সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজকে বোধহীন ও দেশপ্রেমহীন করা হচ্ছে

Kiranmala-Star-Jalsha-Serial-400x221* রাজধানীর জুরাইনের আলমবাগে দুই সন্তান পাবন ও পায়েলকে নিয়ে ২০১০ সালে আত্মহত্যা করে মা রিতা। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে দায়ী করাসহ মনের নানা ক্ষোভ ও বেদনার কথা লিখে রাখে দেয়ালে। সেই লেখাগুলোর মধ্যেই বলে যায়Ñ কীভাবে ‘ডুবসাঁতার’ নামে একটি ভারতীয় সিনেমা দেখে আত্মহত্যায় আগ্রহী হয় সে (রিতা)।
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাঈদ ২০১১ সালে কারাবন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করে। তার আত্মহত্যার ধরনের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় হলিউডের ‘লাইফ অফ ডেবিড গেল’ সিনেমার।
* ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, ২০১৪ সালে চাঞ্চল্যকর বাচ্চু হত্যাকা-ের আসামি ফাহরিনা মিষ্টি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়- ভারতীয় সিনেমায় হত্যা করার ধরন দেখে বাচ্চুকে হত্যার কৌশল শিখেছিল সে।
* এমনই এক ভারতীয় সিনেমা দেখে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও গৃহিনী মাকে হত্যা করেছিল ঐশী।
* সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে এক তরুণীকে গাড়িতে তুলে পরিচিত ও অপরিচিতজনরা মিলে সম্ভ্রমহরণের যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তার সঙ্গে ভারতে ঘটে যাওয়া একটি কাহিনীর মিল খুঁজে পেয়েছে ডিবি পুলিশ। ওই ঘটনা নিয়ে ভারতের একটি টিভি চ্যানেল (যা বাংলাদেশে দেখা যায়) নাটক প্রচার করেছে। ওই নারীর সম্ভ্রমহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া অপরাধীরা পুলিশকে জানিয়েছে, ওই নাটকটি দেখার পরই তারা এ ধরনের পরিকল্পনা করে।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছে, সহজাত মনোবৃত্তির কারণেই অপরাধবিষয়ক নাটক ও সিনেমা দেখে খারাপই হচ্ছে দর্শকরা। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অপরাধধর্মী বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটক-সিনেমা তৈরি করছে, যা ঘরে বসে দেখছে সবাই। এছাড়া বলিউড ও হলিউডে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধবিষয়ক সিনেমা। অপরাধ কাহিনী বলেই সব বয়সের মানুষের এসব নাটক-সিনেমার প্রতি ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। মানুষ আরো সচেতন হবে- এমন দোহাই দিয়ে এসব নাটক-সিনেমা নির্মাণ করা হলেও বাস্তবে উল্টো ফল হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের কুপ্রভাব আরো বেশি।}
এ ধারাবাহিকতায় গত (২ সেপ্টেম্বর-২০১৫ ঈসায়ী) বুধবার পত্রিকায় হেডিং হয়, “মুক্তিপণের দাবিতে সহপাঠীকে খুন, আটক ৩ ॥
ভারতীয় টিভি চ্যানেলের কুপ্রভাব”
নাটোরে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে তানভীর (১১) নামে এক মাদরাসা ছাত্রকে হত্যার পর আটক করা হয়েছে তার তিন সহপাঠীকে। র‌্যাব-৫-এর সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব আলমের নেতৃত্বে গত ১ সেপ্টেম্বর-২০১৫ ঈসায়ী ইয়াওমুছ ছুলাছা বা (মঙ্গলবার) সকাল ১১টার দিকে শহরের আলাইপুর এলাকার ‘আশরাফুল উলুম কওমী মাদরাসা’র পেছনের একটি সেপটি ট্যাংকি থেকে তানভিরের লাশ উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাব-৫ ও স্থানীয়রা জানায়, শহরের হাফরাস্তা বড়গাছা এলাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম তুষারের একমাত্র ছেলে তানভীর আলাইপুর এলাকার ‘আশরাফুল উলুম কওমী মাদরাসা’য় পড়ালেখা করতো। গত ২৫ আগস্ট-২০১৫ বিকেলে মাদরাসা থেকে বের হয়ে সহপাঠীদের সাথে খেলতে গিয়ে সে নিখোঁজ হয়। রাতে মোবাইলফোনে নিখোঁজ ছাত্রের বাবা সাইফুল ইসলাম তুষারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ ব্যাপারে নিখোঁজ ছাত্রের বাবা নাটোর থানায় জিডি করে ও র‌্যাব-৫-কে জানিয়ে ছেলের খোঁজে কয়েকদিন ধরে শহরে মাইকিং করে। পরে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে র‌্যাব ওই মাদরাসার দুই ছাত্র বায়েজিদ হাসান (১৪) ও হুমাইদ হোসেন (১৫) এবং ওই মাদরাসার সাবেক ছাত্র নাঈমকে (১৫) আটক করে।
