আমরা বাংলাদেশে শান্তি চাই : ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেনে প্রবাসীরা

press conference pic press club dhaka 15-02-2015সহিংসতার পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে চলমান সংকটের সমাধান করতে দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রবাসীরা। ঢাকায় অবস্থানরত প্রবাসীদের এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবে রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানান প্রবাসীরা। এসময় তারা বলেন, দুনিয়ার কোনো সমাজে এরকম নিকৃষ্ট রাজনৈতিক অনাচার আছে বলে আমাদের মনে হয়না।আমরা কোনো দেশে এরকম দেখিও নাই।প্রবাসী বাঙ্গালী কল্যাণ সমিতি (প্রবাকস) নামের প্রবাসীদের একটি সংগঠন এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সাধারন সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী দেওয়ান বজলু চৌধুরী।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পর্তুগাল প্রবাসী রানা তাসলিম উদ্দিন। এসময় তিনি বলেন, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আমরা প্রবাসী হয়েছি। স্বজনহীন প্রবাস জীবন মোটেই আনন্দের নয়। তবুও আমরা প্রবাসী। আয়-রোজগার যা করি বেশীর ভাগ টাকাই দেশে পাঠাই। প্রবাসীদের রেমিটেন্সে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। বিশ্বজুড়ে মন্দা চললেও বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন তারা বেশ গর্ব করে বলেন- ‘প্রবাসীদের টাকায় বাংলাদেশ চলে’। বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কখনো এ বিষয়ে দ্বিমত করেননি। অর্থনীতিবিদ, এনজিও, ব্যবসায়ী সমাজ, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক সমাজ, সাধারণ মানুষ সবাই স্বীকার করেন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রবাসীদের রেমিটেন্স অনেক বড় ভূমিকা রাখছে।
রানা তাসলিম উদ্দিন বলেন, আমরা প্রবাসে যে যত দূরেই থাকি না কেন মনটা সব সময় পড়ে থাকে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এই বাংলাদেশে। সাত সমূদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে সব সময় প্রার্থনা করি আত্মীয় স্বজন ভাল থাকুক,দেশটা ভালো থাকুক, দেশের মানুষ ভালো থাকুক,দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় দেশ ভালো নেই। স্বাধীতার পর ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের পর অন্যান্য স্বাধীন দেশের মতো উন্নত জীবন পাইনি। স্বাধীনতার পর থেকেই নানান ইস্যুতে একের পর এক অশান্তি লেগেই আছে।
হরতাল,অবরোধ,সহিংসতায় গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে যে তান্ডব চলছে তা নিয়ে আমরা প্রবাসীরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য, ইউরোপ,মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নাশকতার প্রতিবাদ শুরু থেকেই জানিয়ে আসছে। দুনিয়ার কোনো সমাজে এরকম নিকৃষ্ট রাজনৈতিক অনাচার আছে বলে আমাদের মনে হয়না এবং আমরা কোনো দেশে দেখিও নাই।
প্রবাসীরাবলেন,বাংলাদেশ নানান কারণে এখন বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান পায়। টেস্ট,ওয়ানডে,টিটুয়েন্টি তিন ফরমেটেই বিশ্বেরএক নম্বর অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তিনিসহপুরোবাংলাদেশক্রিকেটদলএখন বিশ্বকাপ মিশনে অষ্ট্রেলিয়া। তাদেরকে যদি কেউপ্রশ্ন করে তোমাদের দেশে এতো হরতাল কেন হয়, গাড়িতে পেট্রোল বোমা কেন মারে তিনি কী জবাবদেবেন?
তিনি বলেন, বিদেশে আমরাও ভীষণ বিব্রত হই। এখানে আমরা দু’জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছি। আমি পর্তুগাল প্রবাসী লিজবনের নির্বাচিত কাউন্সিলর রানা তাসলিম উদ্দিন আমার পাশে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজারসির হেলডন সিটির কমিশনার দেওয়ান বজলু চৌধুরী । শুধু আমরা দুজনই নয়। ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়ায় আরো কমপক্ষে দুই ডজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন। আপনারা জানেন যুক্তরাজ্যে রুশনারা আলী নামে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত আমাদের এক বোন গত নির্বাচনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছেন। যুক্তরাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে তিনিসহ আরো অন্তত সাতজন বাংলাদেশি প্রার্থী আছেন। এবারের যুক্তরাজ্যের সংসদ নির্বাচনে অন্তত ৩/৪জনের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
রানা তাসলিম উদ্দিন বলেন, সারা বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। সেই লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে আমরা সবাই কাজ করছি। আমাদের প্রাইভেট সেক্টরকে সেই পরিবেশ দিতে হবে। আমরা প্রবাসীরা অনেকে দেশে বিনিয়োগ করেছি। আরো অনেকে বিনিয়োগ করতে চান। বিদেশিদেরকেও নিয়ে আসতে চাই। কিন্তু দেশে যদি শান্তি না থাকে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ না থাকে, বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ না থাকে, তাহলে বিনিয়োগের টাকা ব্যাংক লোনের কিস্তি শোধের উপায় কী? দেশে যে অবস্থা চলছে তা এখনি থামাতে হবে। আমরা দেশে শান্তি চাই। কীভাবে শান্তি ফিরে আসবে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এদেশের রাজনীতিবিদদের। আমাদের পোশাক শিল্প, পর্যটন শিল্প, আবাসন শিল্প, শেয়ার বাজার, প্রাইভেট ইউনিভারসিটি, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ, ব্যাংকিং খাত, পরিবহন খাতসহ ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব সেক্টরে প্রবাসীদের কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। আমাদের বিনিয়োগের টাকার গ্যারান্টি না দিলে আমরা কেন বিনিয়োগ করবো?
