ছোটগল্প তিনটি আঙুল

এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নে কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিজের ভেতরে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রনা ক্লেদ নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় আসি। বাইরে অবশ্য শীতের প্রকট তেমন একটা পড়ে নি।বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আকাশ। ঈষৎ আদ্র বাতাস বইছে। ঈশ্বরে পৃথিবীতে মনে হল শান্ত নীরবতা। ফ্রেস হয়ে নাস্তা করতে যাই। গিয়ে দেখলাম খাওয়ার মত কিছুই প্রস্তুত নেই। করতেও ইচ্ছে করলো না। মনকে সুস্থ করার জন্য এই ভোরবেলাতেই নেটে বসলাম। কখন যে বিকেল হয়ে গেছে টেরও পেলাম না। হঠাৎ জরিনার আগমনে আমার চৈতন্য হল। আমার মনে পড়ল আমি ক্ষুধার্ত। কতক্ষণ ধরে খাইনি! সে সকালে আসলেই তো খেতে পারতাম! আমার কেন যেন তার ওপর ভারি রাগ হতে লাগলো।
সে এসেই অনুনয়ের স্বরে বলল- মামা, মায়ের শরীরলডা বালা না, হের লাইগা সকালে আইবার পারি নাই।
– তরার অউ এখ প্রবলেম; অউ মাতাত বেদনা, তো পাউঅ বেদনা- দুইদিন পর পর তরার
খত জাতোর যে প্রবলেম বারয়…! মাসো ফনডদিন যায়গি অতা হতাত!
-বিশ্বাস করেন মামা, আমি একটুও মিছা কই নাই। মিছা কইলে আল্লার গজব পড়ব আমার
উপর।
– দূর শুয়রের ফুরি, আর বেশি সাধু গিরি মারাইছ না; তরারে বালাটিখে চিনি। যা খাওন রেডি খর।
মামা, মায়রে নিয়া অহনি ডাক্তার দেহান লাগবো। রাগগুসা যাই অন- অহন আমি রানবার
পারুম না। মাইরে নিয়া অহনই ডাক্তারের কাছে যাওন লাগবো।

কথাটি বলেই সে আর ফিরতি উত্তরের তোয়াক্কা না করে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। পিছন দিক থেকে আমি উচ্চস্বরে গালি দিয়ে বললাম- কুত্তার ফুড়ি আর আইছ না। যাহ…!

সকাল পেটে কিছু না পড়ায় পেট এমনিতেই চুচু করছিল। তার উপর সে ছুটি চাওয়াতে মাথা যেন আরও গরম হয়ে ওঠলো। প্রায় সময়ই তার নানা অজুহাত থাকে। আমার ধারণা ওর মত অনেক কাজের বুয়ারই এই রকম ফাঁকিবাজি লক্ষণ রয়েছে। প্রথম প্রথম খুব বিশ্বাস করতাম। এখন করি না। তার অবশ্য যথার্থ কারণও রয়েছে।
জরিনার আসল নাম ফুলপরী। প্রায় চার বছর ধরে সে আমাদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছে। বয়স উনিশ কিংবা বিশ হবে। এরই মধ্যে সে দুই স্বামীর ঘর করার অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে। চারজন ছেলেমেয়ে। সবগুলোই পিঠাপিঠি। বর্তমানে ২য় স্বামী পরিত্যাক্ত হয়ে বাপের বাড়িতেই রয়েছে। আমি জরিনাকে তার ব্যক্তিগত ত্রুটির কারণে গালিগালাজ করলেও তার সন্তানদের প্রতি ছিলাম বেশ ¯েœহাসক্ত। তার মূল বেতনের বাইরেও তার সন্তানদের স্কুলের যাবতীয় খরচ দিতাম। এই কারণেই হয়ত আমার গালিগালাজ ওর কাছে খুব লাগে বলে মনে হয় না। তাছাড়া ঐ যে একটা প্রবাদ বাক্য আছে না- “ যে গরু দুধ দেয় সে গরুর লাথিও নাকি মজা লাগে”। আমার স¤পর্কে জড়িনা হয়ত তেমন ধারণাই পোষণ করে!

অন্যসব দিনগুলোতে গালিগালাজ করলেও একেবারে বিদায়ের কথা বলি নি কখনো। আজ কেন যেন
মুখ ফসকে কথাটি বের হয়ে গেল। সত্যিই যদি সে আর না আসে! কিংবা তার মা যদি সত্যিই অসুস্থ
হয়ে থাকে! কাজটি কি ভাল করলাম? নিজের সাথে এখন আর হিসেব মিলাতে পারছি না। অবলীলায় নিজের ভেতর অনুতাপে দগ্ধ হতে থাকি। আসলেই ক্ষুধার্ত অবস্থায় মানুষের মাথা সঠিকভাবে কাজ করে না। তেল ছাড়া যেমন ইঞ্জিন চলে না, তেমনই আর কি!