আটক বায়েজিদ হাসান বাগাতিপাড়া উপজেলার নওপাড়া গ্রামের বাবুল হাসানের ছেলে, হুমাইদ হোসেন সিংড়া উপজেলার জোর মল্লিকা গ্রামের মোক্তার হোসেনের ছেলে এবং নাঈম নাটোর শহরের কালুর মোড় এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে। ওই তিনজনের দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আলাইপুর এলাকার ‘আশরাফুল উলুম কওমী মাদরাসা’র পেছনের একটি সেপটি ট্যাংক থেকে তানভীরের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
র‌্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব আলম জানায়, আটক তিন কিশোর ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা দেখে উৎসাহিত হয়ে তানভীরকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। আটকের পর তারা র‌্যাবকে জানায়, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ আগস্ট-২০১৫ ঈসায়ী তারিখ বিকেলে মাদরাসার পার্শ্বের একটি পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে গিয়ে তানভীরকে কাপড় দিয়ে গলা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করতে খুর দিয়ে গলা কেটে দেয়। লাশ সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে রেখে প্রাচীর টোপকে নাঈমের দোকানে গিয়ে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত খুর এবং নিজেদের হাত পায়ে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে। পরে ভোররাতে লাশ তাদেরই মাদরাসার কাছের একটি বাড়ির পেছনের সেপটি ট্যাংকে ফেলে গুম করে। এরপরে তারা দুটি নতুন সিম কিনে, যার একটি দিয়ে মুক্তিপণের টাকা গ্রহণের জন্য বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলে এবং অন্যটি দিয়ে তানভীরের বাবার কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের দেনদরবার করে। এক সময় তারা মুক্তিপণের দাবি পাঁচ লাখ টাকা থেকে এক লাখ টাকায় নামিয়ে আনে।
মুক্তিপণের টাকা গ্রহণের কৌশল হিসেবে প্রথমে বিকাশে টাকা পাঠানোর কথা বললেও ঝুঁকি থাকায় চলন্ত ট্রেন থেকে টাকা ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত তানভীরের বাবাকে জানানো হয়। এতেও ঝুঁকি থাকতে পারে মনে করে অপহরণকারীরা কোথাও থেকে বোরকা পরে মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহের কথা জানালে তানভীরের বাবা তার ছেলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার পরেই টাকা দিতে রাজি হয়। এ সময় অপহরনকারীরা বায়োজিদকে তানভীর সাজিয়ে বাবার সাথে কথা বলায়। এ সময় তানভীরের বাবা সাইফুল ইসলাম তুষার বুঝতে পারে এটি তার ছেলের কণ্ঠ নয়। এরই এক পর্যায়ে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে টানা ২২ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে র‌্যাব হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনজনকেই আটক করে তানভীরের লাশ উদ্ধার করে।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা/কৌশল দেখে নাটোরের তিন কিশোর সহপাঠীকে অপহরণ করে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ চাঞ্চ্যল্য সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। এই অভিযানের সময় আরো উপস্থিত ছিলো, নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুনসি শাহাবুদ্দিন, র‌্যাব-৫-এর এএসপি জামাল আল নাছের, নাটোর সদর সার্কেলের এএসপি রফিকুল ইসলাম এবং সদর থানার ওসি মিজানুর রহমান।
উল্লেখ্য, ভারতীয়/হিন্দির কুপ্রভাব নিয়ে শহর-গ্রাম সর্বত্র এখন অভিভাবকরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে ডিশ সংস্কৃতি। অনেকে খুশির বশে ডিশ লাইন নিচ্ছে। অনেকে নিচ্ছে কথিত আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলার জন্য। বাজারে, রাস্তার মোড়ে গড়ে উঠা ক্লাব, সমিতি ও দোকানে নেয়া হচ্ছে ডিশ লাইন। আর সব জায়গায় চলছে ভারতীয়/হিন্দি চ্যানেলের রাজত্ব। ছাত্ররা হচ্ছে পড়া-লেখা বিমুখ। কমছে স্কুল-কলেজে হাজিরার হার। খারাপ হচ্ছে পরীক্ষার রেজাল্ট। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। ভারতীয়/হিন্দির কুপ্রভাবে দশম শ্রেণীর ছাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীকে বিয়ে করার জন্য মায়ের গলায় ছুরি চালায়
