প্রেম, অপহরণ, ধর্ষণ অতঃপর ভিডিও..
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নিরাপত্তা প্রহরীকে খুন করে মা ও হবু স্বামীর কাছ থেকে কলেজছাত্রীকে আপহরণের পর তাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রীর সাবেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। সেই ঘটনার ভিডিও করা হয়েছে। এখন র্যাব ও পুলিশ জোর অভিযান চালাচ্ছে সেই ভিডিও ফুটেজটি উদ্ধারের জন্য।
রাজধানীর উত্তরায় বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে অপহরণের পর শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের একটি সড়ক থেকে কলেজছাত্রীটিকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। শারীরিক পরীক্ষার জন্য পুলিশ মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের পাঠায়। শুক্রবার ওই কলেজছাত্রীর শারীরিক পরীক্ষা না হওয়ায় তাকে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে।
ফ্ল্যাশব্যাক
পুলিশ, পারিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ উত্তরা শাখার ব্যবসা বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ওই ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয় অ্যাভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুল হকের সঙ্গে। দুই বছর আগে থেকে ওই কলেজছাত্রী ও তার মা উত্তরার এশিয়ান স্কাই শপ থেকে কেনাকাটার সূত্র ধরে ওই দোকানের মালিক রুম্মনের পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে কলেজছাত্রীর সঙ্গে রুম্মনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্র ধরে ওই ছাত্রী ও তার মা দোকান থেকে সৌন্দর্য চর্চার বিভিন্ন সামগ্রী বিনামূল্যে নিতেন। একপর্যায়ে কলেজছাত্রীর মা তাদের মধ্যে বিয়ের উদ্যোগ নেন। কিন্তু পারিবারিকভাবে ওই মেয়ের বাবা এ ব্যাপারে অমত দেয়ায় সম্পর্কের টানাপোড়ন চলে। গত সপ্তাহে মাহফুজুল হকের সঙ্গে কলেজছাত্রীর বিয়ের বাগদান সম্পন্ন হয়। মাহফুজুল হক উত্তরা ৫নং সেক্টরের ৪/এ নং রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির ফজলুল হকের ছেলে।
ঘটনা
বৃহস্পতিবার রাতে কলেজছাত্রী, তার মা ও হবু স্বামী মাহফুজুল উত্তরার বিভিন্ন শপিংমল থেকে কেনাকাটা করেন। এরপর তারা একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে খাবার খান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা হেঁটে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়ক দিয়ে যান। ৯ নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছলে একটি সাদা রঙের টয়োটা এলিয়ন প্রাইভেটকার তাদের গতিরোধ করে। গাড়ি থেকে ৩ জন অস্ত্রধারী যুবক বের হয়। তারা টেনে-হিঁচড়ে কলেজছাত্রীকে গাড়ি তোলার চেষ্টা চালায়। এ সময় মাহফুজুল বাঁধা দিলে তার হাতে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয় অস্ত্রধারীরা।
এই দৃশ্য দেখে পার্শবতী ৬ নম্বর ভবনের সিকিউরিটি গার্ড লিয়াকত হোসেন লিটন (৩৮) এগিয়ে যান। লিটন যুবকদের কাছ থেকে কলেজছাত্রীকে উদ্ধারের চেষ্টা করলে গাড়ির স্টিয়ারিং সিটে বসে থাকা একযুবক লিটনকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। তারপর কলেজছাত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
লিটনকে তখন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত লিটনের বাবার নাম নাজমুল হুদা। রংপুরের পীরগাছার সুতিপাড়ায় তার বাড়ি। দুই ছেলের বাবা লিটন উত্তরার হারিস সিকিউরিটি সার্ভিসের সদস্য ছিলেন।
যেভাবে আটক হলো
ঘটনার পর কলেজ ছাত্রীর মা নুরুন্নাহার ছুটে যান উত্তরা মডেল থানায়। সেখানে পুলিশের কাছে তার মেয়েকে উদ্ধারের আকূতি জানান। তবে পুলিশ প্রথমে বিষয়টি আমলে নেয়নি। থানা থেকে জানানো হয়, আগে মামলা করতে হবে এরপর অপহৃতকে উদ্ধার অভিযান চলবে।
