কিবরিয়া হত্যা মামলায় মেয়র মেয়র গউস কারাগারে

পুলিশ- বিএনপিসংঘর্ষে ওসিসহ আহত ২০ : পুলিশের গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, গ্রেফতার ৮

Habiganj-G-K-Gausসুরমা টাইমস ডেস্কঃ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার ৪র্থ সম্পূরক চার্জশীটভূক্ত হবিগঞ্জ আসামী পৌরসভার মেয়র, জেলা বিএনপির সেক্রেটারী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ্ব জিকে গউছকে হবিগঞ্জ কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। গতকাল রবিবার জি কে গউছ আদালতে আত্মসমর্পন করলে বিচারক জামিন না-মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরনের নির্দেশ দেন। আত্মসমর্পনের পর জামিন আবেদনের উপর শুনানী শেষে বিচারক রোকেয়া বেগম আলহাজ্ব জিকে গউছকে জেল হাজতে প্রেরনের নির্দেশ দেন। এদিকে জিকে গউছ এর জামিন নামঞ্জুর করাকে কেন্দ্র করে শহরের পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি নাজিম উদ্দিন সহ ২৫/৩০ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ২ জন গুলিবিদ্ধ রয়েছে। সংঘর্ষকালে দোকানপাট, টমটম, রিক্সা সহ যানবাহণ ভাংচুর করা হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেড়শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও ১৪ রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ ৮জনকে আটক করেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার ৪র্থ সম্পূরক চার্জশীটভূক্ত হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ গতকাল হবিগঞ্জ আমল আদালতে হাজির হন। গউছ হাজির হবার সংবাদ পেয়ে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগি সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী কোর্ট প্রাঙ্গনে হাজির হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম ও হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ কোর্ট এলাকায় অবস্থান নেয়।
গউছের আইনজীবী নূর ইসলাম জানান, সকালে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গউছ হবিগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। শুনানি শেষে বিচারক রোকেয়া আক্তার জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে জি গউছের জামিন আবেদন না-মঞ্জুরের প্রতিবাদে কোর্ট প্রাঙ্গণে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি শহরের শায়েস্তানগর এলাকায় গিয়ে যানবাহন ও দোকান পাট ভাংচুর করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশ ও বিএনপি-অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে সংঘর্ষ বাধে। শহরের শায়েস্তানগর, থানামোড়, বেবী ষ্ট্যান্ড ও ফায়ার সার্ভিস এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেড়শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও ১৪ রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি নাজিম উদ্দিন, এসআই আব্দুল লতিফ, পুলিশ সদস্য মতিউর রহমান, আলাউদ্দিন, সুহেল, ইসমাঈলসহ ২০ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ওসি নাজিমসহ গুলিবিদ্ধ ২ জনকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংঘর্ষকালে পুলিশ সংঘর্ষে জড়িত থাকার সন্দেহে ৮ জনকে আটক করেছে।
সহকারী পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম জানান, জিকে গউছকে কারাগারে নেয়ার সময় বিএনপি কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তিনি জানান, বিএনপির হামলায় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এর আগে ২১ ডিসেম্বর এ মামলায় নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক চার্জশিট গ্রহণ করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। হবিগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতের বিচারক রশিদ আহমেদ এই মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল উসজিহাদের নেতা মুফতি হান্নান সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জিকে গউছ, মুফতি সফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মোহাম্মদ আলী, বদরুলসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
২০০৫ সালে চার্জশিট ও ২০১১ সালে দুবার সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়। ওই সময় বাদীপক্ষ নারাজি দিয়ে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিলে আদালত আবারও চার্জশিট প্রদানের নির্দেশ দেয় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। ২০০৫ সালে কলঙ্কজনক এ ঘটনাটি ঘটার পর বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহে বিষয়টি তুমুল সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় তোলে। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের সচেতন মহল কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত দু’টি মামলার ৯ বছরেও বিচারকার্য শুরু না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন হবিগঞ্জ তথা সারা দেশের মানুষ। বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন কিবরিয়া পরিবার।
কিবরিয়া হত্যা : ২০০৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি হবিগঞ্জ গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, তার ভাইপো শাহ মঞ্জুরুল হুদাসহ ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পরদিন দিন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমানে হবিগঞ্জ-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর থানায় ১টি হত্যা ও ১টি বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন। হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও বিস্ফোরক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এম সফিউজ্জামান নিযুক্ত হন। ঘটনার পর সিলেট রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি একেএম মাহফুজুর রহমানকে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির অপর সদস্যরা ছিলেন র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্ট উইংয়ের তৎকালীন পরিচালক লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ (পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহে নিহত), সিআইডির সিলেট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুর রহিম, র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক, মেজর মামুন ও সিআইডির সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান। কমিটি ২০০৫ সালের ১৩ই মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মুহম্মদ ওমর ফারুকের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে। তদন্ত রিপোর্টে কি ছিল তা সে সময় প্রকাশ করা হয়নি।
পরবর্তীকালে হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুন্সি আতিক ৫২ দিন তদন্ত শেষে ২০০৫ সালে ২০শে মার্চ তৎকালীন শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি একেএম আবদুল কাইউম, শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি একেএম আবদুল কাইয়ুম, যুবদল নেতা জয়নাল আবেদীন জালাল, জমির আলী, তাজুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন মুমিন, সাহেদ আলী, সেলিম আহমেদ, আয়াত আলী, মুহিবুর রহমান, কাজল মিয়াসহ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। কিন্তু মামলার বাদী অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ খান আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিট অসম্পন্ন দাবি করে অধিকতর তদন্তের আবেদন জানান। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিএনপির আমলের চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করা হলে আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ প্রদান করে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে।