নিজে বাঁচলেই না বাপের নাম : আব্দুল আজিজ তকি
‘গুমে’র খবরে বাঙালির ঘুম হারাম, ‘খুনাখুনি’র খবরে আনন্দ-ফুর্তি উদাও, ‘অপহরনের’ খবরে অপরিসীম অশান্তি আর উদ্বিগ্নতায় কাটছে সাধারণ মানুষের দিন। এমন সব ভয়ানক, লোমহর্ষক ও বিপজ্জনক ঘটনায় মানুষ সর্বদা আতঙ্কিত। কি লঙ্কাকান্ড! কি দুর্ধর্ষ ঘটনা! শুনলেই বাদবাকী যতসব খবরাখবর আছে সবগুলো একেবারেই ম্লান হয়ে যায়। আগে বন্ধুবান্ধবরা মজা করে বলতো‘তোমার জন্য সাত খুন মাফ’।- কথাটার সত্যমিথ্যা যাচাই করার সুযোগ বিগত কালে হয়নি। গুম করে নারায়নগঞ্জে সাতটি খুন (২৭শে ্ওপ্রিল ২০১৪) এখন বাংলদেশে সরকারের একেবারে সন্মুখ পরীক্ষা। এবার সত্যি সত্যি দেখবো ‘সাত খুন মাফ’ হয় কি না। একটা স্বাধীন দেশের মাটিতে কি কারণে একসাথে সাতটি খুন হল তা অবশ্যই জানা দরকার। যেভাবে শান্ত মস্তিষ্কে, পরিকল্পিতভাবে এই মানুষগুলোকে নির্মমহালে মারা হল তা’ সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে। দিন-দুপূরে বিচারালয় প্রাঙ্গণ থেকে ধরে নিয়ে এমন লোমহর্ষক, গায়ে-কাঁটা দেয়ার মত কাজটি কি ভাবে ঘটানো হল তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। কার সাথে কার কি ধরনের দুষমনি বা দুস্তি আছে তা’ আমরা জানিনা। দুষমনি যদি থেকেও থাকে তারপরও বলবো এমন নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন কাজ করাটা কি কোন বিধানে যুক্তিসঙ্গত? আইন কানুনের বালাই কি বাংলাদেশের মাটিতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?
কতটা পাষন্ড আর পাষান হলে, ঠান্ডা মাথায় এমন ভয়ঙ্কর কান্ড কেউ ঘটাতে পারে তা’ সহজে অনুমেয়। বলতেই গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়। পূর্ব থেকেই দু’একটা বিচ্ছিন্ন গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানির কথা শুনেছি, খবরের কাগজে ও টেলিভিশনে দেখেছি। সতেরো কোটি মানুষের দেশে এমন দু’ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু এক সাথে ঢালাওভাবে সাত-সাতটি তরতাজা প্রাণকে নাকের ডগায় ধরে নিয়ে হত্যা সেকি সহজে মেনে নেয়া যায়! এই মানষগুলোকে মাথায় আঘাৎ করে, গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করলো অথচ হত্যাকারীদের এখনো ধরা গেলনা! টের পাওয়া যাচ্ছে হয়তো এরা ধরাছোয়ার বাইরেই থেকে যাবে। এমন মর্মান্তিক কান্ড কইতেই বুকটা কেঁপে উঠে। শুধু হত্যা নয়, মারার পরও বুকে ইট বেধে, নাভির নিচে ফুটো করে শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে রেখেছিল লাশ।।
খুন করে পানিতে লাশগুলোকে ডুবিয়ে ফেলা পর্যন্ত যতগুলি কাজ করা হল এ’গুলো করতে কি কম সময় লেগেছে? তাও একটা দু’টো নয়, সাত সাতটি মানুষের প্রাণ হরণ ও তাদের লাশের প্রতি কি নির্দয় ব্যবহার! বিশ্ময় লাগে, আমাদের আইন প্রয়োগকারি সংস্থা এ’ব্যাপারে আজ অবদি তিলপরিমান খবর নিতে কিংবা দিতে পারলোনা! এটা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ‘অপারগতা’ না ‘অসাবধানতা’ খতিয়ে দেখার বিষয়? এই সাতটি লাশের সাথে যে আরো কয়েকটি গলিত, পচিত লাশের দেহাবশেষ পাওয়া গেল, তা’তে আমাদের সকলের চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা আরো বেড়ে গেল। শুনা যায় শীতলক্ষ্যায় নাকি সচরাচর মানুষের লাশ ভাসতে দেখা যায়। নিশ্চয় এমন খবর আমাদের র্যাব পুলিশের অজানা থাকার কথা নয়। তা’হলে বুঝাই যাচ্ছে, শীতলক্ষ্যাকে অনেক আগে থেকেই মানুষের ‘লাশ ফেলার ভাগাড়’ বানানো হয়েছে। এ’ নদীর জল যে দিনে দিনে লোহিত জলে রূপান্তরিত হচ্ছে তা’ সাধারণের চোখে পড়লেও কি আমাদের আইন প্রয়োগকারীদের