অসহায়ত্ব দূর করে বলুন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ…’

momin mahadi 1মোমিন মেহেদীঃ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেছেন. ফেসবুক, টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বিটিআরসির সহযোগিতা নিতে হয় পুলিশকে। কিন্তু বিটিআরসি পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারে না। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এই হলো তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশ। কথায় আছে ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই/ নিধিরাম সরদার।’ আর আমাদের দেশের বেলায় বলা যায় ‘তথ্য নাই প্রযুক্তি নাই/ ডিজিটাল সরকার।’ যে কারনে কয়দিন যেতে না যেতেই ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হয় আমাদের রাজনৈতিক হর্তাকর্তাদের। যাদের রাজনীতি-ই একমাত্র হাতিয়ার; যা ব্যবহার করে এরা রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানানোর সর্বোচ্চ চেষ্টায় অধিষ্ট হয়। এদের রাজনৈতিক গোঁড়ামির কারনে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা তাদের মৌলিক অধিকার তো হারাতে বসেছেই; সাথে সাথে জীবনও। যে কারনে নতুন নতুন কৌশলে খুন হচ্ছে একের পর এক। বাড়ছে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-চাঁদাবাজী-ধর্ষণসহ অপরাধের সকল অলিগলি। তার-ই সাথে সাথে ভুয়া আইডিতে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। অন্যান্য অপরাধকে কোন না কোনভাবে বন্ধ করার চেষ্টা চালালেও এই অপরাধটিকে কোনভাবেই আর বন্ধের উদ্যেগ নিতে পারছে না তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর মন্ত্রী-এমপি বা আমলারা। বরং তারাই কোন না কোনভাবে সহায়তা করছে সাইবার ক্রাইমারদেরকে। যেমন ‘বাঁশের কেল্লা’ ‘সাঈদীর ভক্ত’ ‘ছাত্রশিবির’ ‘আল্লাহর দল জামায়াতে ইসলাম’ ইত্যাদি দেশ বিরোধী-ধর্ম বিরোধীচক্রের ফেসবুক পেজগুলোকে বন্ধ না করে; বরং সেই সকল পেজ-এ লাইক দিয়ে এদেরকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে। যে কারনে অব্যাহতভাবে বাড়ছে সাইবার ক্রাইম। ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগে ভুয়া অ্যাকাউন্টের বদৌলতে পাল্টে যাচ্ছে অপরাধের ধরন। আর এতে অসহায় হয়ে পড়েছে স্বয়ং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিও। সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াত-যুদ্ধপরাধীচক্রের এই সাইবার ক্রাইম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভুয়া অ্যাকাউন্টের সংখ্যা, যা হুমকি-ধমকি, চাঁদাবাজি এবং অপপ্রচারসহ নানা রকম অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিযোগ এবং প্রমাণ সাপেক্ষে ফেইক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হলেও ফের তা নতুন নামে খুলে দেশ বিরোধী-ধর্ম বিরোধী সকল অপকর্ম চালানো হয়।
সরকারের তথাকথিত ডিজিটাল ধ্বজাধারী মন্ত্রী-এমপি ও আমলারা হয়তো জানেই না যে, নীতিমালার অভাব এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকায় ভুয়া পরিচয় দিয়ে নামে-বেনামে খোলা অ্যাকাউন্টের কারণে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশে সাইবার জগতের প্রায় ৭০ ভাগ অপরাধ সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইটে হয়ে থাকে। ফেসবুকের পাশাপাশি টুইটার-ব্লগের ব্যবহার থাকায় অধিকাংশ অপরাধ এই তিনটি সাইটের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। ইচ্ছা হলেই যে কেউ আইডি খুলে এসব অপরাধে অংশ নিচ্ছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। জামায়াতে ইসলাম, জঙ্গী সংগঠনগুলোর সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ বিরোধী চক্রের ইন্ধনে দেশে এখন শতাধিক ব্লগ নামক অন্যায়ের কারখানা খুলে বসেছে সাইবার ক্রাইমাররা। তাদের বাড় এতটাই বেড়েছে যে, কথায় কথায় এরা দেশ বিরোধী-সংবিধান বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে অহরহ। আর এই সাইবার ক্রাইমারদের যোগ সাজশেই ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগে ভুয়া আইডির অন্তরালে অপরাধের জাল দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে ‘আনসোশ্যাল’ কর্মকান্ড চলছে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকসহ সব অঙ্গনে। একই ব্যক্তির নামে একাধিক, ততোধিক কিংবা তারও বেশি অ্যাকাউন্ট খুলে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে পুরোদমে, যে তালিকায় এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, এমনকি বঙ্গবন্ধুও বাদ যাচ্ছেন না। তবে ওইসব অ্যাকাউন্টধারীর কেউ কেউ ভালোবাসা থেকেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে ফেসবুক চালান বলে দাবি করেছেন, যদিও নামের অপব্যবহার করছেন অনেকেই। অবশ্য সবার আগে গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশের একদল সাইবার বিশেষজ্ঞ। যারা রাজনীতি-কূটনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সচেতনতার সাথে সাথে থাকবে বিশ্ব ও বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র সচেতন। যে কোন অন্যায়কে এরা সাইবার প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে বন্ধের জন্য নিবেদিত থাকবে। তা না হলে এভাবে বাংলাদেশকে ধ্বংশের জন্য একের এক ষড়যন্ত্র করেই যাবে ভয়ানক ষড়যন্ত্রকারীরা।
এই ষড়যন্ত্র বন্ধে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আর তা হলো- ফেসবুকের আদলে একটি সামাজিক ওয়েব সাইট বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ মানসহ চালু করা। যেই দায়িত্বটি পালনের জন্য উদ্যেগ নিতে পারেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইটি উপদেষ্টা এবং আইটি ম্যান হিসেবে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিত সজিব ওয়াজেদ জয়।
কেননা, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশে সাইবার ক্রাইমাররা খুবই দক্ষ হয়ে এগিয়ে আসছে। নজরদারি আর কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং ধর্ম নিয়ে কটূক্তির দায়ে কিছু ফেসবুক ও ব্লগ বন্ধ করলেও পরক্ষণেই তা ভিন্ন নামে খোলা হচ্ছে। যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রাও। এভাবেই দিনের পর দিন সাইবার ক্রাইমের পরিধি বাড়ছে। আর এ কারণে সব দিক সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এমনকি সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে কমিটি গঠন করেও কূল-কিনারা পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। অতীতে সাইবার ক্রাইমের দিকে খুব বেশি নজর দেয়া না হলেও ব্লগার হত্যায় বিষয়টি এখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলতে গিয়ে বিটিআরসি গণমাধ্যমকে বলেছে, আপত্তিকর পেইজ বন্ধে বিটিআরসি ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানালে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। কারণ, সবকিছু নির্ভর করে ফেসবুক-টুইটার কর্তৃপক্ষের ওপর। তারা চাইলে বন্ধ করে, আবার নাও করতে পারে। আবার কোনো পেইজ বন্ধ করে দিলেও আপত্তিকর প্রচারণাকারীরা ভিন্ন নামে একই ধরনের পেইজ খুলে প্রচারণা চালায়। তখন আর কিছুই করার থাকে না। ২০১২ সালের শুরুর দিকে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে একটি বিশেষ দল গঠন করে প্রতিষ্ঠানটি। ‘বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম’ নামের ওই দলটি সাইবার ক্রাইম শনাক্তে কাজ শুরু করে সেই সময়। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়থ এমন কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং ওয়েবসাইট বন্ধও করেন তারা, যার মধ্যে অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো ফেসবুক পেইজ ‘বাঁশের কেল্লা’। কিন্তু ওই পেইজ বন্ধের কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা নতুন একাধিক নামে প্রচারণা শুরু করে। তখন অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়ে বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ।

অসহাত্ব দূর না করে শুধু ডিজিটাল ডিজিটাল বলে বুলি আউড়ানো বন্ধ করা প্রয়োজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। কেননা, হাস্যকর হলেও সত্য যে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২ লাখ। এর মধ্যে ৮২ লাখ পুরুষ এবং ২২ লাখ নারী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর থেকে প্রতি ৬ মাস অন্তর প্রায় ৩২ লাখ ব্যবহারকারী বাড়ছিল। সেই হিসাবে সর্বশেষ চালানো জরিপের পর এখন পর্যন্ত ফেসবুক ইউজারের এই সংখ্যা দেড় কোটি। অথচ ভার্চুয়াল জগতের শক্তিশালী এই সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইটের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি বিটিআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে এই মাধ্যমের ভুয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যাও নেই।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ফেসবুক থেকে এমনই অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ থেকে। দলটির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়, দলীয় নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট না থাকলেও তার নামে যত্রতত্র আইডি খুলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সম্মান ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে শেখ রেহানা এবং রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিকীসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নামে খোলা ফেইক আইডি থেকেও। এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করে গুটিকয়েক ফেসবুক পেইজের লিংক উল্লেখসহ বাকিগুলো বন্ধের তাগাদা দিলেও এখনো তা সক্রিয়। তার মানে দাড়াচ্ছে এই যে, সর্ষের মধ্যেই ভূতের বসবাস। এই ভূতদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নিলে আজ যেমন বলা হচ্ছে, ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট এবং আপত্তিকর মন্তব্যকারী যে কারো বিরুদ্ধে বিটিআরসিতে অভিযোগ করলে সেটা অভিযোগেই সীমাবদ্ধ থাকে। কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপার আমলেই নেয় না। এই ধারা অব্যহত থাকবে অনাদিকাল। বেড়ে যাবে অন্যায়ের রাজত্ব সময়ও। যা আমাদের কাম্য নয়; কাম্য নয় সাইবার ক্রাইম নিয়ে সরকারের এমন নীতিমালাহীন কর্মকান্ড, নীতিমালাহীন এগিয়ে চলাও। তাই চাই পদক্ষেপ। আর সেই পদক্ষেপ নিতে হলে সবার আগে জামায়াত-জঙ্গীদের চেয়ে শক্তিশালী সাইবার শক্তি নির্মাণ এখন সময়ের দাবী…

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি

Email: [email protected]