নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের সিদ্ধান্ত এ কেমন সিদ্ধান্ত

Eid__ul__azha_342এহসান নি মুজাহির: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ দূষণের অজুহাতে নির্ধারিত স্থানে কুরবানির পশু জবাই এবং রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহর নির্দেশিত মহান ইবাদত ‘কুরবানি’ বন্ধের ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ। এ সিদ্ধান্ত মূলত কুরবানির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত থেকে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণকে বিরত বরাখার সুগভীর চক্রান্ত। সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ঠ স্থানে কুরবানির পশু জবাইয়ের নির্দেশনা দেশের ধর্মভিরু মুসলমাদেরকে চরম দুর্ভোগ এবং হয়রানির মাঝে ফেলেছে। এ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে এমন সিদ্ধান্ত ইসলাম বিদ্বেষীদের খুশি করা ছাড়া আর কল্যাণর কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের কোটি কোটি ঈমানদার জনগণকে সরকারি এ সিদ্ধান্তের কারণে কুরবানির পশু জবাই করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তবে ইসলামবিরোধী মহল তথা তাগুতী শক্তিরা শয়তানের সাথে খিলখিলিয়ে হাসছে! যেদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, যে দেশের প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী থেকে নিয়ে সংসদের অধিকাংশ সদস্যরা মুসলমান এ দেশেই আইন করেছ আল্লাহর নির্দেশ কুরবানির পশু জবাই করতে দেশের দ্বীনদার মুসলিম জনগণকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পেরেশান ও দুঃশ্চিন্তা ফেলে দেয়া হচ্ছে মুসলিম জনগণকে।
শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে আসন্ন ঈদুল আজহায় রাজধানীসহ সারা দেশের সবগুলো সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে কুরবানির পশু জবাই করার নির্দেশ জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত গত ২৭ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ভারপ্রাপ্ত সচিব আব্দুল মালেক এ সিদ্ধান্ত জানান।
কুরবানির পশু জবাই নিয়ে উদ্বেগ ও চরম দুভোর্গে পড়েছেন আল্লহভীরু মুসলমানগণ। কওয়া নেই, বলা নেই, আলেম-ওলামা, দ্বীনদার বুদ্ধিজীবদের সাথে পরামর্শ নেই। হঠাৎ করেই সরকারিভাবে এহেন সিদ্ধান্ত তা দেশের দ্বীনদার জনগণ কখনো মেনে নিতে পারেন না। মুসলমানদের কুরবানি নিয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত সরকারের জন্যও ভালো ফল বয়ে আনার সম্ভাবনা নেই। কুরবানির পশু জবাই এবং রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে দেশের দ্বীনদার জনগণ, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামী নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে দিয়ে বিবৃতি দিয়ে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে। বিবৃতিতে আলেম-ওলামা ও ইসলামী নেতৃবৃন্দগণ বলেছেন, ইসলাম বিদ্বেষীদের পরামর্শে একই স্থানে কুরবানী দেয়ার হঠকারি সিদ্ধান্ত জারি করা হলে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর চরম আঘাত আসবে। নির্ধারিত স্থানে কুরবানী দেয়ার কান্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। নির্ধারিত স্থানে কুরবানী দেয়ামানে হকেুরবারি ঐতিহ্যকে ভুলন্ঠিত করা!
প্রশ্ন হচ্ছে সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আসলেই এটি কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং দেশের মুসলমানদের জন্য কতটুকু মঙ্গলজনক এ ব্যাপারে দেশের আলেম-ওলামা এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারতো। কিন্তু এটি তারা প্রয়োজনবোধ করেনি। সরকার মুসলমানদের সুবিধা ও কল্যাণের কথা মোটেও ভাবেনি। সরকারের পক্ষ থেকে হটাৎ করে এমন একটি একতরফা সিদ্ধান্ত মুসলমানগণের উপর চাপিয়ে দিলে মুসলমানগণ কিভাবে মানবে? মেনে নেয়া সম্ভবও না। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে শুধু ঢাকা শহরেই ঈদুল আজহার দিন পশু জবাই হবে কমপক্ষে ৩০ লাখ। একেকটি সিটি কর্পোরেশন যদি ৫০০টি করেও মাঠের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে প্রতিটি মাঠে কমপক্ষে ৬০০০ পশু কুরবানি করতে হবে এবং গোশত ও বানাতে হবে। রাজধানী ঢাকায় এমন কোনো মাঠ নেই যেখানে একসাথে ৬০০০ গরু জবাই করা সম্ভব। আর গোশত বানানোর তো প্রশ্নই উঠে না। তারপরও যদি এমন সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। ঢাকায় একসাথে ৩ হাজার গরু জবাই করার মাঠ কয়টা আছে? আচ্ছা তিন হাজার বাদই দিলাম রাজধানীতে ১০০ গরু জবাই করা যাবে এমন মাঠের সংখ্যাও হাতেগোনা কয়েকটি। অধিকাংশ মাঠেই একসাথে সর্বোচ্চ ২০-৩০টি গরু জবাই করা সম্ভব। তাহলে কি করে একদিনে এতগুলো পশু জবাই সম্ভব? ঈদের নামায শেষে