এই হরতাল-অবরোধের মধ্যেও আমাদের প্রবাসী বাঙ্গালি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী দেওয়ান বজলু চৌধুরী দুদিনের জন্য বিমানে কক্সবাজার গেছেন। সেখানে শত শত হোটেল, কিন্তু কোন পযর্টক নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিরাপদে ফিরে আসার কোনো গ্যারান্টি না থাকলে মানুষ বেরোবে কেন? এই বছর শীতের সময়ে আমাদের যে সমস্ত প্রবাসীরা দেশে এসেছেন তারা অনেকে নিরাপত্তার অভাবের কারণে গ্রামে আত্মীয় স্বজনকে না দেখেই আবার বিদেশে ফিরে গেছেন। পরিস্থিতি এতো জঘন্য যে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি তো দূরের কথা নিজের বাড়ি যাওয়াও কঠিন। আজ আমরা যখন কথা বলছি- লাগাতার অবরোধের মধ্যেই কথা বলছি, তার ওপর আজ থেকে আবারো টানা ৭২ ঘন্টার হরতাল চলছে সারাদেশে।
আমাদের পর্যটন খাতে এবার মারাত্মক রকমের ধ্বস নেমেছে। আমাদের দেশে হাজারো পর্যটক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটক আসার সময় এখনই। টুরিজমের মৌসুমে ট্যুরিস্ট না আসায় দেশের যে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হলো তা পুষিয়ে নেয়া অসম্ভব। গত ৪০দিনে নাশকতায় যাদের প্রাণহানি হয়েছে তাদের ফিরিয়ে দেয়াও অসম্ভব। যারা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন তারাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেননা। কিন্তু যারা সুস্থ-অক্ষত আছেন তাদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার উপায় আছে। তাদের বাঁচাতে রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার। সরকারি দল, বিরোধীদল এবং অন্যসব দলের প্রতি প্রবাসীদের পক্ষ থেকে আমাদের আহবান-আমরা শান্তি চাই।আপনারা জনগনের জন্য দয়া করে সেই ব্যবস্থা করুন।
দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর তিনি ভোটাধিকার বাস্তবায়নের কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রবাসীদের টাকায় দেশ চলে কথাটা বলা হলেও কার্যত আমরা বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থায় কিংবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে যুক্ত থাকতে পারিনা। প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে আন্দোলনের পর বর্তমান সরকার জাতীয় সংসদে একটি আইন পাস করেছে। প্রবাসীরা ভোটার হতে পারবেন এবং ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু কীভাবে ভোটার হবে? ভোটার হতে হলে ঢাকায় আসতে হবে। তাও কোনো ওয়ান ষ্টপ ব্যবস্থা নেই। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এক মাসেও ভোটার আইডি কার্ড হাতে পাওয়া যায়না। যারা অনেক দৌড়ঝাঁপ করে ভোটার হয়েছেন বা জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পেয়েছেন তারা কেউ বিদেশ থেকে ভোট দিতে পারেননা। ভোট দিতে হলে বাংলাদেশে আসতে হবে কেন? বাংলাদেশে যেসব বিদেশি বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেন তারা দূতাবাসের মাধ্যমে ভোট দিতে পারেন। বিশ্বের সব দেশে এই ব্যবস্থায় ভোট নেয়া হয়। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও ভোট গ্রহনের ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই। আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে অনলাইনেও ভোট গ্রহন করা সম্ভব। প্রবাসীদের ভোটার করা ও ভোট গ্রহনের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের কাজ। তারা কয়েকটি দেশ সফর করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন মাত্র। প্রবাসীদের ভোটার করার জন্য আউটসোরসিং পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। ওয়েবসাইটে রেজিষ্ট্রেশন করে দূতাবাসে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া যেতে পারে। প্রবাসীদের ভোটার করা কোনো কঠিন বা অসম্ভব কাজ নয়।দূতাবাসের মাধ্যমে সকল দেশে প্রবাসীদের নিবন্ধন এবং শিগগির প্রবাসীদের ভোটার করার কাজ শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।
এসময় আরো বক্তব্য রাখেন, প্রবাসী বাঙ্গালি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী দেওয়ান বজলু চৌধুরী, প্রবাকাসের অন্যতম উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বুস্তান চৌধুরী ও কানাডা প্রবাসী আহসান হাবিব সুমন। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন এনআরবি নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকমের সম্পাদক অটোয়া প্রবাসী ফারুক সৈয়দ, ওমর আলী, অধ্যাপক ডা: মো: শেখ শহীদ উল্লাহ, পলাশ সরকার প্রমুখ। বিজ্ঞপ্তি