দেখে শুনে বিষ করছি পান

আব্দুল আজিজ তকি

বহু আগের কথা, ইংরেজরা তখন ভারতভুমের হর্তা,কর্তা এবং বিধাতা। শুনেছি সেই সময় একজন ইংরেজ লেখক ও চিন্তাবিদ উইলিয়াম আচার্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল বিচরণ করে লিখেছিলেন ‘ ভারতবাসীরা অসভ্য জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে সভ্য আর সভ্য জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে অসভ্য।’ কথাটা শুনলে ভারতবাসীদের গাত্রদাহ হওয়াটা স্বাভাবিক। এমন বেইজ্জতি কথা কে সহ্য করতে পারে বলুনতো! জাত তুলে গালি দিবে আর মুখবুজে সহ্য করবো তা’কি কখনো হয়! কথা হল, যে লোকটি এমন একটা ধৃষ্ঠতাপূর্ণ মšতব্য করলেন তিনিতো আর আপনার আমার মত সাধারন লোক নন;একজন নামকরা চিন্তাবিদ এবং লেখক। এমন একটা একতরফা মন্তব্য নিশ্চয় ভাল লাগার নয়। আমি মনে করিনা ভারতজনদের প্রতি কোন কারনে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর থাকলেইবা কি হল; এমন ঢালাও করে সারা ভারতবাসীর গায়ে এমন একটা তহমত লাগাতে তাঁর মত মানুষ কেন কুন্ঠিত হলেন না? কোন ভারতবাসী সেই সময় এমন একটা মন্তব্যশুনে মুখ খুলছিলেন কিনা জানিনা। আমার মনে হয় এই লেখক যে মন্তব্য করেছেন তা’ খুব একটা অসত্য কিছু নয়। তার যায়গায় আমি হলে এই মন্তব্য আরো কুৎসিত হতে পারতো তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। উইলিয়াম তাঁর চিন্তার চোখ দিয়ে আমাদের বাহির দেখেছেন, ভিতরটা দেখতে পারেন নাই। এই অঞ্চলের একজন নাগরিক বলেই আমি ্একথা বলছি। কারন জাতিয় চিন্তা-চেতনার অন্দর-বাহির দেখার সুযোগ আমার আছে, ছিল এবং সারাজীবন থাকবে।

বিস্তর বাঙালি ছেলেমেয়েরা ব্যারিস্টার হয়েছেন অথবা হচ্ছেন। অনেককে লন্ডনের ‘হোয়াইট-চ্যাপেলে’ গতরে-গতর লাগিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখি। নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে, বুক উঁচু করে গর্ব ভরে জবাব দেন- ‘আমি ব্যারিস্টার’ অথবা ‘ব্যারিস্টারি পড়ছি’।- গর্বে আর গৌরবে তখন নিজের বুকটাও বেলুনের মত ফুলে উঠে। আশান্মিত হয়ে আশীর্বাদ করি। স্বগর্বে বলি- এখন ‘বাঙালকে আর হাইকোর্ট দেখাতে হবেনা’। -এবার হাই কোর্টই বাঙালীদের খোঁজে নেবে। এমন কি আর দশ-পাঁচজনকে এ’সকল ছেলেফেলেরাই হাইকোর্ট দেখাবে। গণহারে না হলেও অন্ততঃ কিছু সংখ্যক পড়–য়া দেশের ও দশের উপকারে লাগবে। বিলেতি ডিগ্রী নিয়ে ভাল মন্দটা বাচবিচার করার মত ক্ষমতা পেটে ধারন করবে। তা’দের এই অর্জনই হবে ভবিষ্যৎ বংশধরদের পাথেয়। জাতির গায়ে ছড়িয়েছিটেয়ে থাকা পাপ পঙ্কিলতাকে দুরে ঠেলে এই বঙ্গসন্তানরা বাড়াবে বাঙালির মান মর্যাদা। নামেই ব্যারিস্টার না হয়ে কামেও ‘বার এর ইষ্টার’ হবার যোগ্যতা দিয়ে আমাদের মুখ উজ্জল করবে।
বিধি যে এমন একটা আশার প্রতি বাম তা’ বেশ লক্ষণীয়। আসুন এবার বাংলাদেশের হাই কোর্টের কথাই বলি। । ্একটা গান নিশ্চয় শুনেছেন ‘হাই কোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে আসল ফকির কয়জনা ’।- কিছু সংখ্যক ব্যারিস্টার আর উকিলের উকালতি, লম্প- ঝম্প আর আস্ফালন দেখে মনটা দুর্বল হয়ে আসে। কিছু করার থাকেনা বলেই মনের সুখে গাই ‘হাই কোর্টের ভিতরে কত ব্যারিস্টার ঘুরে আসল কাজের কয়জনা।’ এদের কান্ডকীর্তি দেখলে মনে হয় তারা আইনী আদালতে রাজনীতির রিক্সা দৌড়াচ্ছেন। ধস্তাধস্তি, ঠেলাঠেলি, গালাগালি এমন কি হাতাহাতি করে যে ভাবে একে অপরকে যাতাযাতি করেন তাতে মনে হয় রাতারাতি কেউনা কেউ মন্ত্রী হয়ে জাতিকে ধন্য করবেন। আমার কথায় কেউ অস্থির কিংবা বিচলিত হবেন না। টেলিভিশনের পর্দায় বসে দেখে নেন হাই কোর্টের বারান্দার বেহিসাব ধাক্কাধাক্কি। কী কাত্তিক চেহারা আর চোয়ালের বাহাদুরীরে বাপ! লজ্জায় আর ঘৃনায় মাথা হেট হয়ে আসে। শুধু হাস্যস্করই নয় একবারেই ‘হরিবোল’ কান্ড। এমনটি দেখে ‘বিধি বাম হবেন না শ্যাম হবেন’ বলা কঠিন। বরাবরই শুনতাম ‘আন্ধা-কানুন’ এখন দেখছি কিছু সংখ্যক ‘গান্ধা উকিল’ আন্ধা হয়ে আমাদের ধান্ধায় ফেলছে। নিজেদের হাতটাকে লম্বা করতে গিয়ে তারা বাঙাল জাতটাকে শিকেয় তুলছে।
আগে গ্রামেগঞ্জে উকিল ব্যারিস্টারের কত নামডাক ছিল। সংখ্যায়ও তখন সংখ্যায় কম ছিল। এখন কটাই, পটাই , আজর, মজর অনেকেই উকিল ব্যারিস্টারী সার্টিফিকেট নিয়ে লেফাফা দুরুস্ত করে কোর্টের বদলে নিজের পরনের কোটে ব্যারিস্টার নাম লিখে করছে দৌড়াদৌড়ি। এদের দেখে বলতেই হয় ‘এখানে উকিলের ঝিল-ভাত পায়না বলেই কোর্টে মারে ঢিল’।- ষোল কোটি মানুষের দেশে সতেরো হাজার উকিল থাকবে তা’তে দোষ নেই কিন্তু আদব খাছলতে হাজারে হাজারে উকিল ব্যারিস্টার যে বর্তমানে ‘বারই বেপারী’ হয়ে গেছেন তা’ মূর্খজনেরও জানা। এমন আইন বেপারীদের দেখে একটা প্রবাদ মনে পড়ে- ‘আমি বেহায়া পেতেছি পাত, দেখি কোন বেহায়া না দেয় ভাত।’
বাঙাল মুল্লুকে কিছু সংখ্যক অজা আছেন। তাদেরকে ন্যাংটা রাজার দল গাঁজা খাইয়ে মজা লাগায়। সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা আর তাদের থাকেনা। মুখ সামলে কথাও বলতে পারে না। এই অজা, বখাটে, বেকুবরা গাঁজাকুরি কথাবার্তা বলে যেমনি তর্ক বাধায়, তামাশা নিন্দায় গলাবাজি করে তেমনি আজকাল কিছু সংখ্যক উকিল মুক্তারেরা অসম্ভব ক-ুযুক্তি, কু-উক্তি ও কুৎসা কীর্তন করেণ। ঘন্টার পর ঘন্টা জাতীর সামনে প্যাচাল পাড়েন। ‘তিলকে তাল’ করার মুন্সিয়ানা দেখান। এখন কথা হল, এসকল ‘তালে’র আর ‘তেলে’র উকিল ব্যারিস্টারেরা যদি গুলতানি মেরে আমাদের কোর্ট-কাচারীর শোভা বর্ধন করেন তা’হলে আইন-কানুন আর কোর্ট-আদালতের কি দুর্দশা হতে পারে তা‘ সহজে বোধগম্য।
লক্ষ্য করার বিষয়, ইস্ট-লন্ডনের ‘হোয়াইট-চ্যাপেলে’ বর্তমানে আইনি দোকানের সরগরম বাজার। প্রায় সব কয়টিতে চলছে ইমিগ্রেশন কেইছের ব্যবসা বানিজ্য। এসকল দোকানের তটে বসে অনেক আইন কর্মীরা নিজেদের পেটে দেয়ার রুটি সংগ্রহ করছেন। ভালই লাগে, এরাতো আর বাংলাদেশের আইজীবীদের মত হাই কোর্টের বারান্দায় ধাক্কাধাক্কি করছেন না। তবে হালে দেখছি লন্ডনের অনেক আইন-প্রেয়সি শিক্ষানবীশরাও আজকাল তা’দের বড় ভাইদের অনুসরণ, অনুকরণ করে টেলিভিশনের পর্দায় বসে বেশ তর্ক বিতর্ক করেন। খারাফ বলিনা তবে ভাবসাব দেখে মাথায় হাত! ‘যুক্তিহীন বাঙ্গালর কুযুক্তি সার’ এই কথাটার সত্যমিথ্যা যাচাই করার আর কোন প্রয়োজন নেই। টেলিভিশনের টক-শোই কাফি। কথা বলার ঢং,বিষয় বস্তুর উপাদান আর তর্কাতর্কির বাহার দেখে দর্শকরা তাজ্জুব! বাঙালি বান্দাদের এমন তরক্কিটা দেখে আর যাই হোক মনের ভরষাটা আর রাখতে পারিনা। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন ‘জেনে শুনে বিষ করেছি পান‘ ।- আমি গাই ‘দেখে শুনে বিষ করছি পান’। -কিন্তু বিষ পান করে কত আর বিষ হজম করা যায় বলুনতো? বিষ জিনিসটাতো আর বিশবার পান করার বস্তু নয়, আর বারবার পান করার মত তাক্কত লাখে একজনেরও আছে কিনা সন্দেহ।