নানাবিধ চিন্তাভাবনা করে মেডিকেলে চলে গেলাম। একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সদ্যই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন পাশ করে ইন্টার্নি করছি। আজকে একটি লাশের পাকস্থলির ভিতরের বিভিন্ন অংশ কেটে ভিতরের অর্গানগুলো সনাক্ত করে দেখানোর কথা। আমি যখন ল্যাবে গিয়ে পৌঁছাই তখন সন্ধ্যে প্রায় সাতটা। ফর্মালিনে ঢাকা লাশ। বুকের পাঠা যতই শক্ত থাকুক একাএকা লাশ কাটা ও সনাক্ত করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ। ড. শিশির চক্রবর্তী স্যার একটি খাতার মধ্যে কিছু লেখা দেখিয়ে বললেন, এইগুলো বের কর ও লক্ষণ সনাক্ত কর। আমি প্রফুল্ল মনে কাজ করে চলছি। স্যারকে বিভিন্ন অংশ দেখালাম। স্যার খুশি হয়ে বললেন- বিষষ ফড়হব! এরপর জরুরি কল আসায় তিনি বাইরে চলে গেলেন। আমি পার্টসগুলো যথাস্থানে রেখে সেলাই করতে থাকি।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। মুহূর্তেই সমস্ত কক্ষটিতে এক ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করে। আমি লাশ রেখে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু যেতে পারছি না। মনে হল কেউ যেন আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। জেনারেটরও কেন যেন আজ দ্রুত চালু হচ্ছে না। তবে কি জেনারেটরও বিকল হয়ে গেল? আমি যেতে পারছি না কেন? আমার হাত-পা নাড়াতে পারছি না কেন? নিজের সাথে প্রশ্ন মিলাতে চেষ্টা করি।

কিন্তু যতই প্রশ্নের উদয় হচ্ছে ততই যেন কক্ষটি ভীতিকর থেকে আরও ভীতিকর হয়ে ওঠছে। লাশের পাশ থেকে হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। আমি সামনে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাই কিন্তু কোনভাবেই আর সামনে যেতে পারছি না। বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ায় কোনদিন ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি নি। কিন্তু আজ কেন যেন নানান কুসংস্কার মনের মধ্যে ভর করতে লাগলো।

চারদিকে ভয়াল অন্ধকার। শ্মশানের মত নীরবতা। এই ক্ষণমুহূর্তেই আমার মনে হল কয়েক’শ শতাব্দী ধরে যেন আমি এই মৃত্যুপুরীতে রয়েছি। এই অদ্ভুত নীরবতায় অস্থির হয়ে ওঠতে থাকে আমার দেহ, মন। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার দুটি পা কাঁপতে থাকে। হঠাৎ একটি টিকটিকি বীভৎসভাবে ডেকে ওঠে। ভয়ে আমি নিজের ভেতরেই কুকড়াতে থাকি। আমার হাতপা স্তবির হয়ে আসে। আমি জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনই শব্দ যেন মুখ থেকে বের হল না। অশ্রুবিসর্জন করতে চাইলাম কিন্তু মনে হল এখন বর্ষা নয় গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে। অশ্রুর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।

হঠাৎ আমার ঘাড়ে ঠা-া অনুভব করলাম। আমি হকচকিয়ে ওঠি। হাত দিয়ে সরাতে চাইলাম ঐ ঠা-া বস্তুটি কিন্তু কোনভাবেই দেহ ও হাত নাড়াতে পারলাম না। আমার সমস্ত শরীর তখন হিম হয়ে আসে। মনে হল হিমাঙ্কের নিচের কোন শক্তিশালী সিডর আমার দেহের প্রতিটি কোষে কোষে যেন বিরতিহীনভাবে আঘাত করে চলছে। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি। বেঁচে আছি না মারা গেছি ঐ মুহূর্তে ঠিক বুঝে ওঠতে পারলাম না।

এমন সময় হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে এল। বিদ্যুতের আলোয় মুহূর্তেই আমার সমস্ত জড়তা কেটে যায়। এমন সময় আমার সহপাঠি অনিক এসে বলল- জানিস, এইমাত্র আমাদের ৫ নং ওয়ার্ডের ২৭ নম্বর রোগী ব্রেইনস্ট্রোক করে মারা গেল। আমি আমার ত্রুটি খুঁজতে খুঁজতে বললাম-ও তাই? মহিলা না পুরুষ?
-মহিলা
-কার রোগী?
জরিনা ওরফে ফুলপরীর।
পৃথিবীর সমস্ত বিষ্ময় নিয়ে আমি তার দিকে তাকাই। আমাদের জরিনার মা! তবে কি সে সত্যিই বলেছিল। নিজের ভিতর প্রচ- অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি ভুলে যাই ক্ষণপূর্বের ভয়ার্ত সময়ের কথা। আমি জরিনার মাকে দেখার জন্য বের হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। সহসা আমার চোখ পড়ল ফর্মালিনে আচ্ছন্ন লাশের হাতের দিকে। দেখলাম তার হাতের তিনটি আঙুল আমার প্যান্টের লোপের ভেতরে আটকে রয়েছে। ক¤িপত হাতে আঙুল তিনটি ছাড়িয়ে আমি অনিকের দিকে তাকাই। অনিকও তাকায়। দুজনের চাহনি জুড়ে খেলা করে প্রাগৈতিহাসিক দুই মেরুর গোপন রহস্য।

…………………….
২৪.১০.২০১৪
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট

মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট
সার্বিক যোগাযোগ: ০১৭৪১৪৩৬৮৫১