ঐতিহ্যবাহী ছাতক রেলষ্টেশন এখন গোচারন ভুমি

কোন বগিতেই বাতি নেই : বাস্তুহারাদের আবাসস্থলে পরিনত হয়েছে

chhatak rail stationছাতক থেকে ফকির হাসান: ছাতকের ঐতিহ্যবাহী রেলষ্টেশন এখন গোচারন ভুমি ও বাস্তুহারাদের আবাসস্থলে পরিনত হয়েছে। ষ্টেশনের প¬াটফর্মটি বিশ্রামাগার হিসেবে বেঁচে নিয়েছে খেটে খাওয়া ঠিকানাহীন লোকজন। পাশাপাশি মাদকসেবী ও অপরাধীরাও নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে এখানে অবাধে বিচরন করছে। অসামাজিক কার্যকলাপও চলছে দেদারছে। এসব দেখার যেন এখানে কেই নেই। দিনে যেমন-তেমন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই ভ্রাম্যমান পতিতারা এখানে সক্রিয় হয়ে উঠে। বদলে যায় ষ্টেশন এলাকাসহ আশেপাশের ষ্টেশন কোয়ার্টারের দৃশ্যপট। গোটা এলাকা পরিনত হয় এক নরকপূরিতে। প্রায় প্রতিদিনই সকাল-সন্ধায় ট্রেনে সিলেট সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভ্রাম্রমান পতিতাদের এখানে আগমন ঘটে। ট্রেনের একমাত্র ইঞ্জিন ছাড়া যাত্রী বাহীত কোন বগিতে আলো কিংবা বাতির ব্যবস্থা নেই। এতে যাত্রীদের ট্রেন চড়ে যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। ছিনতাইকারিদের ভয়ে রাতের বেলায় ট্রেনে যাত্রীরা চলাচল করতে ভয় পায়। সব মিলিয়ে এখানে যাত্রী সাধারনের জন্য এ রেলপথ যাতায়াতের সম্পূর্ন অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছাতক-সিলেট রেলপথে এক মাত্র খাজাঞ্চি ষ্টেশন ছাড়া বাকী সৎপুর ও আফজলাবাদ ষ্টেশনের একই করুন দশা দেখা দিয়েছে। ষ্টেশনগুলো আছে, ঠিক সময়ে ট্রেন থামছে কিন্তু নেই কোন টিকেট মাষ্টার কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারি। যে যার মতো ট্রেনে যাতায়াত করছে টিকেট ছাড়া। একদিকে এসব ষ্টেশন থেকে সরকার রাজস্ব থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে এসব রেলষ্টেশন এখন গোচারন ভুমি ও বাস্তুহারাদের আবাসস্থলে পরিনত হয়েছে। আফজলাবাদ রেল ষ্টেশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন লোকজন না থাকায় এলাকা পরিণত হয়েছে এক ভূতের ন্যায়। রেলের যাবতীয় সম্পদ এখন পরিত্যক্ত রয়েছে। ষ্টেশন ও আশ পাশের কিছু বাসা বাড়ি, দোকান কোঠা ভাড়া দিয়ে যাবতীয় টাকা পকেটস্থ করছে সংশ্লিষ্ট কর্মচারি। এর সুযোগে দীর্ঘদিন থেকে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন ধরণের অপরাধীরা। এখানে দিনব্যাপী লক্ষ-লক্ষ টাকার জুয়ার আসর বসে এবং দিনের শেষে অপরাধীরা মদপান করে রাতের আধাঁরে পথচারিদের উপর আক্রমন করে স্বর্বত্র নিয়ে যাচ্ছে। এতে এলাকার স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে। এসব জুয়ার আসর থেকে স্থানীয় থানা পুলিশ ও এক শ্রেণীর মাতব্বররা বখরা দিয়ে জবান বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
এক সময়ের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছাতকের রেলপথটির অস্থিত্ব এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বর্তমানে লাইনটি বিভিন্ন সদস্যা-সংকটের কারনে যেকোন সময় এ ষ্টেশনগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ট্রেনের বগিগুলোও নোঙ্গরা ও চলাচলের অনুপযোগী। ট্রেনের কোন বগিতে আলো নেই। যাত্রী বসার আসনগুলোও নোংরা। অপরাধিদের অবাধে বিচরনসহ বিভিন্ন সমস্যার ফলে ছাতকবাসী ট্রেনে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে অনেক আগেই।
