প্রাথমিক শিক্ষকদের অবহেলিত জীবন মান, শিক্ষার মানেও প্রভাবিত হচ্ছে

স্বপন তালুকদার

11535802_1607292356184422_71071162321415882_nস্বাধীনতার ৪৫ বছরে বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। কমেছে দারিদ্রের হার, বেড়েছে শিক্ষিতের হার। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহর গুলোর চকচকে গাড়ির বহর আর আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা বলে দেয় দেশের আর্থনৈতিক উন্নতিও হয়েছে অনেকখানি। দারিদ্রের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভাবী মানুষের সংখ্যাও কমে আসছে। বেড়েছে জিডিপি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জমার পরিমানে রেকর্ড করেছে।বেড়েছে মাথাপিছু গড় আয়। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। বিশ্ব ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০১০ এর গবেষনার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষনে দেখা গেছে বাংলাদেশের দারিদ্রের হার ৩১দশমিক৫ শতাংশ। উন্নতি হয়েছ প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন পেশাজীবীর জীবনমানে।কিন্তু বাড়েনি শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান এবং মর্যাদা। আর তারই প্রভাব পড়ছে সার্বিক শিক্ষার মানে। মানব মনের উন্নত বিকাশ সাধন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের একমাত্র ক্ষেত্র শিক্ষা। শিক্ষায় উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করতে শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক মর্যাদা দান জরুরি। যে দেশ শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক মর্যাদা দানে ব্যর্থ, সে দেশ শিক্ষায় সমৃদ্ধি লাভ অসম্ভব। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবিদের টানতে ভালো বেতন ও মর্যাদা দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে কেহ ইচ্ছাকৃত ভাবে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না,নিতান্ত নিরুপায় না হয়ে। আমাদের শিক্ষকদের যে পরিমান সম্মানী দেওয়া হয়, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। শিক্ষকতা পেশা স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও শুধু কাগজে কলমেই সম্মানজনক পেশা হিসাবে বিবেচিত। প্রায়ই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও পদমর্যাদার জন্য আন্দোলন করতে দেখা যায়! ব্রিটিশ আমলের সৈয়দ মুজতবা আলীর পন্ডিত মশাইয়ের সাথে বর্তমান শিক্ষকদের অমিল তেমন একটা নেই!
অথচ শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার ভিত্তি মুজবুতের প্রকৃত কারিগর। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকরা। আর শিক্ষার এই আসল কারিগররাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। সভা সেমিনার সেম্পোজিয়ামে কত কত সম্মানজনক উপাধী প্রাথমিক শিক্ষকদের! শিক্ষা জাতির উন্নতির আসল ক্ষেত্র হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ হতাশাজনক।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধ বিধস্ত দেশে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণই যেখানে রীতিমত দু:সাধ্য, সেখানে বঙ্গবন্ধু সরকার শিক্ষার চাহিদা মেটানোর পদক্ষেপ ছিল অভাবনীয়।বঙ্গবন্ধু জানতেন, শুধু একটি ভু-খন্ড স্বাধীন করাটাই শেষ কথা নয়। প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য চাই এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে না পারলে এ স্বাধীনতা হবে মূল্যহীন। সোনার বাঙলা গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।তাই বঙ্গবন্ধু সরকার সংবিধানে নাগরিকদের কাছে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার সকল শিশুর একক মান সম্পন্ন, গণমুখী, সর্বজনীন অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক শিক্ষা ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে চালু করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার১৯৭২ সালে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক করার পাশাপাশি ১৯৭৩ সালে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করন করেন। পরবর্তিকালে ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী কুদরাত-ই-খুদার যে প্রতিবেদনটি হাতে নেন তাতে শিক্ষাখাতে মোট জিডিপির ৭শতাংশ বিনিয়োগের সুপারিশ করে কমিশন। তখনকার সরকার যুদ্ধ বিধস্ত দেশে জাতীয় বাজেটের ২৫শতাংশ বিনিয়োগ করেন।মোট জিডিপির ২দশমিক৪ শতাংশ। যা ছিল সরকারের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ।বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তি কোন সরকারই শিক্ষাখাতে এতটা বিনিয়োগ দেখাতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের বিগত মেয়াদে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু সাহসী পদক্ষেপ যেমন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রনয়ণ, ২৬হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণসহ প্রাথমিক শিক্ষকদের আপগ্রেড প্রদান সর্ব মহলে প্রশংসিত হলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে কতটা সহায়ক ভুমিকা রাখবে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবছরে জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ। কেননা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষার জন্য কোন দেশের শিক্ষাখাতে মোট জিডিপির ৬দশমিক ৬শতাংশ বিনিয়োগ করা দরকার। কিন্তু আমাদের শিক্ষাখাতে বর্তমান বিনিয়োগ ২ শতাংশ। যা জাতীয় বাজেটের১১ শতাংশের কিছুটা বেশি। আন্তর্জাতিক মানদন্ডের তিনভাগেরএক ভাগ! উন্নত বিশ্বের নয়,আমরা যদি এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকাই প্রায় প্রতিটা দেশেরই শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পাই। ভারতের শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ জিডিপির ৩দশমিক ৭শতাংশ, নেপালের ৩ দশমিক৮শতাংশ। এমন কি পাকিস্থান যাদের আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে মনে করি, তাদের শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ ২ দশমিক ৯শতাংশ। আফ্রিকার অনেক দেশ তানঞ্জিয়া, লেথেসা, ট্যাগো, বুরুন্ডিও আমাদের চেয়ে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগের পরিমান বেশি। এইসব দেশের শিক্ষকদের বেতন ভাতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি।সম্প্রতি ভিয়েতনামের মতো দেশ মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষা বিনিয়োগের পরিমান ৬দশমিক ৬শতাংশে বৃদ্ধি করে নিয়েছে।অথচ ঐসব দেশের চেয়ে আমাদের জিডিপির আকার অনেক বড়। বছরের পর বছর শিক্ষাখাতের বিনিয়োগ কমতে কমতে জাতীয়ে বাজেটের ১১শতাংশে নেমে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়
