দীর্ঘ ১৯ বছর পর সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল আজ
ডেস্ক রিপোর্ট :: দীর্ঘ ১৯ বছর পর সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল আজ ২৫শে ফেব্রুয়ারি। পদের প্রত্যাশায় তাই রত্নের ছড়াছড়ি। কাউন্সিল বা সম্মেলনকে সামনে রেখে সুনামগঞ্জে দুটি বলয়ের বিভক্তিও স্পষ্ট হয়ে পড়েছে জেলার আওয়ামী পরিবারে। একদিকে আছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক এমপি মতিউর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা মুকুট, জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল। অপরদিকে পদের আশায় মাঠে আছেন বর্তমান এমপি মুহিবুর রহমান মানিক, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, শাহানা রব্বানী, জেলা পরিষদের প্রশাসক ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন। বিভিন্ন সূত্রে আভাস মিলেছে শীর্ষ পদগুলো কেন্দ্র থেকেই ঘোষণা করা হবে, এ ক্ষেত্রে শীর্ষ পদে আসার সম্ভাবনা রয়েছে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানেরও।
১৯৯৭ সালের ১৯শে মার্চ সম্মেলনের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গড়ে দেয়া হয়েছিল। তিন বছর পর আবার সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও ১৯ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। সম্মেলনের মাধ্যমে পদের পরিবর্তন হওয়ার কথা থাকলেও সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগ যেন নিয়তির হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল এ পরিবর্তনের দায়িত্ব। নিয়তি সে দায়িত্ব পালনও করছে। সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুটো পদই এখন তাই চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। কমিটি গঠনের এক বছরের মাথায় সভাপতি আবদুজ জহুরের মৃত্যু হলে ভার পান সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন। তবে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবদুস সামাদ আজাদের পছন্দের না হওয়ায় কিছুদিন ভার সামলানোর পর তাকে সরে যেতে হয়। তারপর ১৯৯৮ সাল থেকেই মতিউর রহমান সামলাচ্ছেন এ দায়িত্ব। সেবার সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল। তবে ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থী দেওয়ান সামসুল আবেদীনের পক্ষে কাজ না করায় শাস্তি হিসেবে পদ হারান তিনি। দায়িত্ব পান সহ-সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা মুকুট। সেই থেকেই সাধারণ সম্পাদকের ভার তার কাঁধেই।
১৯ বছর ধরে নতুন নেতৃত্ব না আসায় সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ এ সময়ে কমিটির অনেকেই চলে গেছেন পৃথিবী থেকে। সে তালিকায় আছে ১০টি নাম। সভাপতি আবদুজ জহুরসহ এ তালিকায় থাকা অন্য নেতারা হলেন গোলাম রব্বানী, জিল্লুর রহমান, বুদ্ধ দাস, পিলু চৌধুরী, মনোয়ার বখত নেক, হারুন অর রশিদ, নুরুল ইসলাম সর্দার, নুরুল হুদা ও আপ্তির মিয়া। আবার কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন রাজনীতির মাঠ থেকেই। এদের মধ্যে সহসভাপতি নুরুল ইসলাম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ ওঙ্কার নাথ রায়, সদস্য তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, জসিমউদ্দিন ফারুকসহ ৬ নেতা স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে থিতু হয়েছেন। আর দিরাই উপজেলা নেতা কুদ্দুস মিয়া তো দলই ছেড়ে দিয়েছেন। বাকিদের অনেকেও সক্রিয় নন রাজনীতির মাঠে।
দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় জেলায় নিজেদের ঘরও গোছাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। জেলার ১৪টি সাংগঠনিক ইউনিটের ৭টিতেই কমিটি নেই। যে সাতটিতে কমিটি আছে সেগুলো নিয়েও বিরোধ আছে। বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আজ্ঞাবহ না হলে ইউনিটের কমিটিও ইচ্ছেমতো বদলে ফেলা হয়। সম্মেলনের অভাবে বিভক্তি-কোন্দলও ছড়িয়েছে দলের মাঝে। তাই সম্মেলনের তারিখ ২৫শে ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ হওয়ার পর থেকেই নেতাকর্মীদের মাঝে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে। সেই সঙ্গে অবশ্য বিভেদের রেখাটাও স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। তার প্রমাণ মিলেছে পালটাপালটি বর্ধিত সভার মধ্য দিয়ে। সম্মেলনকে সামনে রেখে বুধ ও বৃস্পতিবার প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে পালটাপালটি বর্ধিত সভা করে দুই পক্ষ। অবশ্য