বই আলোচনা : মুহিবুর রহমান কিরণ
- বইয়ের নামঃ নবীজির দেশে ষোল বসন্ত
- লেখকঃ মিজানুর রহমান মিজান
- বাসিয়া প্রকাশনীঃ সিলেট।
- মুল্য ত্রিশ টাকা।
নবীজির দেশে ষোল বসন্ত ২০০৫ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত একটি ভ্রমণ বিষয়ক বই। লেখক মিজানুর রহমান মিজান। বইটির প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড: কবির চৌধুরী।
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বেকারত্বের সমস্যায় নিরুপায় হয়ে প্রতিদিনই এদেশের মানুষ , বিশেষত:গরীব মানুষ তার সহায় সম্ভল বিক্রি করে ওমরা ভিসা নিয়ে সৌদি আরব যাচেছ এবং থেকে যাচেছ সেখানে অবৈধ অভিবাসী হয়ে। শ্রমজীবি এ সকল মানুষের জীবনের কথা , কষ্টের কথা , লেখক বইটিতে চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছেন। নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে একই সুবিধা অসুবিধায় পর্যবসিত অপরাপর প্রবাসীদের দৈনন্দিন জীবন চিত্র স্বত:স্ফুর্ত ভাবে আলোচনায় এসেছে। লেখক তার ষোলটি বছরের প্রবাস জীবনের বাস্তব অবলোকন , একাকীত্বের মর্মবেদনা , প্রিয়জন থেকে দুরে থাকার কষ্ট , উৎকণ্ঠা , অবৈধ অভিবাসী হিসেবে নিরুপায় অবস্তান এবং ভিন দেশের সামাজিক আবহে কায়িক শ্রমক্লান্ত মানুষের আশাÑআকাংখা , চাওয়া-পাওয়ার একটি বস্তুনিষ্ট জীবনাচরণ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ” নবীজির দেশে ষোল বসন্ত” বইয়ে উপস্তাপন করেছেন। ভিন দেশ মানে সৌদি আরবের জেদ্দা-মক্কা- মদিনা। প্রতি বছরই শত শত মানুষ বাংলাদেশ থেকে ওখানে যাচেছ। যারা যাচেছ সাধারণত: তারা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত দরিদ্র মানুষ। জীবন ও জীবিকার তাগিদে সেখানে কি পরিবেশে , কি অবস্তায় , কি কষ্টে তাদের জীবন অতিবাহিত হয় বইটিতে তার সংবেদনশীল প্রকাশ পাঠককে সহজেই নাড়া দেয়। আমাদের দেশ থেকে যারা সাধারণত: শ্রমজীবি হিসেবে সৌদি আরব যাচেছন। সঙ্গত কারনেই তাদের কাছ থেকে তেমন ভাষ্য আমরা পাই না। লেখক ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে অবস্তান করেছেন। ইতিপূর্বে মাসিক বাসিয়া পত্রিকায় ” একজন প্রবাসীর ডাইরী থেকে ” শিরোনামে ধারাবাহিক ভাবে লেখাগুলো প্রকাশিত হবার পর বর্তমানে তা বই আকারে বের হওয়ায় তার সাথে আমরা পরিচিত হতে পেরেছি। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের জীবন যাপনের ইতিবৃত্ত উপস্তাপন করতে গিয়ে ভিসা , চাকুরী , পরিচয় পত্র নবায়ন এবং বিভিন্ন ধরণের প্রতিকুলতার হৃদয়-স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। একান্ত কাছে থেকে গভীর ভাবে দেখা এবং ব্যক্তিগত অনুভবের সাথে উপলব্ধি গুলোকে বর্ণনার মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন অথবা যারা যাবেন তাদের জন্য ও বইটি উপযোগি। সে দেশে যাপিত দিন রাত্রির আশা-আকাংখা , আনন্দ-বেদনা বইটির প্রতিটি বাক্যে বিবৃত। সেখানে ঈদ উদযাপনের আনন্দময় এবং একই সাথে বিষাদ-ঘন বর্ণনা , ওমরা পালনে মক্কা যাত্রা কালে ইসলামের ঊষালগ্নে বর্ণিত মক্কার +সাথে আধুনিক সভ্যতার মনোরম স্পর্শে বর্তমান সময়ের তুলনামুলক আলোচনা ; হযরত মোহাম্মদ ( স:) এর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক ঘটনা ও স্তানের পরিচিতি ; বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশীয় মানুষের হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালনের বিবরণ এবং সেখানের আচার , প্রথা উত্যাদি আনুষঙ্গিতার পরিচয় ; মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান। সেখানে অবস্তানরত বাংলাদেশী শ্রমজীবি মানুষদের আচার-আচরণ , তাদের ক্ষুদ্রতা , তুচছতা , সরলতা-কপটতা , আদম বেপার দের অমানবিক অনুভুতি। অবৈধ অভিবাসীদের মানবেতর বসবাস , দেশের প্রতি মমত্ববোধ , আর্থিক দৈন্যতা। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুন , পুলিশের কর্তব্য পরায়নতা , জনগণের নির্লিপ্ততা , সত্যবাদিতা কাজীর বিচারে শিরচেছদের প্রত্যক্ষ এবং লোমহর্ষক বর্ণনা। সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জেলে অবস্তানের চিত্র ইত্যাদি লেখক তার স্বভাবজাত ভাষায় অত্যন্ত বাস্তব ভিত্তিক বর্ণনা প্রদান করেছেন। ” নবীজির দেশে ষোল বসন্ত ” মুলত: লেখকের প্রবাসকালীন সময়ের স্মৃতিচারন মুলক বই। স্মৃতি যে সকল সময় সুখকর হয় না তার প্রমাণ আলোচ্য বইটির মধ্যেই আমরা পেয়েছি। প্রবাস জীবনের স্মৃতি চারণের মধ্য দিয়ে বইটিতে লেখকের নিজস্ব জীবন এবং জীবন ভাবনাসহ আত্মগত মর্মপীড়া অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান। আর্থিক অসচছলতার কারনে শিক্ষকতা ছেড়ে বাধ্য হয়ে লেখক মধ্যপ্রাচ্যে ১৬ টি বৎসর অতিবাহিত করেছেন। ফিরে এসেছেন অসুস্থ এবং কর্মহীন হয়ে , কপর্দকহীন অবস্তায়। যে সংসারের প্রয়োজনে তিনি করেছেন জীবনের সর্বোচচ ত্যাগ , যৌবনকে উৎসর্গ করেছেন পেট্রোডলার নামক সোনার হরিণের হাতছানিতে , স্ত্রী সন্তানদের সুখের কথা ভেবে ষোলটি বছর প্রবাস জীবনের কষ্টার্জিত টাকা নিয়মিত দেশে পাঠিয়েছেন। পরিবার হয়েছে উপকৃত , দেশ পেয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু অসুস্থ অবস্তায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পঙ্গু এবং অসুস্থ মনে করে , বেকার এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করে , প্রিয়জন করেছেন তাকে ত্যাগ। এ বড় নির্মম ট্রাজেডি। বইটির শেষ প্রান্তে এসে লেখকের এমনতরো বর্ণনা পাঠকের মনে এক অসম্ভব সমবেদনার জন্ম দেয়। তখন লেখক মিজানুর রহমান মিজান এর চেয়ে ব্যক্তি মিজান আমাদের কাছে আরো বেশি আপন এবং সত্য বলে মনে হয়। লেখক দু:খে এটাকে , ” পুরুষ নির্যাতন ” বলে অভিহিত করেছেন। ব্যক্তি সুখ পরিহার করে প্রবাস জীবনের ষোলটি বসন্ত পার করে দিয়ে অসুস্থ হয়ে আজ বেকার পঙ্গুত্বের কারনে লেখকের ভাষায় ” হারালাম সকল প্রিয়জন ”। বইটিতে প্রবাস জীবনের বর্ণনার পাশাপাশি লেখকের ব্যক্তি জীবন ও অনুচচারিত থাকেনি। মর্মান্তিক হলে ও অকপটে সত্য ভাষণ লেখককে আরো স্পষ্ট ও জীবনবাদী করে তোলেছে। লেখকের সাথে আমরা ও মর্মাহত হই। গভীর বেদনায় জীবনকে দেখি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। জীবন উৎসারিত যন্ত্রণার নীল রঙ পাঠকের হৃদয়কে ও ছুঁয়ে যায় সকরুণ স্পর্শে। এ যেনো রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর জীবন যুদ্ধে আহত এক সৈনিকের আর্তনাদ কিংবা অমানবিকতার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ এক প্রতিবাদ। যা আমাদের কলমে প্রতিকারের ন্যায্য দাবী ঘোষণা করে। বইটিতে লেখক সচেতন ভাবেই প্রবাসে তার যাপিত দিনগুলির স্মৃতি চারনায় সেখানের বিভিন্ন স্থান , ঘটনা এবং কর্মরত বাংলাদেশীদের জীবনাচরণ আবেগ প্রবণ ভাষায় বর্ণনা করেছেন। বইটির নাম করণে মধ্যপ্রাচ্যকে নবীজির দেশ আখ্যায়িত করার মাধ্যমে লেখকের সরল সমর্পিত ধর্মীয় অনুভুতির যেমন এক কথায় সুন্দরতম প্রকাশ ঘটেছে। তেমনি জীবন চেতনায় বইটি হয়েছে আরো গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। যদি ও বইটি ভ্রমণ বিষয়ক , তবু ও বিষয় বস্তুর সার্বিক পর্যালোচনায় এটাকে আমরা স্মৃতি চারণমুলক বই হিসেবে ও সংজ্ঞায়িত করতে পারি। কারন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ও বর্ণনার চেয়ে ব্যক্তি তার চিন্তা-চেতনা , সুখ-দু:খ এবং আত্মকথন নিয়েই এখানে বেশি উপস্থিত। সরল বিভাজনে বইটির দু’টি দিক সমভাবে বর্তমান। একটি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের জীবন , অন্যটি জীবনের গভীরে প্রোথিত যে মমত্ববোধ , স্নেহ-প্রীতির বন্ধন , স্ত্রী-সন্তানের ভারবাসা , শেকড়সহ তা উপড়ে ফেলার বেদনা ও বঞ্চনা লেখককে অধিক তাড়িত করেছে। এখানে লেখার চেয়ে লেখককে জানার প্রবণতা পাঠককে সম্মোহিত করে।
” নবীজির দেশে ষোল বসন্ত ” বইটিতে লেখক শব্দ চয়ন এবং বিশেষণ প্রয়োগে আরেকটু সচেতন হলে ভাষায় বোধগম্যতা ও শ্র“তি মাধুর্য অনেকাংশে বৃদ্ধি পেতো। লেখায় বাহুল্য বর্জন চলমান ভাষা রীতির একটা ইতিবাচক শর্ত। লেখায় অনেক স্থানেই মনে হয়েছে আবেগ বশত: লেখক শব্দ প্রয়োগে স্বপ্নময়তা সৃষ্টির অপ্রয়োজনীয় প্রয়াসে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন , যা বাক্য বিন্যাসে এনেছে অস্পষ্টতা। এ বিষয়ে মনোযোগি হলে বইটি আরো বেশি পাঠকের সন্তুষ্টি লাভে সমর্থ হতো , ভাষায় সৃষ্টি হতো সহজ গতিশীলতা। পরিশীলতায় বইটি আরো পূর্ণতা পেত যদি প্রকাশক অধিক মাত্রায় মিতব্যয়ী না হতেন। অর্থ্যাৎ বইটি শুরু হয়েছে ডান পৃষ্টা থেকে , কোন রকম সৌন্দর্য এবং স্বস্থিদায়ক অবকাশ না রেখেই। মনে রাখতে হয় , বই পত্রিকা নয় , একবার পড়েই এটাকে ফেলে দেয় না। যাই হোক এ সকল খাটো বিচ্যুতিকে সহনীয় ভাবে গ্রহণ করলে আলোচ্য ” নবীজির দেশে ষোল বসন্ত ” বইটি অবশ্যই একটি ভালো বই।
সেই অনাদি কাল থেকে পৃথিবী বক্ষে লক্ষ কোটি মানুষের আসা-যাওয়া। জন্ম মৃত্যু আর আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়েই জীবন নিয়ত প্রবাহমান। দিন যায়। দিন আসে। একই দিন যেমন আর ফিরে আসে না কখনোই , তেমনি একটি জীবনের ও পুনরাবৃত্তি কখনোই ঘটে না। জীবন সে স্বল্পদীর্ঘ , খ্যাত-অখ্যাত , বিত্ত-অবিত্ত কিংবা উচচ-তুচছ যা’ই হোক না কেন প্রতিটি মানব জীবনই সুখ-দু:খসহ বিভিন্ন অনুভুতির এক অবিস্মরণীয় উপাখ্যান। সে উপাখ্যানে লেখক মিজানুর রহমান মিজান একজন সত্যাশ্রয়ী কথক। বইটির প্রতিটি উচচারনই জীবন থেকে নেয়া। স্বদেশে ব্যক্তি জীবন এবং জেদ্দা-মক্কা-মদিনার প্রবাস জীবন , বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জীবন যন্ত্রণার বহি:প্রকাশ। কোন গল্প নয় , অদেখা কোন কাহিনী নয় , কল্পনা নয় , জীবন চলার কঠিনতম অনুভুতি এবং ঘটনা চিত্র লেখক তার আবেগ-ঘন ভাষা ও আন্তরিকতায় জীবন্ত করে তুলেছেন। যাতে পাঠকের হৃদয়ে এমন এক তাগিদের জন্ম দেয় যা’র শেষ বাক্যটি সমাপ্ত না করে স্বস্তি পাওয়া যায় না। এখানেই লেখক অনন্য। আমরা লেখক ও তার বইয়ের সাফল্য কামনা করি।
লেখক মুহিবুর রহমান কিরন , কবি , গ্রন্থ প্রণেতা , কাষ্টমস ইন্সপেক্টার , ঢাকা।
মোবা ০১৭২৭ ৭৭২৬৫১।