রেলষ্টেশন এলাকার জমজমাট পরিবেশ এখন আর নেই। ষ্টেশনের ভেতর ও বাহিরের দোকানপাট এখন আর খোলা হয় না। যাত্রীর পরিবর্তে ষ্টেশন শেডে উদবাস্তুরা বিশ্রাম ও রাত্রী যাপনের স্থান হিসাবে বেঁচে নিয়েছে। এক সময় ছাতক সহ দোয়ারা ও কোম্পানীগঞ্জের সিংহভাগ মানুষ ট্রেন যোগে যাতায়াতের জন্য যথা সময়ের আগেই ষ্টেশনে উপস্থিত হত। টিকেট কাউন্টারের লাইন ধরে যাত্রীরা টিকেট ক্রয় করত। যাত্রী সাধারনের পদ-চারনায় ষ্টেশনের প¬াটফর্ম মুখরিত হয়ে উঠতো। ষ্টেশন মুখি রিকশার লাইন দেখেই তখন বুঝাযেত ট্রেন আসার সময় হয়েছে বা এসে গেছে। দুপুরের ট্রেনে আসা যাত্রীদের নিয়ে সুনামগঞ্জগামী লঞ্চ ছাতক থেকে ছেড়ে যেতো। ট্রেন যাত্রীর অপেক্ষায় অনেক সময় লঞ্চ ছাড়তে বিলম্ব করতেও দ্বিধাবোধ করত না। ষ্টেশনের ভেতরে বাহিরে দোকানিরা জমজমাট বিকি-কিনিতে ব্যস্ত সময় কাটাত। ফেরিওয়ালাদের বিভিন্ন ভঙ্গি ও সুরে নানান পসরা বিক্রিও ষ্টেশন এলাকায় নতুন মাত্রা এনে দিত। এসব ছাতক রেলষ্টেশনের জন্য এখন অনেকটা আষাঢ়ের গল্পের মতই। ১৯৪৭-৪৮ সালে ছাতক-সিলেট রেল স্থাপিত হয়। পূর্ন জনবল নিয়ে প্রথম থেকে ছাতক-সিলেট লাইনে রেল রাজকীয় যাত্রা শুরু করে। জালালাবাদ, সুরমা ও সীমান্ত নামে ৩টি মেইল ছাতক-সিলেট লাইনে নিয়মিত যাতায়াত করতো। রেলপথেই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করতো। এ হিসেবে প্রায় দিবারাত্রী সব সময়ই ছাতক রেলষ্টেশন থাকতো সরগরম। ট্রেন আসা এবং ছেড়ে যাওয়ার সময় সীমা ছিল ছাতকবাসীর নখ-দর্পনে। বর্তমানে এ রেলষ্টেশন ভবঘুরে, অপরাধী ও পতিতাদের অভয়াশ্রম। চরম জনবল সংকটে পড়ে ছাতক-সিলেট রেলপথটি এখন অস্থিত্ব হারাতে বসেছে। ছাতক ষ্টেশন থেকে সিলেট সহ মাইজগাঁও, কুলাউরা, মনু, ভানুগাছ, শায়েস্তাগঞ্জ, আখাউরা, চট্রগ্রাম, সোনাইমুড়ি, বিবাড়ীয়া, ভৈরব, নরসিংদী, টঙ্গী, ঢাকা ও ময়মনসিংহের টিকেট সরাসরি পাওয়া যেত। এখন এখানের টিকেট কাউন্টার কখন খোলাই হয় না। আর এর খবর কে বা রাখে। রেললাইনের বেহাল দশার জন্য ও অব্যস্থাপনাকেই দায়ি করছেন এ অঞ্চলের সচেতন মানুষ। ছাতকের পাথর ও কংক্রিট ¯¬ীপার দেশের অন্যান্য অঞ্চলে রেললাইনে ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারনা, শুধু পাথর পরিবহনের জন্যই এ লাইনটি রাখা হয়েছে। নয়তো অনেক আগেই লাইনটি গুটিয়ে নেয়া হতো। এখন আর এর অস্থিত্বও খোঁজে পাওয়া দুস্কর হত। তীব্র জনবল সংকট ও নজরদারির অভাবে ছাতক রেলের এ ডিপার্টমেন্ট দূনীতির আখরায় পরিনত হয়েছে। ফলে রেলের কোটি-কোটি টাকার সম্পদ যে যেভাবে পারছে লুটেপুটে খাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী রেল পথে সুন্দর ও নিরাপদে যাতায়াতের জন্য এ অঞ্চলের মানুষ আর কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে- এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র।