বাদশা ভাই:সালাম : আব্দুল আজিজ তকি
একটা আইরিশ কবরের মাথায় দাঁড় করানো শেত পাথরে লেখা একটা উক্তি ছিল ‘ Death leaves a heartache no one can heal, love leaves a memory no one can steal Õ’। (হৃদয়ে গাথা মৃত্যু বেদনা সারাতে পারেনা কেউ, ভালবাসার স্মৃতিটাও হয়না চুরি কভু)। আজকের এই লেখাটি লিখতে কেন জানি সেই কথাটিই আমার স¥রণে বার বার আসছে। একটা মৃত্যু শোক এর বেদনা আর স্মৃতি মন্থনে এক্ষুনি নিজেই মুহ্যমান। এমন একজন মানুষের কফিন দেখলাম যে মানুষটিকে নিয়ে লিখতে গেলে চোখে জ্বল আসে, বুকে বেদনা বাড়ে। তারপরও তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে চাই।
আমাদের থেকে চলে গেলেন একজন অমায়িক মানুষ , একজন বন্ধু, একজন দেশ প্রেমিক, একজন ভাল মানুষ, একজন বড় ভাই। একজন অতি কাছের আপনজনের কথা বলছি,একজন বাদশা (আমিনুল হক) ভাইয়ের কথা বলছি। ছোট বড় প্রায় সকলের চেনা জানা লোক। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লেখালেখির ধারেপাছে যাদের আনাগোনা তারাতো চিনবেনই, আমার মত অনেক গোবেট মুর্খেরও অতি পরিচিত জন। এই লন্ডনে এসেই আমার সাথে তাঁর পরিচয় অথবা তাঁর সাথে আমার সৌহার্দ্ধ। সেই আর কত দিন; পঁচিশ বছর। সম বয়সি নয়, সমকালিনও নয়। যে ভাবে উচ্চতায় তার বগলের নীচে আমার উচ্চতার মাপ, তেমনি বয়সের দিগ থেকেও বুক বরাবর। তিনি যখন প্রাইমারি পেরিয়েছেন তখনি আমার জন্ম। তারপরও আমরা বন্ধু, আমরা ভাই ,আমরা হৃদয়ের অতি কাছের।
লালনের দেশ কুষ্টিয়াতে জন্ম। ঢাকায় পড়াশোনা, চাকরি বাকরি, রাজনীতি, ছাত্র আন্দোলন, ৭১ সালের মুক্তি আন্দোলন। আমার দেখা একেবারে অনাড়ম্বর, সাদাসিধে জীবন। হাসিমাখা মুখ, সুললীত কথাবার্তা। আপন করে কাছে টানার অপূর্ব শক্তি। রাগ গোসা আমি দেখি নাই, কটুকথা বলতেও শুনি নাই। কেউ রাগ করলেও বিরাগভাজন হওয়ার সুযোগ দেন নাই। আমার দেখা এই মানুষটির কথা আমি বলছি। কোন হুতাশা ছিল কিনা জানিনা কারণ হুতাশাগ্রস্থ হতে দেখি নাই। কোন উচ্চকাঙ্খা ছিলকিনা জানিনা, কারণ উচ্চ নিঃশ্বাষ ছাড়তে দেখি নাই। বিলাসি প্রবন ছিলেন কিনা জানিনা কারন বিলাস প্রবনতা পরিলক্ষিত হয় নাই। কোন অশান্তি ছিল কিনা বুঝতে পারি নাই কারণ অশান্ত মন নিয়ে চলতে দেখি নাই।
এই মানুষটির জানাজা আজ (শুক্রবার ১৩ই ফেব্রুয়ারী ২০১৫) পড়লাম। মুখের দিগে থাকালাম। ঘুমিয়ে আছে। একবারে শান্তশিষ্ট একটা সুবোদ বালক। অথচ ১০ জানুয়ারী অরপিংটন হসপিটেলে দেখতে গিয়েও দেখেছি হাসিভরা মুখ। তাঁর মুখের সেই হাসিটা যে সেদিন আমার দেখা শেষ হাসি হবে সেকি জানতাম। নিশ্চয় কাজী ভাইও (খলিল কাজী- ও বি ই) সেদিনটির কথা স্মরণ রাখবেন। আমরা দু’জনেই ফটো তুলেছি। আলাপ করেছি।এই মানুষটি যে কত জানা অজানা কাহিনীর স্বাক্ষী ছিল অনেকে জানি, আবার অনেকে হয়তো জানিনা। অনেক সময় তাঁর লেখালেখিতে সেটা ধরা পড়েছে কিন্তু অনেক কিছুই তার স্মৃতিতে রয়ে গেছে। তাঁর জীবনে ছিল অনেক ছড়াই উৎরাই, সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্না, রোগ-শোক এমনকি গাড়ি দূর্ঘটনা। তারপরও অসীম মনোবল নিয়ে চলতেন। জীবনের শেষ বছরখানেক তিনি কাটিয়েছেন হসপিটেলে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি বাদশা ভাই কিন্তু এতকিছুর পরও স্মৃতি হারাননি, মনোবল ছাড়েননি, মুখের হাসি ম্লান হয়নি। বন্ধুজনদের হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বরন করেছেন। শেষের দিকে স্পস্ট করে কথা বলতে পারতেন না তারপরও আকার ইঙ্গিতে, মাথা নেড়ে অনেক কিছু বুঝাতে পারতেন। না বলতে পারলেও কানভরে কথা শোনতেন। আমি আর কাজীভাই যখন কাছে বসে কথা বলছি, মাথা নাড়াচ্ছেন, দু’ এক টুকরো কথাও বলছেন, দাঁত বের করে হাসছেন।