চোখে পড়ে না ? এমন অবস্থা দেখে তারা কি করেন অথবা কি ভাবেন জানিনা। এদিকে দেখেন আমাদের নেতা-পেতাদের কান্ডকীর্তি। সকলেই উন্মাদের মত মতামত ঢালছে। ‘কার দলের কে মরেছে, কার দলের কে মেরেছে’ এই তাদের কথাবার্তা। কার ছেলে হারালো, কার বাপ হারালো, কোন মার বুক হল খালি , কোন মহিলার হাতের চুড়ি ভাঙতে হলো অথবা সিঁথির-সিঁদুর মুছতে হলো সেটা তাদের কি দেখার বিষয় নয়? দেখুন রাজনীতির দলাদলি আর হুলাহুলি, টেক্কামেরে কে কার ঘাড়ে চড়তে পারে, মুখ বুলিয়ে কে কার ঠোঁটে উটতে পারে এমন সব প্রতিযোগিতা।
‘ঘরে ভাত না থাকলে নাকি বাঙালি বেয়াক্কেল।’ এই যদি হয়, তা’হলে বলবো ভাতের অভাব আমাদের নেই। আমরা নিশ্চয় এখন আক্কেলদার। বাঙালির ভাড়ারে ভাত আছে বলেই কইতে পারি-বাংলাদেশের মানুষ আর ‘মগ’ নয় এবং ‘মগের মুল্লুকে’ও থাকছেনা। যতই প্যাচপাঁচ করা হোক না কেন, সাত-পাঁচ করে, সাতটি তরতাজা প্রাণ হরণকারি, পাষন্ড, পাতকীদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হলে সেটা হবে ইতিহাসের ‘মহা-কলঙ্ক’।- বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রে’র বদলে বলা হবে ‘গুমপ্রজাতন্ত্র’ অথবা ‘খুনপ্রজাতন্ত্র’।- রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ভাল ‘মিঠা কথায় মন ভিজে তবে ছিড়া ভিজে না’।- যে বা যারা এমন কাজ করেছে তারা পেশাদার, দক্ষ ও অত্যন্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জানোয়ার। এই সরকারের আমলে যদি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার. বিডিআর বিদ্রোহের বিচার, বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, কাদের মোল্লার বিচার সঠিক হয়ে থাকে তা’হলে এই সাতটি খুনের দৃষ্ঠান্তমুলক বিচারও জনসন্মুখে হওয়া উচিৎ। এ’ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতাকে ধরা হবে দুষ্কৃতিকারীদের প্রতি উদারতা ও আইনের শাসনের প্রতি চরম ব্যর্থতা। হত্যাকারিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারলে মনে করা হবে, লম্বাহাতের কেউ না কেউ ‘সাত খুন মাফ’ করার মত সাহস তা’দেরকে যোগিয়েছে।
সরকারের আয় উন্নতির কথা আমরা জানি। যতই বলা হোক, চল্লিশ হাজার মেট্রিক টন খাবার মজুদ আছে, ইলেকট্রিসিটি ৩০০০ মেঘাওয়াট থেকে ১০০০০ উন্নিত করা হয়েছে, ২টা আনবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরী হচ্ছে মেট্রোরেল করা হচ্ছে, মালয়েশিয়া ৩০০০ কিঃমিঃ হাইওয়ে শেষ করবে, জুনে পদ্মাসেতুর কাজ শুরু করবে, জিডিপি ৬.৭ হবে তা’তে করে কি যে মানুষগুলোর প্রাণ কাড়া হচ্ছে তাদের আত্মীয়স্বজনের মনের ব্যথাটি একটু প্রশমিত হবে? এ সবকিছু দিয়ে কি একটা মৃতপ্রাণকে ফেরৎ পাওয়া যাবে? সারা পৃথিবী দিয়ে যেখানে একটি মানুষের প্রাণ ফেরৎ আনা যায়না, সেখানে সেই মানুষটির প্রাণ বধ করারও অধিকার কাউকে দেয়া হয় নাই। আদেশ-উপদেশ নয়, শুধু একটি ছোট্ট অনুরোধ, কয়েকগন্ডা মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের পক্ষে যেন আমাদের বিবেকবুদ্ধি ভুলুন্ঠিত না হয়। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। আমাদের রাজনীতি, আমাদের মেধা, আমাদের কাজকর্ম, ভালমন্দ যাই থাকুক আমরা যেন স্মরণে রাখি সাধারণ মানুষের ‘একটি অমূল্য জীবন’ ।- মানুুষের ছোট্ট জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার দায়ীত্ব সরকার ও সমাজের। আর এই নিরাপত্তা দিতে না পারলে যতই উন্নতি আর অগ্রগতির চিত্র দেখাইনা কেন সকলি হবে অনর্থক। অনেকেই আফসোস করে বুকচেঁপে বলবে ‘পানি ভাতে নুন মিলেনা আলু ভর্তায় ঘি’! নিজে বাঁচলেই না বাপের নাম।