সরকারকে জবাব দিল অ্যামনেস্টি

amnesty internationalডেস্ক রিপোর্টঃ গত বছর ২৭শে অক্টোবর লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দেয়া এক বিবৃতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নোটের জবাব দিয়েছে সংস্থাটি । এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘গত বছরের ৬ই নভেম্বর লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার খোন্দকার এম. তালহার মারফতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারের একটি আনুষ্ঠানিক নোট হাতে পায়। দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রত্যাসন্ন ফাঁসির বিষয়ে ২৭শে অক্টোবর আমাদের দেয়া বিবৃতির জবাবে বাংলাদেশ সরকার ওই নোট দেয়।’ এই নোটের জবাবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গণমাধ্যমে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উত্থাপিত মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা একটি চিঠিতে ওই নোটে উল্লিখিত অভিযোগসমূহের জবাব দিয়েছি। এ ছাড়া নীচের বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছি।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ বিবৃতিতে মোট ৫টি অংশে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছে।
বিবৃতির প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন সংগঠন। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার ও অপরাধীদের দায় নিশ্চিতের জন্য এটি প্রচারণা চালিয়ে থাকে। অপরাধীরা কারা বা তাদের কোনো রাজনৈতিক সমপৃক্ততা আছে কি না, সেগুলো এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। আমরা বাংলাদেশ বা কোথাও কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন বা বিরোধিতা করি না। বাংলাদেশ নিয়ে আমরা কয়েক দশক ধরে কাজ করেছি। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ জাতীয় পার্টি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও মানবাধিকার পরিস্থিতি নথিভুক্ত করেছি। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সামপ্রদায়িক সহিংসতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের শিকার ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পূর্ববর্তী সরকারসমূহের প্রতি আমরা সুপারিশ জানিয়েছি। নিজেদের নোটে বাংলাদেশ সরকার উপসংহার টেনেছে যে, বিবৃতিতে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করায় তাদের বিচারের ক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পক্ষপাতদুষ্ট পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে। আমাদের ২৭শে অক্টোবরের বিবৃতি ও পূর্বের আরও দুইটি বিবৃতিতে এ দুই দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আমরা উল্লেখ করেছি, তা ছিল তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রকাশ্য বিবরণ এবং বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাদের যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে।’
বিবৃতির দ্বিতীয় অংশ অ্যামনেস্টি বলেছে, ‘সরকারের নোটে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে বিচারের পক্ষপাতদুষ্টতা সমপর্কে মাত্রাজ্ঞানহীন মন্তব্য করার অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এতে কেবল অপরাধী ও তাদের সমর্থকদের স্বার্থ হাসিল হয়েছে। আমরা বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে বহু বছর ধরে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণ-সহিংসতার বিচারহীনতার দিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছি। এ বিচারহীনতা পূর্ববর্তী সরকারসমূহের অসক্রিয়তার দরুন প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিই। ২০০৮ সালে যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে মানবাধিকার বিষয়ক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও অন্যান্য মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী তদন্তে একটি স্বাধীন আনুষ্ঠানিক কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে আমরা সুপারিশ করেছিলাম। এ ছাড়াও, ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সরকারি প্রতিনিধি ও আদালতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-বিডি) প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়েছিল। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড এ বিচার প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেছি। বলেছি, মৃত্যুদণ্ড এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অপরাধ ও মানবাধিকারের অন্যান্য মারাত্মক লঙ্ঘনে সংশ্লিষ্টতার জোরালো সন্দেহ রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে, তাদের সকলের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত করার আহ্বান জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, ‘বাংলাদেশের সংঘাতে’ উভয় পক্ষের দ্বারা আন্তর্জাতিক আইনানুসারে স্বীকৃত অপরাধ সংঘটন ও অন্যান্য মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেয়ার পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান সংঘাতের মতো এখানেও আমরা উভয় পক্ষের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের আহ্বান জানাই।’
বিবৃতির তৃতীয় অংশে মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, ‘আইসিটি-বিডি’তে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর পর থেকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গবেষণা পরিচালনা করেছে। এতে আইনগতভাবে ও বাস্তবে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের আইনগত মানদণ্ডের মারাত্মক লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে সরকারের কাছে এ উদ্বেগের বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। এরপর থেকেই পরবর্তী বিচারপ্রক্রিয়ায় ত্রুটির দৃষ্টান্ত সরকারের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয়েছে। প্রকাশ্যে লভ্য নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টসসহ বৃহৎ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসমূহ, বিদেশি সরকারের কর্মকর্তারা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও বিচার ও আপিল প্রক্রিয়া নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসব উদ্বেগ নিরসনে সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি।’
বিবৃতির চতুর্থ অংশে সংস্থাটি লিখেছে, ‘কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই সকল ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এক্ষেত্রে অপরাধের ধরন ও পরিস্থিতি; ব্যক্তিবিশেষের দোষ, নিষ্কলুষতা বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্য এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরে রাষ্ট্রভেদে ব্যবহৃত পৃথক পদ্ধতি বিবেচনায় নেয়া হয় না। মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির আহ্বান জানানোর মানে এই নয় যে, কোনো অপরাধ শাস্তি ব্যতিরেকে পার পেয়ে যাক। বরং, এর অর্থ মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত পক্ষপাতহীন বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের নজরে আসা সকল ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে কারও প্রত্যাসন্ন ফাঁসির বিষয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। এক্ষেত্রে কে বা কারা এ ফাঁসির মুখোমুখি হচ্ছে, তা বিবেচনা করা হয়নি। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির জন্য আমরা প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখবো।’
বিবৃতির পঞ্চম ও শেষ অংশে বলা হয়েছে, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারের সদস্যদের সঙ্গে এসব ইস্যু নিয়ে আরও আলোচনা করতে অধীরভাবে আগ্রহী। দেশটিতে গিয়ে সংলাপে বসার জন্য ও বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও মূল্যায়নের জন্য আমাদের প্রতিনিধিদের ভিসা দিতে হবে।’