সবাই যখন নির্দিষ্ট মাঠে আসতে থাকবে- দেখা যাবে সেখানেই একটি বড়সড় পশুর হাটের মতো জটলার সৃষ্টি হবে। এত বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে সুষ্ঠুভাবে জবাইয়ের যাবতীয় কাজ করা কতটুকু সম্ভব? ১ম দফার কুরবানীতেই যখন মাঠ ভর্তি হয়ে যাবে, তখন বাকি কুরবানিদাতারা কি সিরিয়ালের জন্য মাঠের পাশে তাদের কুরবানির গরু-ছাগল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকবেন? পশু জবাই করেই কি শুধু শেষ! এরপর একেকটি গরুর চামড়া ছিলানো, গোশত কাটা, গোশত ভাগ করা এসবে ৩-৪ জন দক্ষ কসাইয়ের অন্ততপক্ষে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। তাহলে এতক্ষণ সময় বাকি কুরবানিদাদেও অপেক্ষও কি ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না? প্রথমবার জবাইয়ের কাজ শেষ হওয়ার পরই কি সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা পরবর্তী দফার জবাইয়ের জন্য মাঠ পরিষ্কার করবে? পশু জবার পর যাবতীয় কাজ শেষে বাসায় গোশত নিয়ে যাওয়ার জন্য ঈদের দিন পর্যাপ্ত পরিমাণ যানবাহন কি সময়কালে পাওয়া যাবে? কুরবানিদাতার পরিবার ঈদের মুল আনন্দ পশু দেখা, জবাই দেখা, গোশত বানানীতে বাচ্চা মহিলাসহ শরীক হওয়া, গোশত বিতরণ করা, আত্মীয়দের বাসায় সময়মত গোশত পৌছানো এবং ওই দিনের প্রথম খাবার কোরবানীর গোশত দিয়ে খাওয়া, গরীবদের নিরিবিলি গোশত দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ সবের আনন্দ আর সুবিধা থেকে নগরবাসী চরমভাবে বঞ্চিত হবে। এক সাথে হলে বাসায় গোশত আনা-নেয়াসহ চামড়া ছিনতাই, পশু ছিনতাই, গোশত ছিনতাইসহ চাঁদাবাজদের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হবে। সিন্ডিকেট চক্রের কালো থাবায় মাদরাসার এতিম ও মিসকিনরা কুরবানির চামড়া বিক্রির টাকা থেকেও বঞ্চিত হবার আশংকা রয়েছে।
এছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার বাসিন্দাদের সীমাহীন কষ্টে পড়তে হবে। এখন যেরকম কুরবানীর হাটের বাজার নিয়ে দলাদলী, চাঁদাবাজী ও অপ্রীতিকর ঘটনা সংগঠিত হয় তেমনি কুরবানির জায়গা নিয়েও হবে। এতে করে মানুষের গোশত বন্টনসহ নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হবে। গরুর চামড়াগুলো গরীবদের হাতে যাওয়ার পরীবর্তে সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাবে। তাতে দেখা যাবে এত ঝামেলার কারণে মানুষ কুরবানী দিতে বিরক্তি বোধ করবে এবং মুসলমানদের পিতা ইব্রাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) স্মৃতি বিজড়িত কুরবানী যার উপর ওয়াজিব হয়েছে তা পালনে অজুহাত সৃষ্টি হবে। হাজার হাজার কুরবানীর পশু নির্ধারিত স্থানে জবেহ করতে জড়ো করা হলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। উপরোক্ত আলোচনায় মাত্র কয়েকটি সমস্যার কথা উপস্থাপন করা হলো! চৌদ্দশ বছর ধরে সামর্থবান ঈমানদার মুসলমানগণ তাদের নিজস্ব বাসা-বাড়ির আঙ্গিনাসহ বিভিন্ন সড়কে কুরবানির পশু জবেহ করে নিজের পছন্দ মতো গোশত বিতরণ করে আসছেন। অনেকে কুরবানির পশুর চামড়া মাদরাসার লিল্লাহ ফান্ডে দান এবং চামড়া বিক্রির একাংশের টাকা গরীবদের মাঝে বিতরণ করে আসছেন। কিন্তু নতুন করে পশু জবাইয়ের আইন মুসলমানদের চরম দুর্ভোগে ফেলবে।
মুসলমানগণ যুগযুগ ধরে যার যার সুবিধার আলোকে মুসলমানগণ যার যার পছন্দের স্থানে কুরবানির পশু জবাই করে আসছে এত যুগ ধরে কোন সমস্য হয়নি, কিন্তু এবছর হঠাৎ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও কতিপয় পরিবেশবাদীদের এ সমস্ত অযৌক্তিক চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্ত মুসলমানদের উপর জোরে চাপানোর মতলবটা কি? সরকার এবং পরিবেশবীদদের এহেন সিদ্ধান্ত চরম মুর্খতার শামিল। ইতোপূর্বে তো পরিস্কার-পরিছন্ন ও পরিবেশ দূষণের সমস্যা হয়নি। হঠাৎ করে পরিবেশ বিনষ্ট অজুহাত দোহাইয়ের মানেটা খুঁজে বেরা করা দরকার। পরিষ্কার কথা সামর্থবান মুসলমানদের ওয়াজিব বিধান পবিত্র কুরবানি নিয়ে কোন নেতিবাচক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন চান না দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ। সিটি মেয়র নির্বাচনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদ্বয়কে মানুষ ভোট দিয়েছে ঢাকাকে উন্নয়নের নগরী হিসেবে গড়ে তুলার জন্য, কুরবানির পশুর হাট বন্ধ করার জন্য জনগণ তাদের ম্যান্ডেট দেয় হয়নি। এমনটি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও কুরবানির পশুরহাট বন্ধ করার কোন এজেন্ডা ছিল না। কুরবানির পশু জবাইয়ের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত বাতিল করা ঈমানদার জনতার গণদাবি। শেষ কথা, শত শত বছর যাবত যেভাবে এদেশের মুসলমানরা কুরবানি দিয়ে আসছেন সেই প্রথা অনুযায়ীই কুরবানি দেয়ার সুযোগ বহাল রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট