বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন মিলন উৎসব শারদীয় দূর্গাপূজা”

himelপ্রভাষক উত্তম কুমার পাল হিমেল,নবীগঞ্জঃ শারদীয় দূর্গোৎসব বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ গুরুত্বপূর্ন ও ধর্মীয় সামাজিক উৎসব। প্রতিবছর শরতকাল এলেই বাঙ্গালীঁজাতি মেতে উঠেন দূর্গাপূজা এই উৎসবের আমেজে। ধর্মীয় এক হৃদয় নিংড়ানো মিলন মেলায় পরিনত হয় এই উৎসব। আর এই উৎসবের উৎসে অধিষ্টিত হিন্দু পুরানের অন্যতম দেবী হলেন দূর্গা। পৌরনিক কাহিনী অনুসারে দেবী দূর্গাই হলেন শিবের স্ত্রী পার্বর্তী। লক্ষী,সরস্বতী,গনেশ ও কার্তিকের জননী তিনিই। কিন্তু কেন শিবজায়া পার্বর্তীর নাম দেবী দূর্গা হল। স্কন্দপুরান বর্ননা অনুসারে রুরু দৈত্যর পুত্র দূর্গকে বধ করিেছলেন বলেই পার্বতীর নাম হয়েছে দেবীদূর্গা। তবে বাঙ্গালীর দূর্গোৎসবে দিবী কিন্তু স্কন্দপুরানের বর্ননামতে দূর্গাসুর বধকারী রুপে তিনি পূজিত নন। এখানে তিনি পূজিত হন মহিষাসুর মর্দিনী রুপে। দেবী দূর্গার এই আবির্ভাবের পরিচয় পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরানে। ভাগবত পুরান অনুসারে ব্রম্মার মানস পুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদ সাগরের তীরে মৃম্ময়ী মুর্তি নির্মান করে দেবী দূর্গার আরাধনা করেন। মার্কন্ডেয় পুরান মতানুসারে এই দুগোৎসবের আয়োজন করেন রাজা সুরথ। আর রাজা সুরথ এই দূর্গাপূজা করেছিলেন বসন্তকালে। সেই পূজা অনুসরন করে পৃথিবীর কোন কোন স্থানে দুগোৎসবের আয়োজন করা হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে দূর্গাপূজা জনপ্রিয় সময়টা হল শরতকাল। শুরুতে শরতকালে দুগোৎসব করেন শ্রী রাম চন্দ্র। কৃর্তিবাস রামায়ন অনুসারে রামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে কান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে লংকাধিপতি রাবন আকুল সুরে দেবীর স্তব শুরু করলেন। রাবনের কাতর স্তবে দেবীর হৃদয়ে করুনার উদ্রেক হল। রাবনকে অভয় দিলেন তিনি। সম্পূর্নরুপে অনাকাংখিত এই খবরে খুুব আশংকিত হলেন রাামচন্দ্র। দেবতার এ খবরে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রম্মার কাছে গেলেন। এই সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে পরিত্রান পাবার জন্য ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানালেন ব্রম্মাকে। ব্রম্মা রামের কাছে গিয়ে দূর্গা পূজা করার জন্য আবহান জানালেন। দূর্গাপূজাই হল এই সংকট থেকে পরিত্রানের একমাত্র উপায়। কিন্তু বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের দূর্গাপূজা সাধারনত আশ্বিন মাসের শুকপক্ষের ষষ্ট দিন ষষ্টী থেকে দশম দিন অর্থাৎ বিজয়া দশমী দিন পর্যন্ত পাচঁদিন অনুষ্টিত হয়। এই পাচঁটি দিনের পূজা যথাক্রমে দূর্গষষ্টী, মহাসপ্তমী, মহাষষ্টী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। দূর্গাপূজা এই পাচঁদিনসহ সমগ্রপক্ষটিকে দেবীপক্ষ সামে আখ্যায়িত করা হয়। আর দেবী পক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবশ্যার দিন থেকে। এই দিইট “মহালয়া” নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি হয় পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়। এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত এবং বার্ষিক লক্ষীপূজার দিন হিসাবেও গন্য হয়। দূর্গাপূজা মূলত পাচঁ দিনের অনুষ্টান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা হয় এবং কোজাগরী লক্ষীপূজায় হয় তার সমাপ্তি। বাংলাদেশে দূর্গোৎসবের বহুল প্রচলিত রুপ অর্থাৎ মহিষাসুর মর্দিনীর পূজার উলেখ পাওয়া যায় মার্কন্ডেয় পুরানে। মূল পুরানটি চতুর্থ শতাব্দিতে রচনা হলেও দূর্গাপূজা বিবরন সম্বলিত সপ্তশতীতে রয়েছে ৯ম-১২শ শতাব্দির মধ্যকার সময়ের নির্মিত একাধিক মহিষাসুর মর্দিনীর মুর্তিও। তবে সেই সব মুর্তিতে মহিষাসুর মর্দিনী কিন্তু পরিবার সমন্বিতা নন। উপমহাদেশে জমিদারী প্রথা বিলোপের পর শারদীয় দূর্গপূজায় জমিদারদের অংশ গ্রহন স্বাভাবিক ভাবেই অনেকটা কমে যায়। নব্য ধনীক শ্রেনীর উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে দূগোৎসব আয়োজক কমিটিতে যুক্ত হয় অনেক নতুন নতুন মূখ। তবে প্রতিটি দুর্গোৎসবই তখনকার সময় আয়োজিত হত সম্পূর্ন একক উদ্যোগে। আনুমানিক ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় ঘটে একটি উলেখযোগ্য ঘটনা।
গুপ্তিপাড়ার একটি ধনী পরিবারের আকস্মিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনিশ্চয়তার সন্মূখীন হয় ঐ বাড়ীটির বাৎষরিক দূর্গাপূজার আয়োজন। তখন গুপ্তিপাড়ায়ার ১২ জন বন্ধু মহলের যুবক এগিয়ে আসেন যৌথ উদ্যোগে দূর্গাপূজা পালন করার জন্য। এই ১২ জন ইয়ার বা বন্ধু সংঘবদ্ধভাবে গ্রহন করে পূজা পালনের সার্বিক দায়িত্ব। আর গুপ্তিপাড়ার এই পূজাটি মানুষের কাছে পরিচিত হয় “বারোইয়ারী” বা বারোয়ারী পূজা নামে। এই বারোয়ারী পূজার সুত্র ধরে একক উদ্যোগে সম্পাদিত দুর্গাপূজাই আজ পরিনত হল সার্বজনীন শারদীয় উৎসবে। ধনীর আঙ্গিনা থেকে দূর্গাপূজা নেমে এলো অনেকটা সাধারন মানুষের সাধ্যের মাঝে। গুপ্তিপাড়ার আদর্শ অনুসরন করে সম্মিলিত উদ্যোগে বারোয়ারী পূজা ছড়িয়ে পড়ল ভারতীয় উপমহাদেশসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের এই নৈকট্য সাধারন মানুষকে সাহস জোগালো র্দূগাপূজা মতো সর্ববৃহৎ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্টানে বিত্তশালীদের একচেটিয়ে অধিকারে ভাগ বসানোর। ব্যক্তি বা বারোয়ারীর সীমা ছাড়িয়ে দূর্গাপূজা আজ পরিনত হল সার্বজনীন শারদীয় উৎসবে। ভারতবর্ষে ব্রিট্রিশ বিরোধী আন্দোলন যখন জোরদার হয়ে উঠল তখন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপবের পথে স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টাও চলল সমানে তালে । ইংরেজদের নজর এড়াতে দুর্গোৎসবকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল বিপবীরা। ধর্মীয় অনুষ্টানে ছদ্মাবরনে বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষকে সংঘবদ্ধ করার একমাত্র উপায় হল এই শারদীয় দূর্গাপুজা। কালের পরিক্রমায় ব্রিট্রিশ শাসনের অবসান হল। বিভাজিত হয়ে পড়ল অবিভক্ত বাংলা। পাকিস্থান অপশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে বিভাজিত বাংলার পুর্বাঞ্চল রুপান্তরিত হল বাংলাদেশ নামের একটি নতুন স্বাধীন রাষ্টে। আর বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের অসাম্প্রদায়িক প্রবনতা শারদীয় দূর্গাৎসবকে আজ পরিনত করল প্রকৃত অর্থেই বাঙ্গলীর সার্বজনীন উৎসবে। বছর ঘুরে এই সার্বজনীন দূর্গাপূজা এলেই বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মেতে উঠেন এক আনন্দ উৎসবের আমেজে। এই প্রানবন্ত আমেজ সকলের মানুষের মাঝে শান্তির বার্তা বয়ে আনুক।

লেখকঃ-
প্রভাষক উত্তম কুমার পাল হিমেল
যুগ্ম সাধারন সম্পাদক
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ,নবীগঞ্জ
ও সাবেক সাধারন সম্পাদক নবীগঞ্জ প্রেসকাব ।
মোবাইলঃ-০১৭১২-৮৫১৮৫০