শুরুতে বিভেদ স্পষ্ট ছিল না। বুুধবার প্রথম বর্ধিত সভাতে দুই পক্ষই উপস্থিত ছিল। কিন্তু সংগঠনের আওতাধীন উপজেলা কমিটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের নেতৃত্বে একটি পক্ষ সম্মেলন স্থল ত্যাগ করে। পরদিন তারাই একই স্থানে পালটা বর্ধিত সভার আয়োজন করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি ও জেলার সহসভাপতি মহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি ও ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সামছুন্নাহার শাহানা রব্বানী, সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন। উপস্থিত না থাকলেও এ বলয়ের প্রতি সমর্থন আছে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের।
শীর্ষ পদ পাওয়ার ব্যাপারে দুই বলয়ই আশাবাদী। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগে শীর্ষ পদে নতুন মুখ আসার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। ভারপ্রাপ্তদেরই ভারমুক্ত করে পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। তবে অন্য সূত্রগুলো বলছে, ঝা চকচকে একটি কমিটিই হয়তো উপহার পেতে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে সভাপতির পদ পেতে পারেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। আর সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন সুনামগঞ্জের জেলা পরিষদের প্রশাসক এনামুল কবীর ইমন। তবে দু-দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব মাথায় থাকার কারণে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এ মান্নান যদি বাড়তি চাপ নিতে না চান তবে সভাপতির পদে দেখা যেতে পারে মুহিবুর রহমান মানিককে। এটা নিশ্চিত মুহিবুর রহমান মানিক লড়াইয়ে যাবেন না এম এ মান্নানের বিপক্ষে। অবশ্য একই বলয়ের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন একেবারে এক কথায় এনামুল কবীর ইমনকে সাধারণ সম্পাদকের পদটি ছেড়ে দেবেন না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
পদপ্রত্যাশী জেলার সব এমপি বিপক্ষে থাকায় একটু বেকায়দায়ই আছে কমিটির শীর্ষ পদের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বলয়টি। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতা ব্যবহার করে এরা সম্মেলন পিছিয়ে দিতে চান। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ না দিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে চান নেতৃত্ব। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা মুকুট বলেন, আমরা চাইছি সম্মেলনের মাধ্যমে দলে নতুন নেতৃত্ব আসুক, যারা পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে দলকে সুসংগঠিত করতে পারবে। তিনি বলেন, পূর্ণ দায়িত্ব না থাকায় আমরা দলকে সেভাবে সাজিয়ে তুলতে পারিনি।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল বলেন, সম্মেলন না হওয়ায় নেতৃত্বের বিকাশ হচ্ছে না। যোগ্য নেতারা দলে অবাদন রাখতে পারছেন না। তিনি বলেন, নিজে যদি পদ নাও পান তবু যেন সম্মেলন হয়। পদ না পেলে দলের প্রতি আনুগত্যে তার উনিশ-বিশ হবে না।
সম্মেলন পেছানো হোক সেটা যে চাইছেন স্বীকার করলেন সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক। তবে বললেন, এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র নেই। তিনি জানান, বর্তমানে দেশের বাইরে থাকা সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের অভিভাবক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্যই তারা চাইছেন পেছানো হোক সম্মেলন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপস্থিত থাকলে তা সম্মেলনের জৌলুসই বাড়িয়ে তুলবে। তিনি জানান, ১৯ বছর আগের সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, তোফায়েল আহমদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরসহ শীর্ষ নেতারা। তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই, দলে নেই। সবেধন নীলমণি হয়ে টিকে আছেন সুরঞ্জিতবাবু। তাকে আমরা ‘মিস’ করতে চাই না। তিনি বলেন, ১৯ বছর যখন অপেক্ষা করা গেছে তখন আর দু-চার দিনে মহাভারত এমন অশুদ্ধ হয়ে যেত না। তিনি একটু বাঁকা সুরেই বলেন, সম্মেলন পেছানো হলে বর্তমান পদধারীদেরই তো লাভ হবে। তারা অন্তত আরও কয়টি দিন নেতৃত্বে থাকতে পারবেন।
জেলা পরিষদের প্রশাসক ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার এনামুল কবীর ইমন বললেন, সবাই দলে পরিবর্তন চায়। নতুন নেতৃত্ব না এলে দলকে চাঙ্গা করা যাবে না।