুঁই । যারা ফেসবুক ব্যবহার করে তাদের মধ্য থেকেই কিছু অংশ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে । ফেসবুক ব্যবহার করে না অথচ ভাইভার, হোয়াটস আ্যাপ, ইমো, ট্যাঙ্গু, লাইনসহ অন্যান্য চ্যাটিং-টকিং সাইট ব্যবহার করে এদের সংখ্যা নগন্যই হবে । রাষ্ট্র নিরাপত্তার অজুহাতে সকলকে আধুনিক পদ্ধতির সস্তা মাধ্যমের যোগাযোগ থেকে সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । আমরা রাষ্ট্রের স্বার্থে দুই-পাঁচ দিন নয় বরং সারাজীবন এসব যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার না করে থাকতে পারি । কেননা যারা দেশকে ভালোবাসে তারা বোধ হয়েছে অবধি দেশের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । সেই বাল্য বয়সে স্কুলের আঙিনায় যেদিন প্রথম শপথ নিয়েছিলাম, ‘দেশের স্বার্থে আমার জীবন সর্বদ প্রস্তুত রাখব’-সেদিন থেকেই মনের মধ্যে দেশ প্রেমের যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল সে চারা আজ শাখা-প্রশাখাসমৃদ্ধ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে । রাষ্ট্রে ভালো মানুষের তুলনায় অপরাধীর সংখ্যা এত নগন্য যে, ভালো মানুষগুলো যদি একত্রিত হয়ে মন্দ মানুষগুলোর দিকে ফুঁ দেয় তবে সেগুলো ঝড়ের কবলে খড়কুটো যেমন উড়ে যায় তেমনি নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে । নিরাপত্তার অজুহাতে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যখন ভাবি খারাপ মানুষগুলোর জন্য ভালো মানুষগুলোকেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হচ্ছে তখন কিছুটা খারাপ লাগে । ভাবনা জাগে, খারাপ মানুষের জন্য ভালো মানুষগুলোও বন্দি হয়ে গেল ? তবুও সরকারের সিদ্ধান্তে যদি অপরাধীরা ধৃত হয় এবং দেশ স্থিতিশীল হয় তবে আমাদের চেয়ে বেশি খুশি আর কে হবে ? রাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করতে আমরা দ্বিতীয়বার ভাববো না । তবে সকল মানুষকে যেন অপরাধীর সাথে একাকার করে ফেলা না হয় ।

ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ সাময়িক বন্ধ করে অপরাধীদের ধৃত করতে কিংবা অপরাধ কর্ম কমানো যতটা সহজ হবে তার চেয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও তাদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করে অপরাধ ও অপরাধীমুক্ত একটি বাংলাদেশ বিনির্মান আরও অধিকতর সহজ । সরকার স্থায়ীভাবে ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখবে বলে মনে হয়না । যারা প্রকৃত অপরাধী তারা শুধু সাময়িক সময়ের অপরাধী নয় বরং স্থায়ী অপরাধী । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ রেখে সাময়িক অপরাধ কিছুটা কমানো সম্ভব কিন্তু তাতে স্থায়ী কোন উপকার হবে কিনা সেটা রাষ্ট্রের পূনঃবিবেচনায় আনা উচিত । অপরাধ কমানোর পদ্ধতি হিসেবে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারায় যদি ব্যাঘাত ঘটে তাতে মানুষের ক্ষোভ ও দ্রোহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল হয় । অপরাধীকে ধৃত করতে হবে সাধারণ মানুষের সহযোগীতায় । কেননা সমাজের কোন স্তরে কোন অপরাধী লুকিয়ে তা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কেউ জানে না । সাধারণ মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অপরাধ দমন করতে হবে । এজন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সু্ষ্ঠু বিচারিক পরিবেশ সৃষ্টি ও জনমতকে অনুকূলে রাখতে হবে । দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে অপরাধ কমানো আদৌ সম্ভব কিনা সেটাও ভাবনায় রাখা আবশ্যক ।  রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিভেদ দূর হলে অপরাধের সংখ্যা কমে যাবে বলে বিশ্বাস । ঐক্যমত্যের বাংলাদেশ গঠনে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহন আবশ্যক সেগুলো সঠিকভাবে গৃহীত হলেই দেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে । সরকার-রিরো্ধীদল-রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের মেলবন্ধনে তেমন একটি রাষ্ট্র হোক আমাদের বাংলাদেশ ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

facebook.com/rajucolumnist/