সিলেটে উন্মোচিত হল দেশের সবচেয়ে নান্দনিক শহীদ মিনার

কোন বদমাশ-দুষ্টলোক বাঙালির মৌলিক চেতনা মূল্যবোধকে প্রতিরোধ করতে পারবে না : অর্থমন্ত্রী

Shohid minar 11-12-2014সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বিকেল-সন্ধ্যা-রাত। আলো ঝলমল এক পরিবেশ। এক নাগাড়ে অনুষ্ঠান চলে গভীর রাত পর্যন্ত। দৃষ্টিনন্দন সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল।
গতকাল এমন আনন্দ উৎসব যেন উম্মিলনে শহীদ মিনার হয় উন্মোচন। দর্শকসারিতে বসে উপভোগ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাংস্কৃতিক মন্ত্রী, প্রখ্যাত অভিনেতা আবৃতিকার আসাদুজ্জামান নুর ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। অর্থমন্ত্রী সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করলেও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর শোনালেন কবিতা আর সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মহসিন আলী গলা ছেড়ে গাইলেন গান। জানালেন তাদের আনন্দ প্রতিক্রিয়াও। চেতনার প্রতীক শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বসে। উৎসবে ছিল লেজার শো। উদ্ভোধন উপলক্ষে শহীদ মিনার ছিলো আলোকজ্জ্বল। এর আগে বিকেল সাড়ে ৫ টায় পুষ্পার্ঘ অর্পণ ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।
একশ ফুট চওড়া ভূমির উপর ৪৫ ফুট উচ্চতার স্তম্ভটির মাধ্যমে আন্দোলিত ভূমি থেকে জেগে ওঠা বাঙালির আবহমান সংগ্রামী চেতনাকে উপলক্ষ করে শহীদ মিনারটির অনন্য দৃষ্টিনন্দন নকশা আঁকেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক শুভজিৎ চৌধুরী। তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আরো কয়েকজন। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। শহীদ মিনারের আগের ১৯ শতক জমির সাথে শহীদ সামসুদ্দীন হাসপাতাল থেকে আরো ১৭ শতক জমি নিয়ে নির্মিত হয় নতুন শহীদ মিনারটি। নকশা অনুযায়ী শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভের পেছনে অনেকটা সবুজ টিলার মতোই ভাঁজ ভাঁজ আন্দোলিত ভূমি। মূল স্তম্ভের ঠিক মধ্যখানে লাল গোলাকৃতি বস্তুটি অবিকল সূর্যোদয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
Shohid minar 11-12-2014_2গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি তৌহিদী জনতার ব্যানারে কিছু ধর্মান্ধ মিছিল করে ভেঙে ফেলেছিল আমাদের ঐতিহ্য আর গর্বের শহীদ মিনার। ক্রোধান্ধদের জব্দ করতে নির্মাণ করা দৃষ্টি নন্দন শহীদ মিনার গতকাল সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্বোধন হয়। উৎসবমুখর হলেও প্রাণের শহীদ মিনারে হামলাকারিদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার দাবিও উঠে এ সময়। ক্ষোভ ঝরে পড়ে অতিথিদের বক্তব্যে।
পুন:নির্মিত সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন- একুশ আমাদেরকে মাথানত না করার শিক্ষা দেয়। আজ শহীদ মিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। আজকের দিন আমার জন্য তৃপ্তির আনন্দের। এ দিনটি আমি খুশির ঈদের মতো সেলিব্রেট করছি। তিনি বলেন, বাঙালির মৌলিক চেতনা-মূল্যবোধকে কোন বদমায়েশ-দুষ্টলোক প্রতিরোধ করতে পারবে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি ‘বেজন্মা গোষ্ঠী’ সিলেট শহীদ মিনার ভেঙ্গে দিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের পর বাংলাদেশে কেউ বাংলাভাষার শত্রু ছিল বলে-আমার জানা ছিল না। কিন্তু, ২০১৩ সালে শহীদ মিনারে হামলার পর আমার এ ধারণা ভেঙ্গে গেছে।
অর্থমন্ত্রী ভাষা আন্দোলনের সাথে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ১৯৪৭ সালে স্কুলে পড়া অবস্থায় আমি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগদান করি। সিলেটে মুসলিম সাহিত্য সংসদ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন ১৯৫৫ সালে শেষ হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে কয়েক মাস সরকারের ভাত খেতে হয়েছে (জেল খাটা) বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পীকার, সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, কেয়া চৌধুরী, এমএ মতিন, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান, সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলী, জাসদ সভাপতি কলন্দর আলী, সাম্যবাদী দলের ধীরেণ সিংহ, ওয়ার্কার্স পার্টির সিকন্দর আলী, সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ প্রমুখ।
গান গাইলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রীঃ
‘একটি গানের কটা লাইন গাইব’ বলে তিনটি গান গাইলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে এলেই দর্শক সারি থেকে ‘গান গান…’ বলে শোরগোল ওঠে। তিনিও সম্মতি প্রকাশ করেন। একটি গানের কটা লাইন গাইব বলে অর্থমন্ত্রীকে নিবেদন করেন ‘তুমি সন্ধ্যা আকাশের তারার মতো, আমার মনে জ্বলবে…’। গানের রেষ না কাটিয়েই বলেন এই দেশ ও জাতি অর্থনৈতিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে আমার নেতা মুহিত ভাই কাজ করছেন। যখন তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হয়, তখন রক্তে আমার। এই জাতিকে উদ্ধার করতে হলে তারই প্রয়োজন। ‘আজকে এই শহীদ মিনারে দাড়িয়ে স্মরণ করতে চাই’, বলে দ্বিতীয় গান গেয়ে শোনান মন্ত্রী। ‘…আমার মুখের ভাষা যে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়…জীবনে মরনে হাসি কান্নায় উজ্জ্বল বরণীয়…’। গান শেষে তেজস্বী কণ্ঠে মুহিত ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি স্মরণ করেন মুক্তিযোদ্ধাদেরও।