একজন আদর্শ লেখকের প্রতিকৃতি হারুন আকবর : মিজানুর রহমান মিজান
এ বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর বুকে মানুষের আসাÑযাওয়া চলমান। এখানকার জীবন যাত্রা ক্ষণস্থায়ী। ক’দিনের নাইওরী সমতুল। অপরদিকে বলা চলে ট্রেন যেমন ষ্টেশনে থামে স্বল্প সময়ের জন্য যাত্রী উঠানামার নিমিত্তে। কাজ শেষে যাত্রা করে গন্তব্যের দিকে। মানুষের ও স্থায়ী ঠিকানার দিকে যাবার লক্ষ্যে দুনিয়ায় ক’দিন বেড়ানোর নিমিত্তে আসে এবং শেষার্ধে চলে যায় না ফেরার দেশে , চিরস্থায়ী ঠিকানার দিকে। এ পৃথিবীর বুকে বিচরণ কালে মানুষ মানুষের সাথে পরিচিত হয় , সম্পর্কিত হয় কখন কি ভাবে তা বলা বড় কঠিন। আবার মানুষ মানুষকেই ভালবাসে , হৃদ্যতা গড়ে উঠে , আপন করে নেয় অজানা আবেশে , আবেগে। গড়ে উঠে মধুর সম্পর্ক। তবে এক্ষেত্রে ও থাকে নানা প্রকারভেদ। কেউ কাউকে দেখে আকর্ষনবোধ করে। আবার না দেখে তাঁর কর্মকান্ডে ও অনেকে হয় অভিভুত। হৃদয়ের অজান্তে ভালবেসে ফেলে এ ব্যক্তিকে। সৃষ্টি হয় আকর্ষনবোধ , হৃদয়ের তন্ত্রিতে বাজে অমোঘ ভালবাসার ফল্গুধারা। যাক এখানে আমি যা বলতে চাচিছ তা হচেছ আমার এ লেখার মুল উপজীব্য যিনি , তিনি হচেছন আমার শ্রদ্ধেয় লেখক , গবেষক চৌধুরী হারুন আকবর। আমি পল্লী গ্রামের এক নির্জন ও অখ্যাত স্থানে বসবাস করি। জীবন যাত্রার ঘুর্ণিবর্তে বর্তমানে শহরের সহিত যোগাযোগ রক্ষা করা বড় কঠিন নানাবিধ সমস্যায়। যদি ও আমি আশির দশকে সিলেট শহরের সহিত যোগাযোগের ক্ষেত্রে ছিলাম নিয়মিত। অর্থ্যাৎ প্রতিদিন যেতাম লেখাপড়া ও চাকুরীর সুবাদে। সময়ের বিবর্তনে , সাংসারিক কাজে , জীবন জীবিকার তাগিদে , অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অনুপ্রেরণায় আত্মনিয়োগ করায় আশির দশকের মধ্য সময় থেকে হলাম সিলেট শহরের সহিত যোগাযোগ বিচিছন্ন। মানে এÑই মাঝে মধ্যে। প্রয়োজন মাফিক নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত সময় হাতে নিয়ে।
যা বলা প্রয়োজন , তা হচেছ আমি নিয়মিত পত্র পত্রিকা পাঠ করার চেষ্টা করি। এ সুযোগে আমি লেখক , গবেষক চৌধুরী হারুন আকবরের লেখা পাঠ করার সৌভাগ্যে গৌরবান্বিত। কয়েকটি লেখা পাঠ করে আমি হয়ে গেলাম তিনির একজন নগণ্য ভক্ত ও পাঠক। আমার ধ্যান ধারণায় , চিন্তা চেতনায় , মন মগজে জানি না কেন যে বার বার অধীর আগ্রহে উৎসুক ও উৎফুল্লতাবোধ করতাম তিনির লেখা পাঠ করার। তিনির লেখা পেলে পাঠ করতাম মনোযোগ সহকারে। সাধ্যাতীত চেষ্টায় নিমগ্ন হতাম প্রকৃত ও আসল উদ্দেশ্য উদ্ধারে। সেক্ষেত্রে সফল না ব্যর্থ তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব হচেছ না। তবে এটুকু জানি আমি একজন ভক্ত প্রেমিক। ভক্ত প্রেমিক হিসেবে হৃদয়ে ধারন করতাম সাক্ষাৎ লাভের। কিন্তু সময় ও সুযোগ ছিল আমার বরাবর প্রতিকুলে। যে কারনে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলে ও আমার পক্ষে সাক্ষাৎ করা হয়ে পড়ে অসম্ভব। ২০১৩ সালে একদিন সাক্ষাতের প্রত্যাশায় গিয়েছিলাম আম্বরখানা বড় বাজারে। বড় বাজার গলির মুখে ঢুকে পড়েছি এমন সময় মুঠোফোন খবর দিল জরুরী অন্য একটি কাজের। সুতরাং বাধ্য হয়ে বিফল ও ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। মনে মনে ভাবলাম আমার ভাগ্যই নাকি আমার সাথে প্রতারণা করছে। সেদিন থেকে এক প্রকার আশা ছেড়ে দিয়ে পথ চলতেছি। হয়ত আর দেখাই সম্ভব হবে না।
দিন অতিবাহিত হচেছ তার নির্ধারিত নিয়ম নীতিতে। আমি ও চলছি ভাঙ্গা নায়ের মাঝি হয়ে এলোপাতাড়ি নৌকার হাল ধরে। উজান ভাটি আমার নৌকার কোন নিয়ম নীতি নেই। কখন ও উজান , কখন ও ভাটি , কখন ও উজান ভাটির তোয়াক্কা না করে স্থিতাবস্তা। নৌকার হাল হকিকত তাই।
সিলেটে কয়েকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেলে ও যাবার অক্ষমতা আমাকে বঞ্চিত করে বরাবরই। কিন্তু তাবেদার রসুল বকুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের চার পাঁচদিন পূর্বে দাওয়াত পেলাম। মনে মনে ঠিক করে নিলাম এ অনুষ্ঠানে যে কোন উপায়ে যাব। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল কাংখিত দিনটি। রওয়ানা হলাম যথারীতি সে উদ্দেশ্যে। পৌছলাম লামাকাজী। সেখানে একজন সঙ্গী হিসেবে যাকে মনস্থ করেছি , তার অপেক্ষায় অপেক্ষমান। এ দিকে নির্ধারিত সময় হয়ে আসছে। বার বার সময় দেখছি। ঐ ব্যক্তি বলছেন আসছি , এসে গেছি। সময় ও অপেক্ষার বিরক্তিতে সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে যাব বাড়িতে। ঢুকে পড়লাম চা পানের উদ্দেশ্যে হোটেলে। অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে আধা ঘন্টা। এমন সময় হাজির হলেন ঐ ব্যক্তি। এখন তাগাদা রওয়ানা দিতে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম আমার মতামত পাল্টানোর অর্থ্যাৎ না যাবার সিদ্ধান্ত। নিমেষেই তিনির মুখ হয়ে গেল মলিন। দোষী বা দায়ী ভাবলেন নিজেকে। মুহুর্তেই অনুরোধের সুর। ভাবলাম তিনি দু:খ পাবেন। তাই এ সুযোগে সিগারেট পান করছি আর ভাবছি করণীয় সম্পর্কে। পুরোপুরি দোটানায়। শেষ পর্যন্ত আবারো সিদ্ধান্ত পাল্টালাম তিনির মুখ পানে চেয়ে। বিলম্ব হলে ও রওয়ানা দিলাম , না হয় ঘুরে আসব কিছুক্ষণ শহরে যেহেতু বেরিয়ে পড়েছি। উঠলাম গাড়িতে। কিছুদুর এগিয়েই গাড়ির স্টার্ট গেল বন্ধ হয়ে। মিনিট পাঁচেক সময় অতিক্রান্তে ড্রাইভার আবার স্টার্ট দিলেন। অনুমান শ’দুয়েক গজ অতিক্রম করে আবারো ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। মনে এল দারুন হতাশা। ভাগ্য