বন্দীদশার রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন সালাহউদ্দিন
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে আটক বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এখন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে চিকিৎসাধীন। সেখানকার নর্থ ইস্টার্ন ইন্দিরা গান্ধী রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড মেডিকেল সায়েন্স (নেগ্রিমস)
হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকার উত্তরা থেকে রহস্যময় নিখোঁজের ৬১ দিন পর শিলংয়ে তার খোঁজ মেলে। কিন্তু তার এই নিখোঁজ নিয়ে এখনো কাটছে না ধোঁয়াশা। এই ৬১ দিন তিনি আসলে কোথায়, কিভাবে ছিলেন- এ নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্নের। রহস্যের জালে আটকে আছে তার নিখোঁজ হওয়ার দিনগুলো। রহস্যের জট খুলতে এবং তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে গতকাল রবিবার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় একটি জাতীয় দৈনিকের।
ভাতিজা সাফওয়ানুল করিমের মুঠোফোনের মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমি নিখোঁজ নই, অপহৃত হয়েছিলাম। ১০ মার্চ ঢাকার উত্তরার যে বাসায় আমি ছিলাম ওই বাসার লাইট হঠাৎ করে নিভে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে কয়েকজন যুবক। তারা আমার চোখ ও মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেয়। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে একটি ঘরে। ঘরের একটি রুমে আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত-পা ও চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। রুমটিতে প্রবেশের একটিমাত্র দরজা ছিল, সঙ্গে এটাচ বাথরুম। রুমের ভিতর আসবাবপত্র বলতে একটি খাট, মাথার উপরে ছিল বৈদ্যুতিক পাখা। ওই রুমে আমাকে রেখে যুবকরা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। ওই বাসায় আমাকে ৬১ দিন আটকে রাখা হয়। আমাকে নিয়মিত খাবার ও ওষুধ দিয়ে যাওয়া হতো। যারা খাবার ও ওষুধ নিয়ে আসত তাদের কেউই আমার সঙ্গে কথা বলত না। আমিও ভয়ে তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতাম না।’
যে ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল সেটি কোথায় তা আন্দাজ করতে পেরেছেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উত্তরার বাসা থেকে অপহরণের সময় আমাকে চোখ, কান ও হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। আর ওই ঘরটিতে বন্দী করার পর বাঁধন খুলে দেওয়া হয়, তাই বাড়িটির অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার।’
বন্দীজীবনের স্মৃতিচারণ করে সালাহউদ্দিন বলেন, “বন্দীদশা থেকে কোনো দিন মুক্তি পাব, প্রাণ নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের কাছে ফিরতে পারব, এমনটা মনে হয়নি কখনো। জীবনের শেষ দিনগুলো মনে করে আমি প্রতিদিন কত রাকাত নফল নামাজ পড়তাম তার হিসাব নেই। রাত-দিন ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইনি্ন কুনতুম মিনাজ জোয়ালিমিন’ দোয়া পড়তাম।” সালাহউদ্দিন বলেন, ‘রাতে ঘুমালেই মনে হতো, মা আমার শিয়রের পাশে বসা। তিনি আলতো করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সব সময় বাবা-মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্দীয়স্বজন, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) ও দলের লোকজনের কথা মনে পড়ত। তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্ট হতো।’ প্রায় ১৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারের এ পর্যায়ে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেন সালাহউদ্দিন। এ প্রতিবেদককে ফোনে হোল্ড করতে বলে পানি পান করে নেন। এরপর বলতে থাকেন তার শিলংয়ে উপস্থিতির বর্ণনা। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘যে ঘরে আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল ওই ঘরে আবারও আমার হাত-পা, চোখ ও কান বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। তখন আমার মনে হয়েছে খুন করার জন্য হয়তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে নিয়ে চার ঘণ্টা না ১০-১২ ঘণ্টা ড্রাইভ করা হয়েছে তা ঠিক অনুমান করতে পারিনি। তবে রাস্তায় একবার গাড়ি বদল করা হয়। রাতের অাঁধারে আমাকে একটি খোলা জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। খুলে দেওয়া হয় হাত ও পায়ের বাঁধন। ভয়ে আমার বুক কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাকে শুট করা হবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনি। এরপরও আতঙ্ক কাটছিল না। নিজের ভিতর শক্তি সঞ্চয় করে চোখের বাঁধন খুলি, চারদিকে অন্ধকার দেখতে পাই। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পথচারীকে দেখতে পেয়ে তাদের জিজ্ঞেস করি আমার অবস্থান সম্পর্কে। তারা জানায় আমি ভারতের শিলংয়ে অবস্থান করছি। আমি তাদের অনুরোধ করি পুলিশে খবর দিতে। এরপর পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়।’ শিলংয়ের গলফ লিংক থেকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘পুলিশকে আমার পরিচয় দেই। বলি, আমি বাংলাদেশের সিনিয়র রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী ও এমপি। তারা আমার কথা বিশ্বাস না করে আমাকে পাগলভাবে। আমাকে পাঠিয়ে দেয় মেন্টাল হাসপাতালে। চিকিৎসক আমাকে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর চিকিৎসক আমার ব্যাপারে নিশ্চিত হন। এরপর আমাকে শিলং হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।’ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘বন্দী অবস্থায় আমি খুব বেশি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছি। এখনো এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। দুঃস্বপ্ন এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ঘুমালেই দেখতে পাই আমাকে হাত-পা বেঁধে একদল লোক জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আমাকে খুন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই স্বপ্ন দেখে আমি এখনো ভয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি।’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাধ্যমে তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়ার পাশাপাশি তার সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ থেকে যেসব সাংবাদিক ভারতে গিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন সালাহউদ্দিন।
হাসপাতালের ডেপুটি সুপার ডা. ভাস্কর জানান, গতকাল সকাল ১০টায় চার সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা সালাউদ্দিনকে দেখে গেছেন। তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। হাসপাতালে সালাহউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের করা আবেদনের কোনো জবাব দেওয়া হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামীকাল (আজ সোমবার) পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে হাসপাতালে পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেওয়া হবে, নাকি তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। পুলিশ সুপার বিবেক সিয়েম জানান, সালাহউদ্দিনকে আদালতে তোলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেলেই তাকে সদর থানায় নিয়ে আসা হবে। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে আদালতে হাজির করে সাত থেকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানাবেন।