ছোটগল্প গ্রীনকার্ড
এক
অ্যামবেসিতে বিমানের ফিরতি টিকিট সংক্রান্ত সকল ঝামেলার অবসান করে প্রফুল্লচিত্তে রুম থেকে বের হল শচীন। সকাল তখন ১১টা। চশমা খোলে মুক্ত আকাশের দিকে তাকায়। কার্তিকের ঝকঝকে আকাশ। নির্মল বাতাসের মুক্ত আঙিনা জুড়ে একগুচ্ছ ভাললাগার পরশ হৃদয়কে অনায়াসেই দুলায়িত করে চলে। ঋতুর পালাবদলে এখন প্রকৃতি সেজেছে নতুন করে, নতুন সাজে। ভোরের কাঁচা রোদ, মৃদু হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরণ জাগায়। শীতের পরশ আলতো করে গায়ে মাখে। সমস্ত প্রকৃতি জুড়েই যেন অসম্ভব এক ভাললাগার আবহ বিরাজ করছে। শচীন ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। আজ কী মনে করে যেন সে খালিপায়ে হাঁটছে।
খুব অল্পসময়ে সকল কাজ সম্পন্ন হওয়ায় আজ শচীনের মনটা খুবই প্রফুল্ল। শেষবারের মত যেন সে বাংলার প্রকৃতিকে দেখে নিচ্ছে নিজের মত করে। হৃদয়ের উৎসুক অনুভূতির ভাঁজ খুলে প্রকৃতির তাওয়ায় শুকোতে দেয়। দৃষ্টির সীমানা বিস্তৃত করে। আকাশে পেঁজা তুলার মতো ছন্নছাড়া মেঘমালা বিদায় নিয়েছে, প্রকৃতিকে নতুনের বার্তা দিয়ে হেসে ওঠেছে হেমন্তের আকাশ। প্রকৃতির কোলজুড়ে স্নিগ্ধতার পরশ, বাতাসে হিম হিম গন্ধ। প্রকৃতির নির্যাসে মাটির কাছাকাছি আলতো কুয়াশা জমে, কুয়াশার স্মৃতি রোমন্থন করে ঘাসের ডগায় বুঝি বা মুক্তোদানার মতো শিশিরেরা অস্থায়ী নিবাস গড়ে।
শচীন বুক ভরে নি:শ্বাস নেয়। রাস্তার দুধারের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রায় এক কিলোমিটারের মত রাস্তা সে অতিক্রম করে ফেলেছে। অনেক তো হাঁটা হল, আর কত! এখন বাসায় যাওয়াটাই জরুরি। আগামি পরশুই যে ফ্লাইট!
হঠাৎ তার অযাচিত কল আসে। রিসিভ করতেই অপর পক্ষ থেকে অনবরত গালি শুনতে পেল, বর্ষাকালে অঝর ধারায় বৃষ্টি যেভাবে বর্ষিত হয় তেমনি আর কি! শচীন একবার কল কেটে দিতে গিয়েও কাটলো না। রচনাসমগ্রের মত গালিসমগ্রও আকুণ্ঠচিত্তে শ্রবণ করতে লাগলো। ভাবলো আজকের এই দিনে মন খারাপ না করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু এক সময় তার ধৈর্য্যের চ্যুতি ঘটল। রাগে মাথা টনটন করতে থাকে। অপর পক্ষের গালির ওপর সে নিজেও গালি দিল- ‘‘চুতমারানির ফোয়া, ফুঙ্গার বাচ্চা ফুঙ্গা, তুইন রং নাম্বারো কল দিয়া মাতরে’’।
এরপরই কাকতালীয়ভাবে কলটা কেটে যায়। কল কেটে গেলেও তার রাগের রেশ থেকে গেল। তার কেবলি মনে হত লাগলো আরও কিছু গালি দিতে পারলে মনে হয় উচিত শিক্ষা হত! আর কী কী গালি দিলে তার নিরঙ্কুশ জয় হত সেগুলোর এক নকশা মনের মধ্যে অঙ্কন করতে করতে সিএনজি স্টেশনের কাছে এল।
দুই
স্টেশনের একদিকে সারি সারি সিএনজি রাখা আছে অপর দিকে লেগুনা। তারও অদূরে লাইটেস, বাসের স্টেশন। স্টেশনের এরিয়াটি খুবই জনাকীর্ণ। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের প্রত্যহ যাতায়াতে মুখর থাকে এই স্টেশন পাড়া। কোন এলাকায় ডাক্তার বেশি থাকলে যেমন সে এলাকার নাম হয়ে যায় ‘ডাক্তার পাড়া’ কিংবা জেলে বেশি বসবাস করলে সে এলাকার নাম হয় ‘জেলে পাড়া’, তেমনি এখানে বিভিন্ন প্রকার যানের স্টেশন হওয়ায় এটার নামও হয়েছে স্টেশন পাড়া। এই স্টেশনের প্রত্যেক ড্রাইভারদের একে অপরের সাথে রয়েছে দারুণ মেলবন্ধন, যেভাবে থাকে স্বগোত্রীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে মেলবন্ধন। সিরিয়াল মেনেই তারা গাড়ি চালায়।
আকাশে তখন বেশ কড়া রোদ। শচীনের কপাল ও খোঁচাখোঁচা গোঁফের কিছু অংশ ক্রমশই ঘেমে ওঠছে। এই ঋতুতে এমন রোদ ওঠার কথা নয়, সূর্যবাবু আজ বুঝি নিপাতনে সিদ্ধর সূত্র মেনে রোদ প্রেরণ করছেন! ডান হাতে ঘাম মুছতে মুছতে সিরিয়ালরত সিএনজির পাশে এসে দাঁড়ায়। দরাজকণ্ঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে- আম্বরখানা যাইবা নি?
-জি অয়।
শচীন আর কোন কথা না বলে সিএনজির পিছনের সিটে গিয়ে বসল। মিনিটখানেকের মধ্যেই আরও দুইজন যাত্রী আসল। একজনকে বেশ ভদ্র গোছের মনে হল। বয়স ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশের মত হবে। তার পোশাকে বেশ আভিজাত্যের ছোঁয়া রয়েছে। শুধু তাই নয়, তার সমস্ত শরীর জুড়ে হাসনাহেনা ফুলের মত তীর্যক পারফিউমের সুঘ্রাণ! শচীনের বাম দিকে তিনি বসলেন।
অপর যাত্রীর অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। গায়ের জামা দেখে মনে হল কয়েক বছর ধরে বুঝি পরিষ্কার করা হয়ে ওঠেনি। মাথায় জটায়ু, অদ্ভুত রকমের লম্বা দাড়িগোঁফ। মুখের একপাশ দিয়ে মিষ্টির সুরার মত লালা পড়ছে। পরনে জোড়াতালি দেয়া পুরনো লুঙ্গি। লোকটির সমস্ত শরীর জুড়ে ঘামের এমন বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ যে শহরের সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনকেও যেন হার মানাবে অনায়াসে! বগলে তালিযুক্ত একটির চটের বস্তা। গলাজুড়ে বিভিন্ন সাইজের ছোটবড় তাবিজ, হাতে হাত বন্ধনী। কোমরে সরু শিকল প্যাচানো। বামহাত দিয়ে গন্ধযুক্ত ব্রেড খেতে খেতে শচীনকে বলল- এটটু হইরা বহেন।
তখনও লোকটির গাল চুয়ে লালা পড়ছিল। সে লালায় ভিজে চ্যাপচ্যাপা হয়ে গেছে তার শার্ট। ব্রেডটিকেও মনে হল কয়েক দিনের বাসি। হয়ত ফুটপাত ধরে আসার সময়ই ড্রেনের কোথাও থেকে কুড়িয়ে এনেছে! আমাদের সমাজে এরকম চিত্র অপ্রতুল নয়। সাধ্য থাকলেও কেবল সাধের অভাবের কারণেই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়ে ওঠে না।
শচীন লোকটির দিকে তাকিয়ে একবার ভ্রু কুচকালো। তার মুখের লালা পড়া দেখে তীব্র ঘৃণাবোধ আর রাগে তার চোখমুখ লাল হয়ে ওঠতে লাগলো। দুর্গন্ধে গা ঘিনঘিন করছে। তবুও মুখে একটু কৃত্রিম হাসি এনে বলল- আফনে পরেরটাতে আউক্কা।
লোকটি শচীনকে কিছু না বলে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে রইল। ড্রাইভার শচীনকে বলল- ভাই সিট তো তিনজনর। আফনে এখটুতা হরিয়া বইন না!
-তাইন অউ গাড়িত গেলে আমি যাইতাম নায়।
-তাইন এখটু সামনে গিয়া নামি যাইবা, এখটুতা কষ্ট করি লাইন, সোনা বাই নু। শচীনের বামপাশে বসা লোকটি তখন শচীনের পিঠে হাত রেখে মাথা নেড়ে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করে। এরপর শচীন আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। ড্রাইভার পাগলকে বলল- এরে বেশি নড়িও না, চুপচাপ বই রইবায়, বুচ্চ নি?লোকটি মাথা নাড়ে।
লোকটি বসে গেলে সিএনজি যাত্রা শুরু করে। কিছু দূর যেতেই শচীনের বাম পাশের সেই ভদ্রলোক নেমে যায়। কিন্তু এই পাগল নামার নামটি পর্যন্ত করে না! কী অদ্ভুত রে বাবা! শচীন একটু সরে বসে। কারো মুখে কোন কথা নেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে তারা শহরে এসে পৌঁছায়। আম্বরখানার কিছু আগে সিএনজি থেকে নেমে যায় শচীন। ভাড়া পরিশোধ করে। ভাড়া কম হওয়ায় আর মানিব্যাগ খুঁজতে হল না। বুকপকেটের খুচরা টাকাতেই হয়ে গেল।
তিন
সন্ধ্যার পর শচীনের বাড়ির সকলেই ড্রইংরুমে বসে জমকালো আড্ডা দিচ্ছে। বারবারই তার ডাক পড়ছে সেখানে যাওয়ার। সে কেবলি বলছে- আইরাম। থুরা কাম আটাইয়া আইরাম। কিন্তু তার আর আসা হয়ে ওঠে না। তার চাচাত বোনেরা তাকে ধরে নিয়ে আড্ডার আসরে বসাবে এমন পরিকল্পনা করার সময়ই শচীন হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল- আমার গ্রীনকার্ড কোনান? মানিব্যাগ? তুমি তাইন খেউ দেখছ নি?
এমন আকস্মিক সংবাদে মুহূর্তেই সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কারো কারো মধ্যে তখন উসখুস ভাবও দেখা গেল। তবে কি শচীন আমাদের সন্দেহ করছে? তার চাচাত বোন শ্রাবণী নিজেদের নির্দোষ প্রমাণার্থে উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল- আমরা অউ আইছি রে বাই, তোমার রুমের বাইজু আমরা গেছি না। মনো খরিয়া দেখ কোন জাগাত ফালাইয়া আইছ কিনা! তখন তার সাথের অপরাপর বোনেরাও বলল- অয় অয় মনো খরিয়া দেখ।
শচীন চোখ বন্ধ করে। সবাই একটু অস্বস্থিমূলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কোন কথা নেই। রাত্রির মত থমথমে নীরবতা। এত আনন্দের মধ্যে হঠাৎ করেই বিষাদের ছায়া নেমে আসায় সকলেই মর্মাহত হল। সবচেয়ে বড় কথা হল মানিব্যাগে পাসপোর্ট এবং গ্রীনকার্ড। ওগুলো ছাড়া কোনভাবেই আমারিকায় যাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই যে কোন মূল্যেই সেগুলো খোঁজে বের করতে হবে। যে কথা সেই কাজ। সকলেই মানিব্যাগ, পাসপোর্ট ও গ্রীনকার্ড খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তন্নতন্ন করে সমস্ত বাসা খোঁজা হল, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।
অ্যামবেসি থেকে আসার পথে হয়ত কোথাও পড়েছে কিংবা সিএনজিতে। এরকম নানাবিধ চিন্তা তার মাথায় আসে। শচীন ঠিক করল আবার সে অ্যামবেসির দিকে যাব এবং এখনই। তড়িঘড়ি করে বের হবে এমন সময় দরজায় কে যেন কলিং বেল চাপল। শচীনের ছোট বোন বিন্তি দরজা খুলে দিল। দেখল বস্তা ও থালা হাতে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিন্তি বলল- ভিক্ষা নায়, মাফ কর, অন্যবায় যাও। লোকটি তখন বলল- ভিক্ষার লাইগা আহি নাই গো মা।
তাইলে?
-এইডা কি শচীন চৌধুরীর বাসা?
-জি অয়। খেনে? খিতার লাগি?
ওনার লগে একটু দেখা করন যাইবো?
লোকটির নোংরা পোশাক দেখে বিন্তি কি একটু ভেবে বলল- না। তাইন এখন ব্যস্ত আছইন। পরে আইবা। লোকটি চলে যাচ্ছিল এমন সময় শচীন বলল- বিন্তি খার লগে মাতরে?
বলতে বলতেই সে দরজার কাছে আসে। লোকটির দিকে তাকাতেই সে চিনে ফেলে। হাতে থালা দেখে বলল- আফনে শেষ পর্যন্ত আমার বাসাত আইলায় বিক করার লাগি! বুক পকেট থেকে ৫০ টাকার এক নোট বের করে বলল- অউ নেউক্কা। বিন্তি কি একটা বলতে গিয়েও আর বলতে পারলো না। লোকটি ফোকলা দাঁতে ম্লান হাসি দিয়ে বলল- আফনের টেকা নেওনের লাইগা আহি নাই, আফনেরে কিছু দিবার লাইগা আইছি।
শচীনের চোখ যেন তখন কপালে ওঠার মত অবস্থা। এই পাগলে বলে কী! বিষ্ময়ী দৃষ্টি নিয়ে সে লোকটির দিকে তাকায়। লোকটি দ্রুত বস্তার ভেতর থেকে শচীনের পাসপোর্ট, গ্রীণকার্ডসহ মানিব্যাগটি তার হাতে দেয়। মানিব্যাগের দিকে একটু তাকিয়েই শচীন দেখল সব ঠিক আছে। বিষ্ময়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। যাকে সে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করল এখন সেই কি না… ! অদূরে রাত্রিখোর জোনাকির নির্জন অভিসার অন্ধকারের গা ছুঁয়ে অজানার পানে ছুটছে। পৃথিবীর প্রান্ত ঘেঁষে দূর আকাশে একফালি কাটা চাঁদ ক্রমেই হেসে ওঠছে।
………………………………..
০৩.১১.২০১৪
জাফলং, সিলেট
মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট
সার্বিক যোগাযোগ: ০১৭৪১৪৩৬৮৫১
Email: [email protected]