হত্যার মিশনে অংশ নেয় ২২ জন

7 murderসুরমা টাইমসঃ নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর ও আইনজীবীসহ সাত জনকে অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের চেষ্টায় মোট ২২ জন অংশ নেয়। এর মধ্যে দুই জন ছাড়া সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছিল।
অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের চেষ্টার পুরো বিষয় নিজে উপস্থিত থেকে তদারক করেন র‌্যাব ১১-এর মেজর (অব.) আরিফ হোসেন। হত্যার পর লাশ ফেলে ফেরার পথে লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ ও মেজর (অব.) আরিফ হোসেনকে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়।
এ সময় তারা বলেন, আমরাও আপনাদের মতো ‘ওদের’ উদ্ধারে অভিযানে রয়েছি। এরপর পুলিশ তাদের আর কিছু বলেনি। তবে লে. কমান্ডার এম এম রানা কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই তার ক্যাম্পে ফিরে যান।
রিমান্ডে তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
সূত্র জানায়, অপহরণ থেকে হত্যাকাণ্ড শেষ হওয়া পর্যন্ত নূর হোসেনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেছেন আরিফ। নূর হোসেন ও আরিফের মধ্যে কথোপকথনের একটি অডিও টেপ মামলার তদন্তকারী টিমের হাতে রয়েছে।
নূর হোসেনের সঙ্গে আরিফের সখ্য ছিল আগে থেকেই। আরিফ র‌্যাব-১১ আদমজী ক্যাম্পে যোগদান করার অল্প সময়ের মধ্যে নূর হোসেনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। এরপর থেকে আরিফ হোসেন বিভিন্নভাবে নূর হোসেনের কাছ থেকে ব্যাপক আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। ঢাকার মাটিকাটা এলাকায় একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিয়েছেন। এর টাকা দিয়েছেন নূর হোসেন।
সূত্র জানায়, রিমান্ডে র‌্যাবের তিন কর্মকর্তার বক্তব্য অডিও-ভিডিও দু’টোই করা হয়েছে-যাতে তারা আগের দেয়া বক্তব্য থেকে ফিরে আসতে না পারেন। এছাড়া আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাত জন সাক্ষ্য দিলেও মামলার তদন্তকারী টিম ওই সাত জনের মধ্য থেকে দুই জনসহ চার জনের বক্তব্য আমলে নিয়েছে। এর মধ্যে দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। তবে ছয় কোটি টাকার লেনদেনের কোনো তথ্য উদঘাটিত হয়নি। আদৌ এত টাকা লেনদেন হয়েছে কিনা তারও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে সূত্র জানায়। তবে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছেন টার্গেট ছিল নজরুল ইসলাম ও তার অন্যতম সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন। বাকিরা পরিস্থিতির শিকার।
মোট কথা সাত জনকে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড এবং কিলিং মিশনের সঙ্গে জড়িতদের সব তথ্য-উপাত্ত মামলার তদন্তকারী টিমের হাতে। এখন শুধু সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। সিগন্যাল মিললেই তৈরি হবে চার্জশিট।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানায়, তিন র‌্যাব কর্মকর্তা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেই দ্রুত চার্জশিট দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু তারা জবানবন্দি দেবেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
যেভাবে অপহরণ ও হত্যা: অপহরণ ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ চেকপোস্টের দুই কর্মকর্তা ও রিমান্ডে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, নাসিক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
২৭ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি চাঁদাবাজির মামলায় স্থায়ী জামিন নিতে নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ আদালতে আসবে। এ সম্পর্কে মেজর (অব.) আরিফ হোসেন নিশ্চিত হন। নিশ্চিত হয়েই সকালেই অপহরণ পার্টিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করানো হয়। সাদা পোশাকে একটি টিম নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয়। তারা সার্বক্ষণিক মেজর আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। নজরুল ইসলাম সেদিন তার গাড়ি না এনে তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়ি ব্যবহার করেন। স্বপনের সাদা রঙের এক্স করোলা প্রাইভেটকার যোগে নজরুল ইসলাম আদালত প্রাঙ্গণে আসেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে আদালত থেকে একটি সাদা প্রাইভেটকারযোগে নজরুল ইসলাম বের হওয়ার পরপরই মেজর আরিফের কাছে খবর পৌঁছে দেয় আদালতের আশপাশে অবস্থান নেয়া সাদা পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা। নজরুলের সঙ্গে একই গাড়িতে নজরুলের সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম। গাড়ি ড্রাইভ করে স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর। নজরুলদের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। নজরুলদের বহনকারী গাড়িটি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড হয়ে উত্তর দিকে যাওয়ার পথে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সন্নিকটে (ময়লা ফেলার স্থান) পৌঁছার পর মেজর আরিফের নেতৃত্বে গাড়ির গতি রোধ করা হয়।
নজরুলের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। পরে দু’টি গাড়ি থেকে সাত জনকে র‌্যাবের দু’টি গাড়িতে তুলে নেয়া হয় অস্ত্র দেখিয়ে। গাড়িতে তাদের ওঠানোর পর একে একে প্রত্যেকের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করা হয়। অচেতন হওয়া সাত জনকে কয়েক ঘণ্টা তাদের গাড়িতেই রাখা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিকল্পনা মতে কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভূমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথর ব্যবসাস্থল জনমানুষ শূন্য করার জন্য নূর হোসেনকে ফোন দেয় মেজর (অব.) আরিফ হোসেন। গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর র‌্যাবের গাড়ি ওই স্থানে পৌঁছায়। গাড়ির ভেতরই অচেতন প্রত্যেকের মাথা ও মুখমণ্ডল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়। পরে গলা চেপে ধরার পর একে একে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় সাত জন। পরে সাত জনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামানো হয়।
পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫ নম্বর ঘাট থেকে র‌্যাবের নির্দিষ্ট নৌকা নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের নিচে। লাশগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে যাওয়ার পথে ‘নির্দিষ্ট স্থান’ থেকে লাশ গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। নৌকার মধ্যেই একে একে প্রত্যেকটি লাশের সঙ্গে ইট বাঁধা হয়। একটি করে ফুটো করে দেয়া হয় নাভির নিচে-গ্যাস বের হয়ে যাতে লাশ ভেসে না ওঠে। তারপর শীতলক্ষ্যা নদীর নির্দিষ্ট স্থানে লাশগুলো ফেলে দেয়া হয়।
পুরো অপারেশনে র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ ২০ জন অংশ নেয়। লাশ ফেলে নৌ পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন ঘাট দিয়ে উঠে শহরের ভেতর দিয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছার পথে শহরের হাজীগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্টে লে. কর্নেল তারেক সাঈদ পুলিশের মুখোমুখি হয়। এসময় তারেক সাঈদ দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, ‘আমরা আপনাদের মতো ‘ওদের’ উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছি।’ তখন পুলিশ আর কিছু বলেনি। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডে ফতুল্লা মডেল থানার এক কর্মকর্তার মুখোমুখি হয় মেজর আরিফ হোসেন। মেজর আরিফকে দেখে ওই পুলিশ কর্মকর্তা আর কিছু বলেননি।
ঘটনা স্পষ্ট হওয়ার পরই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: এদিকে অপহরণের পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্পষ্ট হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৫ মে লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেনকে সেনাবাহিনী থেকে এবং নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক প্রধান লে. কমান্ডার এম এম রানাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ১৬ মে রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও আরিফ হোসেনকে (অব.) ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
১৭ মে তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। একইদিন রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় লে. কমান্ডার (অব.) এমএম রানাকে। ১৮ মে আদালত তার আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ২২ মে তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেনকে সাত খুনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ২৬ মে এম রানাকেও সাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জর করেন।
আট দিন রিমান্ড শেষে ৩০ মে তারেক সাঈদ ও আরিফকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে আট দিনের রিমান্ড শেষে এম এম রানাকে সোমবার আদালতে হাজির করে তৃতীয় দফায় সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তৃতীয় দফায় তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ লাইনে আরাম আয়েশে রেখেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
৭ খুন: তদন্ত কমিটির সামনে জেলার নয় পুলিশ কর্মকর্তা: নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি জেলার নয় পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউজে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে এ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।
সাক্ষ্য দিতে আসা নয় পুলিশ কর্মকর্তা হলেন-অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, মো. জাকারিয়া, আজিবুল হাসান (সার্কেল এ), জীবনকান্তি সরকার (সার্কেল জি), আবদুল্লাহ আল মাসুম (এএসপি, ফতুল্লা মডেল থানা), জেলা বিশেষ শাখার পরিদর্শক মইনুর রহমান, সদর মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের পিপিএম, বন্দর থানার ওসি আকতার মোর্শেদ। এর মধ্যে ওসি আকতার মোর্শেদ ছাড়া বাকি আট পুলিশ কর্মকর্তা অপহৃতদের উদ্ধার অভিযান পরিচালনা কমিটির সদস্য।
২৭ এপ্রিল সাত জন অপহরণ হওয়ার পরদিন ২৮ এপ্রিল জেলা পুলিশ প্রশাসন উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য ১২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। অপহৃতদের উদ্ধারে কমিটি কি ভূমিকা নিয়েছিল তা জানতেই মূলত তাদের গণ-শুনানিতে ডাকা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। এছাড়া ওসি আকতার মোর্শেদকে ডাকা হয়েছে লাশ উদ্ধারের সময়ের ঘটনা জানার জন্য। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল।
তদন্ত কমিটির প্রধান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লার নেতৃত্বে কমিটি তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
এর আগে, ২৫ মে নারায়ণগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মনোজ কান্তি বড়াল ও পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত কমিটি। ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাত জনকে অপহরণ করা হয়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ২৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের এসপি ও ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়।
৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া যায়। এরপর ওই ঘটনা তদন্তে আদালতের নির্দেশে ৭ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান আলী মোল্লাকে প্রধান করে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, নিহতের স্বজনদের বক্তব্য নেয়াসহ কয়েক দফা গণ-শুনানি করেছে।