এবারেও কি হাজার হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যে ধস নামানো হবে?

সারাবছর ধরেই খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন ব্যবহৃত হলেও ফরমালিন বিরোধী উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযান চালানো হয়নি। যেসব খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিন ব্যবহার করা হয় বাঙালির প্রতিদিনের খাদ্য মাছ তার মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া শুঁটকি, তরকারী, কাঁচা গোশত, দুধ ইত্যাদির মধ্যেও সারাবছর ধরেই ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। অথচ সামনেই যখন আমের মৌসুম তখন ঘোষণা করা হচ্ছে ফরমালিন বিরোধী অভিযান। গত বৃহস্পতিবার ১৮ ফেব্রুয়ারি-২০১৬ ঈসায়ী তারিখে দৈনিক প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, “খুব শিগগির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ফরমালিন বিরোধী অভিযানসহ কঠিন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।”
প্রসঙ্গত, বিগত দুই আমের মৌসুমে ফরমালিন নিয়ে অপপ্রচারের ফলে দেশের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার আম বাজারে ধস নামানো হয়। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা প্রায় ১০০০ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়। বিশেষ করে ‘আমে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে’- এমন অপঃপ্রচারে আমের চাহিদা কমে যাওয়া এবং হাজার হাজার মণ আম ধ্বংস করায় আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আমের বাজারে যেখানে অন্তত ৫০০টি আড়তে প্রতিদিন ৮ কোটি টাকার আম বিক্রি হতো, প্রতিদিন কমপক্ষে একশ’ ট্রাক আম নিয়ে ঢাকায় আসতো, ঢাকায় ফরমালিন বিরোধী অভিযান শুরু করার পর সেখানে কেনাবেচা দৈনিক ৮-১০ লাখ টাকায় নেমে এসেছিল। এভাবে ফরমালিন বিরোধী অভিযানে আম চাষী ও ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যে ফেলা হয়।
বিগত দুই বছর আম মৌসুমে ফরমালিন বিরোধী অভিযানের নামে বহুমুখী তৎপরতা চালানো হয়। একদিকে স্থানীয় জেলা প্রশাসন কাঁচা আম পাড়তে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অন্যদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত একতরফাভাবে হাজার হাজার টন আম ধ্বংস করে। ঢাকাসহ সারাদেশের প্রবেশ পথে পুলিশ বসিয়ে গাড়িতে গাড়িতে খুঁজে, আড়তে আড়তে ঘুরে, বাগানে বাগানে গিয়ে লাখ লাখ টন আম ধ্বংস করে।
তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত আম ব্যবসায়ীরা বারবার বলে আসছিলো- ফরমালিন পরিমাপক যন্ত্রটি সঠিক নয়। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ বিসিএসআইআর ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে উভয় সংস্থাই “ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে। ততোদিনে কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার আমবাণিজ্য ধ্বংস হয়। ভুক্তভোগীরা পায়নি কোনো ক্ষতিপূরণ। সারাদেশের লাখ লাখ লোক পথে বসে। পুঁজি খুইয়ে হা-হুঁতাশ করে। একইভাবে এবারো আমের মৌসুম যখন নিকটবর্তী, তখন ফরমালিন বিরোধী অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
আমাদের প্রশ্ন হলো- শুধুমাত্র আম বা দেশীয় ফলের মৌসুমে ফরমালিন অভিযান চালানো হয় কেন? ফরমালিন বিরোধী অভিযান পরিচালনাকারীরা আমদানিকৃত ফলের ক্ষেত্রে অভিযান চালাতে সারাবছরই অন্ধ ও বধির থাকে কেন?
সম্প্রতি রাজধানীর রমনা, লালবাগ, মিরপুর, তেজগাঁও, মতিঝিল, ওয়ারী, গুলশান ও উত্তরা এলাকার বাজার ও দোকান থেকে এসব ফল সংগ্রহ করে দেখা যায়, মাল্টায় ২ দশমিক ৭০ থেকে ৮ দশমিক শূন্য ৮ পিপিএম, আপেলে ৯ দশমিক শূন্য ২, আঙ্গুরে ১ দশমিক ২৬ থেকে ৭ দশমিক ২০, চেরি ফলে ৫২ পিপিএম মাত্রায় ফরমালিন রয়েছে। অথচ এসব বিষাক্ত ফল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অথচ দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন রয়েছে। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ দেশব্যাপী কার্যকর হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান আইনের অধীনে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ এবং ‘মোবাইল কোর্ট’ও রয়েছে। এসব আইনের অধীনে সারা বছরব্যাপী নিয়মিত ফরমালিন বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা যায়। অথচ তা না করে আমের মৌসুমের আগে দেশীয় আমবাজার ধ্বংস এবং ভারতীয় আমের বাজার তৈরি করতে এধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।