পুলিশের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্যে তিনি নিরাশ হয়ে চলে যান উত্তরা র্যাব-১ কার্যালয়ে। রাত ১২টার দিকে র্যাব-১ কার্যালয়ের প্রবেশ গেটে একজন সৈনিকের কাছে তার মেয়েকে উদ্ধারের দাবি জানিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। এসময় র্যাব-১ কার্যালয় থেকে র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বের হচ্ছিলেন। তিনি বিষয়টি জানার পর র্যাব-১ এর পরিচালক ও উপ-পরিচালকের সমন্বয়ে তাৎক্ষণিক একটি শক্তিশালী টিম গঠন করা হয়। ওই সময় ছাত্রীর মাকে র্যাবের একটি গাড়িতে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে র্যাবের টিম।
পাশাপাশি বিষয়টি পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার নিসারুল আরিফ জানতে পেরে তাৎক্ষণিক পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দেন। তিনি নিজেও ছুটে যান ঘটনাস্থলে। এরপর পুলিশ ও র্যাব যৌথভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রুম্মনের অবস্থান নিশ্চিত হয়। ভোর ৫টার দিকে পুলিশ ও র্যাবের একটি টিম কাফরুলের মিতালী হাউজিংয়ের একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে। ওই বাড়ি থেকে রুম্মনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসময় রুম্মন পুলিশের কাছে তথ্য দেয় যে, অপহৃত কলেজছাত্রীকে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের একটি রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পরে পুলিশের একটি টিম সেখান থেকে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে উত্তরা মডেল থানায় নিয়ে যায়।
আটককৃতদের পরিচয়
এ ঘটনায় কলেজছাত্রীর মা নূরুন্নাহার বাদী হয়ে শুক্রবার অজ্ঞাত ৪ জনকে আসামি করে উত্তরা থানায় একটি মামলা করেছেন।
পুলিশের উত্তরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সাহেদ ফেরদৌস রানা এ বিষয়ে জানান, বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে গ্রেপ্তারকৃতদের নাম বা বিস্তারিত তথ্য দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে কলেজছাত্রীর সাবেক প্রেমিক উত্তরার জসীমউদ্দীন রোডের উত্তরা টাওয়ারের এশিয়ান স্কাই শপের মালিক রুম্মন, তার দুইভাই ও তাদের বাবা। কাফরুলের মিতালী হাউজিংয়ের বাড়ি থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, মেয়েটিকে অপহরণের পর উত্তরার একটি বাসায় নিয়ে শ্লীলতাহানি করে এ দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব এই ভিডিও ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
মা যা বললেন
কলেজছাত্রীর মা নুরুন্নাহার সাইফুল জানান, ফাতেমা ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। বেশ কিছুদিন আগে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ৪/এ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মাহফুজুলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করা হয়। তাদের দু’জনের আংটিও বদল হয়ে গেছে। দুই পরিবারের সম্মতিতেই এই বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, কলেজের পড়ার সুবাদে তার মেয়ের অনেক বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে প্রায় সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতো। কিন্তু ওই কলেজের দু’জন শিক্ষক তাকে প্রায় সময় বিরক্ত করতো। এমনকি তাকে প্রেমও নিবেদন করেছে। তার ধারণা তার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে ওই দুই শিক্ষক বিপ্লব ও অদ্রি তার মেয়েকে অপহরণ করেছিল।
পুলিশের বক্তব্য
উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার নিসারুল আরিফ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই কলেজছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার খবরে তার পুরনো কোনো বন্ধু ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে এ অপহরণ ঘটিয়েছিল। তবে ছাত্রীর মা বা ওই ছাত্রী অপহরণকারীদের চেনে না বলে দাবি করেছেন।’