দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি অবহেলা, অনাগ্রহ, অনাদর কোন ভাবেই মেনে নয়ো যায় না

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ২০০৯ সালের ১৩ জুন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকেও বিজ্ঞানীদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর আগে ১৯৯৭ সালের ১০ আগস্ট জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিষদের সভায় বিজ্ঞানীদের আলাদা বেতনকাঠামো প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়। এজন্য তৎকালীন সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি কমিটিও সুপারিশ করেছিল, কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজ্ঞানীদের বিশেষ প্রণোদনা দিলে জাতি হিসেবে আমরা তার সুফল দীর্ঘ মেয়াদে পাবো। তাই এক্ষেত্রে সরকারের বাড়তি খরচ হলেও তা দেয়া উচিত।
বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক) ২০০৯ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। এতে বলা হয়, সাধারণত একজন বিজ্ঞানীর ৫০ বছর পার হওয়ার পর তার পরিপক্বতা আসে। কিন্তু ওই উচ্চতর স্তরে পৌঁছানোর কয়েক বছরের মাথায় তাকে অবসরে যেতে হয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য উন্নত দেশে বিজ্ঞানীদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো ও সুবিধা দেয়া হয়।
সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা আটকে থাকায় প্রতিবছর দেশের অনেক বৈজ্ঞানিকই নিজ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। এছাড়া যোগ দিচ্ছে বেসরকারি চাকরিতে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের হিসাবে গত এক যুগে ৪০০ কৃষিবিজ্ঞানী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। শুধু বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ২০০ জন বিজ্ঞানী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে চাকরি ছেড়ে বেসরকারি সংস্থায় যোগ দিয়েছে। আর গত দুই বছরে ৩০ জন বিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলাকালীন অবস্থায় অবসরে গেছে।
সরকারের অন্য সংস্থাগুলোর হিসাব যুক্ত করলে এমন বিজ্ঞানীর সংখ্যা কয়েকগুণ হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছে। তারা বলছে, পাশের দেশ ভারত, নেপালসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে বিজ্ঞানীদের কাজের সুযোগ করে দিতে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো ও অন্যান্য সুবিধা দেয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যতিক্রম হিসেবেই রয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদানে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যাদের মেধার ফসলে ভরে উঠছে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত এলাকার শূন্য গোলা, যাদের উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু ধান প্রাণ জাগিয়েছে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ লোনাভূমিতে; সেই কৃষিবিজ্ঞানীরা আজ হতাশ। পেশাজীবনে নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে তাদের অনেকে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। কেউবা চাকরি ছেড়ে যোগ দিচ্ছে অন্য পেশায়। আর যারা সে রকম পারছে না, তারা ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। এভাবে দেশ ও জাতি হারাচ্ছে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তৈরি করা সব সোনালি সম্ভাবনা।
জানা গেছে, প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বিজ্ঞানী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষিবিজ্ঞানীরা চাকরি ছাড়ার কারণে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগটি কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। যারা চাকরি ছেড়ে চলে গেছে, তাদের বিকল্প তৈরি হয়নি। গত মাসেও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়েছে তিন বিজ্ঞানী। ২০ বছর চাকরি করার পর তারা মাত্র একটি পদোন্নতি পেয়েছে। চাকরির বয়সসীমা ৬০ বছর হওয়ায় তারা ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। বিচারকের অবসরের বয়সসীমা ৬৭ বছর। সেখানে কেন কৃষিবিজ্ঞানীদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ হবে? কৃষিবিজ্ঞানীদের অবসরের বয়সসীমাও ৬৫ করা দরকার, যুক্তি দেখিয়ে তারা বলেছে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই কোনো কারণে তাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো সম্ভব যদি নাও হয়, তবুও ফসলের কোনো নতুন জাত, প্রযুক্তি, পদ্ধতি উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাকরিতে রাখা দরকার। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে অথবা সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করে মেধাবী বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে সেবা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। আরো দুঃখজনক বিষয় হলো- যে বয়সে নিবিড় গবেষণা করে দেশের সেবা করা যায়, সেই বয়সে কৃষিবিজ্ঞানীরা অবসরে চলে যায়। এতে দেশই বঞ্চিত হয়। কারণ একজন কৃষিবিজ্ঞানী গড়ে তুলতে রাষ্ট্রকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। আর এসব কৃষিবিজ্ঞানী সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও বসে থাকে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে যোগ্যতার প্রমাণ ঠিকই রাখছে।
এদিকে কৃষিমন্ত্রী এ ব্যাপারে জানিয়েছে, ‘বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা দেয়ার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। শুধু কৃষিবিজ্ঞানীরা নয়, অন্য বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরাও যাতে ওই বিশেষ প্রণোদনা পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। বলাবাহুল্য, এরূপ পরিকল্পনার কথা আমরা গত দুই দশক ধরে শুনে আসছি। কিন্তু সরকারের গরু শুধু কিতাবেই থাকে গোয়ালে আর থাকে না। আসলে গণতন্ত্রের খোলসধারী ও তল্পিবাহক কোনো সরকারই দেশের উন্নতি চায় না। গণতন্ত্রীরা চায় শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে। দেশের সমৃদ্ধি চাপা দিয়ে রাখতে। দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি অবহেলা, অনাগ্রহ, অনাদর, তারই প্রমাণ। অথচ অন্যান্য দেশের সরকাররা বিজ্ঞানীদের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা তো করেই, এমনকি ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ব্যাপক সাহায্য করে থাকে। এবং বিজ্ঞানীদের নব-আবিষ্কারের প্যাটেন্ট কিনে একচেটিয়া মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু আমাদের দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা তা করার বিপরীতে নোংরা রাজনীতিতে অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বিনিয়োগ করে সেখান থেকে নব-আবিষ্কারের মাধ্যমে হালালভাবে অঢেল অর্থ উপার্জনের মানসিকতা তাদের নেই। অর্থাৎ সরকার ও ব্যবসায়ী উভয়েই প্রজ্ঞাহীন, দেশপ্রেমহীন, জাতিপ্রেমহীন।