উন্নয়নের বুলি বনাম ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ : মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

abdulkahharগত ২৩ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবের শেষ পাতায় পাশাপাশি দুটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। যার একটির শিরোনাম ছিল ‘দেশে চার জনে একজন ক্ষুধার্ত’ এবং অন্যটি ‘২০৩০ সালের মধ্যে দেশ ক্ষুধামুক্ত হবে’। সংবাদ দুটির একটি ইতিবাচক অন্যটি নেতিবাচক। কৃষি অর্থনীতি সমিতির ১৫তম জাতীয় সম্মেলন ও সেমিনারে দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে ‘দেশে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মানুষ ক্ষুধার্ত’। গত ১০ বছরে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের অবস্থা সূচক ৩ দশমিক ৭-এ নেমেছে বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। মানুষকে পুষ্টি ও মানসম্মত খাদ্য দেয়া যাচ্ছেনা বলে শিকার করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি আরো বলেন, বিশ্বে প্রতি ৯ জনের একজন অভূক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। সম্প্রতি সময়ে এদেশের প্রেক্ষাপটে এসব বিশ্বাস করতে অনেকেরই কষ্ট হবে। সরকার যখন সব বিষয়ে সফলতার দাবি করে ঠিক সে সময়ে এমন নেতিবাচক সংবাদ ততটা ভাল লাগার কথা নয়। তবুও ধন্যবাদ এজন্য যে, ১৯৯০ সালে দেশের প্রতি দুইজনে একজন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। সেই হিসেবে বর্তমান অবস্থা ভাল বলা যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ ক্ষুধামুক্ত হবে এটি শুনতে ও ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু কতটা বাস্তবায়ন হবে সেটিই বিবেচ্য বিষয়। পরিকল্পনা মন্ত্রীর দাবি দেশ এখনও পুরোপুরি ক্ষুধামুক্ত হয়নি। আমরা পুষ্টি ও মানসম্মত খাবার দিতে পারিনি। খুব সহজ ভাবেই তিনি অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। খুব কম সংখ্যক মন্ত্রী আছেন যারা তাদের দুর্বলতা শিকার করেন।
গত বছরের ১২ মে বণিক বার্তার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশে ১৭% মানুষ ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার। ফলে দুর্বল শিশু জন্ম হচ্ছে। আবার সুশাসনের অভাবে অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন ২০ শতাংশ মানুষ। ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সচেষ্ট ভুমিকা না নেয়া হলে সব কিছুই স্বপ্ন থেকে যাবে। ২০১৪ সালে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিইএফপি) এবং আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল-‘বিশ্বের ৮০ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ঠিকমতো খেতে পায়না’। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমতে থাকলেও এখনো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রতি নয়জনের একজন ঠিকমতো খেতে পায়না। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অপুষ্টির বিষয়ে তথ্যে উঠে এসেছে, ১৯৯০-৯২ সালে দেশের তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছিল, যা তখনকার জনসংখ্যার ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১২-১৪ সালে অপুষ্টিতে ভোগ্য মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখে যা এখনকার জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এশিয়ায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ ভাল অবস্থানে থাকলেও বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১৬ ধাপ পিছিয়েছে। অপুষ্টি, শিশুর অধঃপতন, শিশুকে বাড়তে না দেয়া এবং শিশু মৃত্যুহার-এই চারটি মূল নির্দেশক ব্যবহার করে ১০০টি পয়েন্টে সূচক নির্ধারণ করে জরিপের ফলাফলে ১১৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৩ তম। গত বছর এই সূচক ছিল ৫৭ নম্বরের দেশ। অপুষ্টি ও বেকার সমস্যা সমাধান করা ও দুর্নীতি বন্ধ করা সরকারের জন্য অগ্নি পরীক্ষা। শিশু ও নারীরা উচ্চমাত্রার অপুষ্টির শিকার। ব্রিটেনের সাময়িকি দি ইকোনমিস্টের তৈরী দ্য গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০১৫-এ বলা হয়েছে প্রধান খাদ্য চালে বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলেও খাদ্যে পুষ্টির অভাব ও নিরাপদ খাদ্য স্বল্পতা হতাশাজনক। বিশ্বের ১০৯ টি দেশের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯ তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় এ অবস্থান সর্বনি¤œ এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২টি দেশের মধ্যে ২১তম (যায়যায়দিন, ১৩ নভেম্বর, ‘১৫)। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০১৫ তেও বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থানের এটি একটি বড় কারণ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌছতে হলে দারিদ্র্যের হার কমানো নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে উন্নত রাষ্ট্রের জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা পরিপূর্ণ অনুসরণ করা হলে হয়তো ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ধনী দেশের তালিকায় স্থান পেতে পারে। তবে দশ হাজার টাকা ঘুষ দিলে এর বিনিময়ে সে ১০ লাখ টাকার কর ফাঁকি দিতে যারা জানে সে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি খুব সহজে মিলবে তার আশা করা যায় না।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বাড়লেও আয়বৈষম্যের কারণে ক্রয়ক্ষমতার অভাবে এখনো অসংখ্য মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের শিকার। ৪০ বছর আগে কৃষি উৎপাদন ছিল ১১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এখন মোট কৃষিজ উৎপাদন ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জনসংখ্যার আধিক্য নিয়ে কিছুটা হলেও এগিয়েছে। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে দক্ষিণ ‘দেশে চার কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এদের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ চরম দরিদ্র। এরা অসহায় ও দুস্থ’। নি¤œ আয়ের মধ্যে আটকে আছে দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ বা ১২ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ। যাদের ক্রয় ক্ষমতা দৈনিক ২০০ টাকার নিচে (বণিক বার্তা, ১৭ অক্টোবর,‘১৫)। তাছাড়া বেকারের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। দেশে প্রতিদিন ৫ হাজার ২৪৭ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে। সেই হিসেবে প্রতি বছর ১৯ লক্ষের বেশি লোক জনসংখ্যার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। যা মোট শ্রম শক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ। আর বিশ্ব ব্যাংক মনে করে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শত্ংাশ। এর ওপর প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। এতে করে কর্মসংস্থানের তৈরীর চাপ বাড়ছে।
দেশে যখন নতুন করে পর্যাপ্ত কর্মস্থানের ব্যবস্থা না করা হলে ‘হিডেন হাঙ্গার’ আবারও ধেয়ে আসতে পারে। তাই এসব বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু সফলতার স্বপ্ন দেখা বেমানান। ক্ষুধার্ত মানুষ নেই এমন একটি স্থান খুজে পাওয়া যাবেনা। মানুষের যাত্রা পথে, সড়ক ও মহাসড়কের বাস টার্মিনাল, সড়ক, নৌ ও রেলপথে চলাচলকারী বাহনসহ রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, শহর ও নগরের ট্রাফিক সিগনালে, পার্ক, মসজিদ, অফিস, আদালতের গেটে অভাবী মানুষের দেখা মেলে চোখে পড়ার মতো। এছাড়া ভাসমান মানুষদের পূর্ণবাসন করা ও তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।