বিপর্যয় নাকি এ ভাবনা। ড্রাইভার অনেক কষ্টে ঠিক করে যাত্রারম্ভ। পৌছলাম আম্বর খানা। দ্রুত চললাম মুসলিম সাহিত্য সংসদ অভিমুখে। ঢুকলাম অভ্যন্তরে। মনে কিঞ্চিৎ আশার আলোর ঝলকানি এল। অর্থ্যাৎ এখন ও আরম্ভ হয়নি দেখে। লক্ষ্য করলাম গভীর ভাবে দেখলাম অনুষ্টানে আগত অতিথিবৃন্দের কয়েকজন সম্মুখ সারিতে বসে আছেন। এগিয়ে গেলাম কবি আসাদ চৌধুরীর দিকে। কোশল বিনিময় শেষে দৃষ্টি গোচরীভুত হল আমার বহু দিনের প্রতিক্ষিত চরম ও পরম শ্রদ্ধাভাজন লেখক চৌধুরী হারুন আকবর সাহেব বসে আছেন প্রথম সারির পূর্ব প্রান্তের চেয়ারে। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত। আমার মন আনন্দের আতিশয্যে ভরে গেল কানায় কানায়। এগিয়ে গেলাম তিনির কাছে। সময় সংক্ষিপ্ত হওয়াতে সংক্ষেপে আলাপ , কোশল বিনিময় করে নিলাম। অনুরোধ জানালাম ফটো উত্তোলন করতে। সানন্দে রাজি হলেন। ঝটপট তোলে নিলাম ফটো। আমার আনন্দ দেখে কে। আমাতেই আমি অভিভুত। তখন থেকে নিজেকে উৎফুল্ল ও চরম আনন্দিত লাগছিল। অনুষ্ঠান শেষের কয়েক মিনিট পূর্বে বেরিয়ে আসি অধিক রাত্রি হলে গাড়ি প্রাপ্তির বিড়ম্বনার সংশয়ে। রওয়ানা হলাম বাড়ি অভিমুখে। আসলাম বাড়িতে। কিন্তু এ রাত্রি আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি যেন অনেক বড় যুদ্ধ জয়ী , বিজিত ব্যক্তি। তারিখটি ছিল বিগত ২৭ শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দ।
সময় অতিক্রান্ত হচেছ তার নির্ধারিত গতিধারায়। তাকে আটকানো বা ধরে রাখা কারোর সাধ্যে নেই বা ভবিষ্যতেও হবে না। হঠাৎ সেদিন নিয়ম মাফিক সিলেটের ডাক পত্রিকাটি পড়ছি। অকস্মাৎ আমার চোখ এক জায়গায় আটকে গেল। সংবাদের অংশটি পাঠ করতে মনোনিবেশ করলাম। পুরো ঘটনাটি পাঠ করে আমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে হাজার মাইল বেগে ঝড় হাওয়া বইতে শুরু করল। কি দেখলাম। বিশ্বাস করতে বড়ড় কষ্ট হচিছল। মনকে প্রবোদ দিলাম। বিধাতার অমোঘ বাণী , নিয়ম খন্ডানোর সাধ্য আমাদের কারো নেই। অর্থ্যাৎ গত ১৫ নভেম্বর ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন লেখক গবেষক চৌধুরী হারুন আকবর সাহেব এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। ( ইন্না ……..রাজিউন )। ক’দিনের ব্যবধান। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বর। আমি একজন নগণ্য ভক্ত হিসেবে মহান করুণাময় আল্লাহর দরবারে তিনির জন্য নিরন্তর দোয়া করি আল্লাহ যেন তিনিকে বেহেশত নসিব করেন। আমিন।
লেখক মিজানুর রহমান মিজান প্রতিষ্টাতা ও পরিচালক চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার , সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসকাব , বিশ্বনাথ , সিলেট। মোবা ০১৭১২ ৮৭৯৫১৬।