আমি জানতামনা যে এই বাদশা ভাই সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের বন্ধু ছিলেন। সিরাজুদ্দিন হোসেন ছিলেন ইত্তেফাক এর সাংবাদিক এবং বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ। ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সিরাজুদ্দিন হোসেনকে একটা নির্বাচনি ইসতেহার লেখার কথা বলেছিলেন। বাদশাহ ভাই তখন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি। তিনি সিরাজদ্দুন সাহেবের কাছ থেকে বার বার তাগাদা দিয়ে সেটা আদায় করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে সেটা প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ নাম ছিল ‘জনসাধারণের প্রতি শেখ মুজিবের আহবান’ (‘Sheikh Mujibur Rahman’s appeal to the people.’) আমি যখন বাদশা ভাই এর কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছি তিনি দু’বার মাথা নেড়ে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এমনতর আরো কত ঘটনার স্বাক্ষী ছিলেন বাদশা ভাই। তাঁর তিরোধান আমাদের এমন সব কত অজানা কাহিনী থেকে বঞ্চিত করলো।
বাদশা ভাই অজাতশত্রু ছিলেন কিনা বলতে চাইনা তবে যে একজন নিরহঙ্কার, দেমাগহীন, নির্লোভ, নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তা’ নির্ধিদায় বরতে পারি। কারণ যে অবস্থানে তিনি ছিলেন সেখান থেকে মোটা পদ পদবী, টাকার পাহাড় গড়ার অনেক সুযোগ ছিল কিন্তু কিছুই করেননি। আমরণ আওয়ামী ঘরনার ভিতরের একজন নিরলস, নীরব কর্মী ছিলেন। মুক্তি যুদ্ধের একজন প্রথম সারির কর্মী এবং খাঁটি দেশ প্রেমিক ছিলেন বলেই নিজের নীতির কাছে কখনো নতি স্বীকার করেননি এবং এটাই তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় ‘পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন কথা সব চেয়ে গভীর ক্রন্দন- যেতে নাহি দেব, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’। চিরাচরিত নিয়মে বাদশা ভাই চলে গেলেন, তাঁ’কে বিদায় দিতে হল। কাজী ভাইয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান খান নুনু ভাই, আমান উদ্দিন ভাই, মাহবুব ভাই, গৌছ সুলতান ভাই, শাহ এনাম ভাই, আজিজ কামাল ভাই ,লোকমান ভাই কফিনের সামনে দাড়িয়ে স্যালুট করে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন। আমার চোখে ভাসলো ১০ জানুয়ারীতে বাদশা ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহুর্তটি। এত অসুস্থার ভিতর থেকেও হাসিমুখে হাতটা উচিয়ে আমাদেরকে স্যালুট করেছিলেন। জানতামনা এইটাই যে আমাদের প্রতি তার শেষ হাসি, শেষ সালাম। বলতে ইচ্ছে করছে- বাদশা ভাই
you probably looking down
from heavenly up above,
sending out smiles with days of sunshine
and showers of love.
তোমাকে সালাম।