অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর
এমদাদুল হক, মৌলভীবাজারঃ হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, আর অজস্র নদী খালের দেশ এই বাংলাদেশ। ভৌগলিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্টের দিক থেকে বিবেচনা করে এ দেশের হাওরকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এই তিন শ্রেণীর হাওর এলাকা মৎস্য সম্পদ, পানি সম্পদ, কৃষি এবং আর্থ সামাজিক শতর্ গুলো ভিন্ন রুপে প্রতীয়মান। হাকালুকি হাওরের ভূ-তান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য উজানে রয়েছে উচু পাহাড় শ্রেণী । মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়- জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে মাদার ফিসারী নামে খ্যাত হাকালুকি হাওর অবস্থিত। এ হাওরের আয়তন ১৮, ১শ ১৫ হেক্টর তার মধ্যে শুধু মাত্র বিলের আয়তন ৪ হাজার ৪ শত হেক্টর এবং জল মহালের সংখ্যা মোট ১শ ৩১ টির মাঝে ২০ একরের উর্ধ্বে ৫০ টি ও নীচে ৮১ টি বিল বিদ্যমান রয়েছে। হাওরের বুকচিরে সুনাই, জুড়ী, দর্শনা, বালিছা, নদীসহ মোট ১৩ টি নদী ও ছড়া প্রবাহিত হয়েছে। তাই এখানে প্রাকৃতিক ভাবে পাখিদের বিশাল খাদ্য ভান্ডার গড়ে উঠায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও এই হাওর অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর প্রাায় ৫ লাখ প্রজাতির পাখির মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়। ইউরোপ আর এশিয়ায় আছে প্রায় ৬শ প্রজাতির পরিজায়ী পাখি। এসব পাখির মধ্যে প্রায় ১শ ৫০ প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে আসে। কিন্তু এর দুই তৃতীয়াংশেরই অবস্থা বিপন্ন ও নাজুক। সাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশে ঝাঁকে ঝাঁকে দল বেধে অতিথি পাখি আসে। উত্তর গোলার্ধ অর্থাৎ বরফাচ্ছন্ন শীত প্রদান দেশ থেকে কনকনে ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ায় সুখ অনুভব করতে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আসে অতিথি পাখি এই হাওরে। সূর্যোজ্জল, রৌদ্রজ্জল পরিবেশ ও ঠান্ডা রোদের হিমেল আবহাওয়ার দেশ বাংলাদেশ। শীতের প্রারম্ভেই ওদের পাখনার ঝাপটায় সৃষ্ট নান্দনিক ছন্দে মুখরিত হয় ওঠে বাংলার প্রত্যন্ত জনপদ, নদনদী, খালবিল, হাওর, বিল, জলাশয় ও বিভিন্ন চরাঞ্চল। অতিথিদের গুঞ্জনে কুঞ্জনে সবুজ বন-বনানি পরিবেষ্টিত রুপসি বাংলার নির্জন প্রান্তর তখন সেজে উঠে নতুন সাজে। প্রতি বছরের মতো এবারো বিচিত্র রঙ ও বর্ণের পাখি আসছে এখানে। গরম আবহাওয়ায় খাদ্যের নিশ্চয়তা পেতে পুরো শীত মৌসুমে এরা উড়ে বেড়াবে হাকালুকি হাওর এলাকায়। আর বসন্তের শুরুতেই তাদের অস্থায়ী নিবাস গুটিয়ে নিজ নিজ দেশের উদ্দেশ্যে পারি জমায় । শীত মৌসুম এলেই অতিথি পাখির আগমনের অপেক্ষায় থাকেন পাখি প্রেমিরা। পাখিদের এমন মুখরিত দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখতে অনেককেই দেখা যায় হাওরের আশে পাশে। পাখিরা হাওরপাড়ের হিজল, করচ, বরুণ, আড়াং গাছেই গড়ে তুলে তাদের অস্থায়ী নীড়। দুপুর বা বিকেলে হাকালুকির কয়েকটি বিলে পাখিদের খাবার নিয়ে ঝগড়া কিংবা খাদ্য সংগ্রহের দৃশ্য এখন নিত্য ব্যাপার। হাওরপাড়ের স্থানীয় অধিবাসীরা জানালেন, ইতোমধ্যে বড় বড় দলে হাওরের পিংলা, চাতলা, পরতি, চৌকিয়া, হাওরখাল, মালাম, গৌড়কুড়ি, নাগুয়া, তুরল, ফুটবিলে বিভিন্ন জাত ও রঙের অতিথি পাখির দেখা পাওয়া যায়। ক’দিন পর পাখিদের কিঁচিরমিচির আওয়াজে হাওরপাড়ের চার পাশ মুখরিত হয়ে উঠবে। উপজেলার ভূকশিমইল, সুজানগর ও জায়ফরনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, তাদের প্রতিবেশী অনেকেই এসব বিলে বিভিন্ন কৌশলে ফাঁদ পেতে জাল ও বিষটোপ দিয়ে প্রতিদিন ভোরে, বিকেল ও রাতে পাখি ধরেন । আর এসব পাখি বিক্রি করা হচ্ছে স্থানীয় ভোজন রসিকদের কাছে। এ ছাড়া হাওরের পাশের বাজার কিংবা মৌলভীবাজার, সিলেট বিভাগীয় শহরেও বিক্রি হচ্ছে এসব অতিথি পাখি। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, বিভিন্ন সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে শিকারীরা তাদের সহযোগীদের নিয়ে পাখি শিকার করে বিক্রি করে। এ সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু পাখি শিকারীরা ওদের নিধনে ফাঁদ পাততে শুরু করেছে। এদের কবল থেকে অতিথি পাখি রক্ষায় সংশিলষ্টদের শিগগির কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।