Assasuni-Photo-1-23.09.2014শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ালে, দেশ দেউলিয়া হওয়ার ঝুকিতে পড়বে!বুদ্ধিজীবীসহ শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, শিক্ষায় বিনিয়োগই শ্রেষ্ঠ বিনিযোগ। বিভিন্ন শিক্ষা সেমিনারে শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুপারিশ করছেন বিশেষজ্ঞ জনেরা।শিক্ষাই পারে উন্নত জাতি,উন্নত মননশীলতার অধিকারি মানবসম্পদ গড়ে তুলতে, এই ধ্রুব সত্যটি অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। কোন দেশ বা জাতির সার্বিক উন্নয়নও সম্ভব নয় মান সম্পন্ন শিক্ষা ব্যতিত। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের জন্য তো বিষয়টা আরও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠার কথা ছিলনা। যা দশ বছর আগেও শিক্ষার মান নিয়ে এতটা হতাশাজনক তথ্য প্রকাশিত হয়নি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষার মানে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করাহয়। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভালো করে বাংলা রিডিং পড়তে পারে না। যেখানে আন্তর্জাতিক রিডিং স্কেল মিনিটে ৪৫-৬০ শব্দ। সেখানে ৬০শতাংশ শিক্ষার্থীর রিডিং স্কেল ১৬-৩২ টি শব্দ এর নিচে! নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের অবস্থাও আশাব্যঞ্জক নয়। যদিও আমাদের পাবলিক পরীক্ষা গুলোর উচ্চ পাশের হার শিক্ষার মান এতটা নিম্ন তা প্রকাশ করে না।আমাদের উচ্চ শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন। উচ্চ শিক্ষায় মানের ক্রমাবনতি হওয়ার কথা ছিল না।কারন উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নিজের জীবন মান সম্পর্কে অনেকটা সচেতন প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের চেয়ে।প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের তৈরিতে ঘাটতির জন্যই উচ্চ শিক্ষার মানে প্রভাব পড়ছে,তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অতিসম্প্রতি যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচইর) শিক্ষার মান ও গবেষনাসহ ২০১৫ সালের জরিপে এশিয়ার ১০০টি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও জায়গা করে নিতে পারেনি। এখানে চীন ও জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিক্য। সেই সঙ্গে ভারতের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। শুধু টিএইচইর জরিপই নয়, সাংহাইভিত্তিক একাডেমিক র্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বিশ্বের এক হাজার দুইশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই করে যে তালিকা দিযেছে, তাতেও বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি। এছাড়া ২০১৩ সালে কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংয়ে তিনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা পেয়েছে, আমাদের সরকারি-বেসরকারি শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় মাঝে। এ তালিকায় ভারতের ১১ টি এবং পাকিস্থানেরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্বের সেরা তালিকায় নাম না থাকা শুধু দু:খজনকই নয়, লজ্জাজনকও বটে। আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের উপরের দিকে নিয়ে যেতে চাই, জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরের কথা বলি, অথচ জনসম্পদ িৈতরর প্রতিষ্টানের প্রতি ক্রমাগত অবহেলা করে আসছি। এভাবে কি সার্বিক উন্নতি সম্ভব? যেসব দেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে প্রভূত উন্নতি করছে তারা শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে স্থান করে নিয়েছিল। এখন এইসব প্রতিষ্ঠান সেই স্থান ধরে রাখতে পারছে না কেন? স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন শোনতে একটু খারাপ লাগে বৈকি?আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয় কি! কেন আমরা আমাদের শিক্ষার মানে উন্নয়ন ঘটাতে পারছি না? ইদানিং কালে শিক্ষার কাঙ্খিত মান অর্জিত হচ্ছে না, তার সবগুলো তির শিক্ষকদের দিকে ছুড়ে দায়মুক্ত হচ্ছেন সবাই। শিক্ষকরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নিচ্ছেন না,চাকুরি করছেন, আন্তরিক নন। কথাটি একেবারেভিত্তিহীন বা অমুলক নয়। তবে শিক্ষক সংকট, শিক্ষার্থী সংখ্যা বিষয় গুলোও বিবেচনা যোগ্য।প্রতিদিন একজন প্রাথমিক শিক্ষককে ৬টা থেকে ৮টা কাশ নিতে হয়।পাঁচ থেকে এগার বছর বয়সীদের সকাল নয়টা থেকে সাড়ে চারটা, এতটা সময় মনযোগ সহকারে মানসম্মত শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ কতটা সম্ভব? আর বিদ্যালয় বহির্ভূত কাজ তো আছেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষকদের অবহেলিত জীবনযাত্রার মান। ভাবা উচিত শিক্ষকরা কতটা নির্ভার দু:শ্চিন্তা মুক্ত হয়ে শ্রেণি কক্ষে প্রবেশ করছেন? সারাক্ষণ অর্থনৈতিক টানপোড়ন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে কতটা মনোনিবেশ করবেন!

পরিশেষে এইটুকুই বলবো, শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন করা সময়ের দাবি। এই দাবি মেটাতে, মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে, শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আনতে এবং মেধাবীদের ধরে রাখতে জন প্রশাসন খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং শিক্ষকতা পেশায় ভালো বেতন ও মর্যাদা দিয়ে ধরে রাখতে হবে মেধাবীদের। সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে প্রাথমিক স্তরে।