সারা বিশ্বে সংখ্যার বিচারে মুশরিক নিয়ন্ত্রিত ভারত এখন খুনের ঘটনায় শীর্ষে রয়েছে। আর সম্ভ্রমহরণে রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ক্রাইম ২২টি অপরাধপ্রবণ দেশের উপর তথ্য সংগ্রহ করে এক একটি প্রতিবেদন করে।
খোদ ভারতীয়তের মাঝে অ্যালকোহল/মদ আসক্তি বৃদ্ধি জন্য এখন দায়ী করা হচ্ছে দেশটির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলিউডকে। বলিউডের ছবিগুলো ভারতীয় যুব সমাজের অ্যালকোহল/মদ আসক্তির অভ্যাসকে সরাসরি ইন্ধন যোগাচ্ছে। দুবাইয়ে কার্ডিওলজি বিষয়ক ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। জরিপে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী (যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬-এর মধ্যে) ইতোমধ্যে অ্যালকোহল/মদ সেবন করছে। মদ সেবনকারীদের মধ্যে যারা বলিউডের সিনেমা দেখেনি তাদের চেয়ে বলিউডের সিনেমা দেখা শিক্ষার্থীদের মাঝে অ্যালকোহল (মদ) সেবনের মাত্রা ২ দশমিক ৭৮গুণ বেশি। হেলথ রিলেটেড ইনফরমেশন ডিসারমিনেশন অ্যাগেইনস্ট ইয়ুথ (এইচআরডিএওয়াই) এর কর্মকর্তা ড. জি.পি নজর বলেছে, এই ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে- ভারতীয় যুবকদের মাঝে মদের বিস্তারে সরাসরি ভূমিকা রাখছে বলিউডের ছবিগুলো।
বাংলাদেশে ভারতীয় হিন্দি নাটক-সিনেমা-সিরিয়ালের ব্যাপক বিস্তার সম্পর্কে বলতে হয়- পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সে সংস্কৃতিও নিয়ন্ত্রণ করে। এটিই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া ডিফিউশন তত্ত্ব অনুযায়ী একটি সংস্কৃতি শক্তিশালী হলে তার প্রভাব আশে-পাশের অঞ্চল বা দেশের উপরও পড়ে থাকে। এ অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এজেন্ট হিসাবে বেছে নিয়েছে ভারতকে। সেজন্য আমরা দেখতে পাই- বিশ্বব্যাংক আইএমএফ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থে এক সুরে কথা বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এসব প্রতিষ্ঠান ও ভারতে গ্যাস রফতানির কথা বলে, ট্রানজিট প্রদানের কথা বলে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের এত তিক্ততা, ট্রানজিট, গ্যাস, করিডোর না দেয়ার দাবি থাকলেও বাংলাদেশে ভারতের হিন্দি/হিন্দু অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের কুপ্রভাব নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।
সাম্রাজ্যবাদীরা এবং তাদের এজেন্টরা বুঝেছে সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষদেরকে দেশের স্বার্থ সম্পর্কে চিন্তা করার বিষয় থেকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের লুন্ঠনের বিরুদ্ধে যাতে মানুষ সচেতন হতে না পারে, প্রতিবাদ করতে না পারে এবং প্রশ্ন করতে না পারে- সেজন্য তাদেরকে কোনো এক নেশাতে মাতিয়ে সবকিছু থেকে ভুলিয়ে রাখা দরকার বলে সাম্রাজ্যবাদীরা মনে করে। তাই তাদের এ নেশা হলো সেক্স। ভারতীয় হিন্দি/হিন্দু অপসংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষকে সেক্সের নেশা খাওয়ানো হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষকে ভোগবাদিতার দিকে উসকে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজকে বোধহীন ও দেশপ্রেমহীন করা হচ্ছে।
ভারত আমাদের শাসকগোষ্ঠীকে মুঠোবন্দি করে রেখেছে হিন্দি/হিন্দু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে। উদ্দ্যেশ্য একটাই বাংলার শক্তিকে খর্ব করা। শাহরুক খানকে তারা প্রমোট করে। কারণ হলো তার মাধ্যমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দি/হিন্দু অপসংস্কৃতিকে গ্রহণযোগ্য করা সহজ। কারণ সে মুসলমান পরিচয়ধারী হওয়ার কারণে এসব দেশের অথর্ব মুসলমানরা তাকে সহজেই গ্রহণ করে নেবে। আর এভাবে তার মাধ্যমে হিন্দি/হিন্দু অপসংস্কৃতিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো সহজ হবে।