পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে “পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় তাহিরপুর”

TILAকামাল হোসেন,তাহিরপুরঃ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলাটি ভাটি এলাকা হিসাবে পরিচিত হলেও প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌর্ন্দযে ভরপুর। তাই তাহিরপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটদের হাতছানি দিয়ে ডাকে, এক কাথায় পর্যটকদের ভ্রমণকে আনন্দদায়ক ও র্সাথক করে তুলতে পারে এই তাহিরপুর। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে ২৫/৩০ কি. মি. দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কুলঘেষা সীমান্ত ও হাওরাঞ্চল খ্যাত উপজেলা তাহিরপুর।
হযরত শাহ আরেফীন (রহঃ) এর আস্থানা ঃ- তাহিরপুর থানা সদর থেকে ৬/৭ মাইল উত্তরে রয়েছে অদৈত্ব মহাপ্রভুর আখড়া। এখান থেকে আরও ২ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে অপরূপ দর্শনীয় স্থান ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফর সঙ্গী সাধক পুরুষ হযরত শাহ আরেফীন (রহঃ) – এর স্মৃতিবিজরীত পুন্যভূমি লাউড়ের গড়ের শাহ আরেফীন আস্থানা । সেই উপলক্ষে দুই সাধক মহা পুরুষের ভক্তরা বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে দুই ধর্মের মেলা বসায়। এছাড়াও এখানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে শত শত আউলিয়া ভক্তরা এসে সমবেত হন। চলে দিবা রাত্রি আবহমান গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী বাউল, জারিশারি,মোর্শিদি, ভাটিয়ালিসহ সিলেটের মরমি সাধক হাসন রাজা ও বাউল আব্দুল করিমের গান। যে গান শুনলে মনে করিয়ে দেয় বাংলার ঐতিহ্যের কথা।
যাদুকাটা নদী ঃÑ হযরত শাহ আরেফীন (রহঃ) এর আস্তানার পশ্চিমে তাকালেই চোখে পড়বে মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ভারতের আসাম রাজ্যের গুমাঘাট ষ্টেইট এলাকা থেকে উৎপত্তি ২৩ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে সীমান্ত ও স্রোতস্নেনী যাদুকাটা নদী, এই যাদুকাটা নদীর তীরে এসে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। যেমন ঠান্ডা তার পানি তেমনি স্বচ্চ। যাদুকাটা নদীর বুকে প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে সন্ধা ৭টা পর্যন্ত চলে বালি-পাথর আর শ্রমিকের জীবন SHAHARPIN SHAH MAJARযুদ্ধের জাদুর খেলা। যেন শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন যুদ্ধের এক ইতি কথা। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক যাদুকাটা নদী থেকে বালি আর নুড়িপাথর আহরনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আর সেই নুড়িপাথর ও বালু বড় বড় স্টিল বডি ও কার্গোতে করে চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে । যাদুকাটা নদীর পানি এতোটাই স্বচ্ছ যে নুড়ি আর বালির খেলা দেখা যায় স্পষ্ঠ । নদীর বুক চিরে ভোরবেলা হাজার হাজার ছোট ছোট বারকি নৌকা নিয়ে যখন শ্রমিকরা নুড়ি ও বালি আহরনের জন্য নদীতে আসে, সে যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে রূপ নেয়। তাছাড়াও রয়েছে গভীর জল রাশ্মির খেলা যা দেখে সকলেরই ইচছা জাগে মনের আনন্দে মুক্ত প্রাণে নদীর বুকে গোসল করে (সাতার কাটা) সচ্চ পানির সাদ উপভোগ করার। আর গায়ের বধুরা স্রোতস্নেনী যাদুকাটার বুকে গোসল করে ভেজা গায়ে কলসি কাকে জল নিয়ে বাড়ি ফেরে আর নদীর বালিচরে থেকে যায় গায়ের বধুদের পায়ের চিহ্ন। এই দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন কবি মাইকেল মধুসদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ।
বারেকটিলা ঃ-যাদুকাটা নদীর খেয়া পেরুলেই দেখা যাবে নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে রয়েছে নয়নাভিরাম প্রায় ৩শ’ ফুট সুউচ্চ নয়নাবিরাম বারেকটিলা, জাদুকাটা নদীর তীর থেকে পাহাড়ি আঁকাবাকা উঁচু পথ বেয়ে বারেকটিলার ওপরে উঠলে চোখে পড়ে ঘন সবুজের সমাহার সারিসারি ফলদ,বনজ ও ঔষধী গাছ । টিলার উপর রয়েছে কড়ই গড়া ও রাজাই নামে দুটি আদিবাসী গ্রাম। আদিবাসী বসতির মাঝে মাঝে রয়েছে বাঙালি বসতি । রয়েছে আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি । আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য বারেক টিলার উপর রয়েছে একটি র্গিজা। এখানকার আদিবাসীরা আপনাকে পুরু গ্রাম ও পাহাড় ঘুড়ে দেখাতে সাহায্য করবে। এরা খুব পরিশ্রমি ও অতিথিপরায়ন। এদের ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বাংলা বলার ভঙ্গিটা আপনাকে আর্কষণ না করে পারে না। এবং পাহাড়ের উপর বাংলাদেশ বর্ডার র্গাড জওয়ানদের টহলের জন্য রয়েছে একটি উচু মিনার । যা পর্যটকদের আরও কাছে টানে। বারেক টিলার উপর থেকে দক্ষিন পশ্চিম দিকে থাকালে মনে হয় তাহিরপুর উপজেলাটি নিজের হাতের মুঠোয়। এ যেন বাংলার আইফেল টাওয়ার।
আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন গার্ডেন ঃ- এখান থেকে একটু দক্ষিণ দিকে চোখ মেলালেই দেখা যায় আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন গার্ডেন । এখানে রয়েছে ঘন সবুজের সমাহার । নানা প্রজাতির গাছপালা । সেখানে বসে ঝিরি ঝিরি বাতাসে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন।
বড়ছড়া চারাগাঁও শুল্ক স্থল বন্দর ঃ- বারেকটিলা থেকে মোটরসাইকেলে করে ৩/৪ কি. মি. পশ্চিমে এগোলেই চোখে পড়ে বড়ছড়া চারাগাঁও শুল্ক স্থল বন্দর। বড় বড় ট্রাকে করে ভারত থেকে কয়লা এনে এখানে নামানো হয়। কয়লা ভর্তী ট্রাক গুলো যখন হাজার ফিট উচ্চতার মেঘালয় পাহাড়ের আকাঁ বাকাঁ পথ দিয়ে নিচে নেমে আসে তখন আপনার মনে হবে এই বুজি পড়ে গেল। ট্রাক উঠা নামার দৃশ্যগুলো সত্যি দেখার মত। এখান থেকে কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি হয়ে দেশের বিভিন্ন ইটভাটায় চলে যায় । এসব দেখে আপনি যখন ক্লান্ত হবেন তখন আরএকটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প (বিসিআইসি) এলাকা।
ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প ঃ- এখানকার নিঝুম প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে যাবে এক কাব্যময় ভুবনে। ছোট ছোট টিলা আর ছায়াময় বৃক্ষেঘেরা পুরো খনি প্রকল্পটি ঘুরে দেখলে নয়ন জুরিয়ে যাবে। টেকেরঘাট চুনাপথর খনিজ প্রকল্প (বর্তমানেবন্ধ)রয়েছে ।অতিথে ছাতক সিমেন্ট প্যাক্টরীর কাচা মাল এখান থেকে সরবরাহ করা হত। আছে একটি রেস্ট হাউজ । রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরবিক্রম সিরাজের সমাধি । এখানে একটু সময় বিশ্রামের পর মোটরসাইকেলে আবার যাত্রা শুরু করেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে শ্রীপুর বাজারে । বাজারে পৌঁচলেই হালকা কিছু খেয়ে নিন।
টাঙ্গুয়ার হাওর :এবার মোটরসাইকেল ছেড়ে দিয়ে ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকায় আকাঁ বাকাঁ নদী পথ বেয়ে এ উপজেলার আরেকটি পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি সৌর্ন্দযের স্থান টাঙ্গুয়ার হাওর ।
জলজল হাওড়ের ডাক, পরিযায়ী পাখিদের অভয়াশ্রম টাঙ্গুয়ার হাওর ঃ- যাকে বলা হয় ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট। জলজল হাওড়ের ডাক । (শরৎঋতুতে) পরিযায়ী পাখিদের অভয়াশ্রম (শরৎঋতুতে) জলাশয় নানা প্রজাতি মাছের আবাসন। উত্তর দিগন্তে মেঘছোঁয়া সবুজ পাহাড়। সবকিছু মিলিয়েই সথ্যিই যেন টাঙ্গুয়া নিসর্গের আকর্ষন অর্পুব। এ যেন পর্যটনের স্বর্গরাজ্য। এখানে শাপলা ফোঁটা জলে দল বেধেঁ হাসঁ ডুবসাঁতারে গুগলি শামুক খাচ্ছে। কোমরে খলই বাধাঁ কাদেঁ ঠ্যালা জাল কিশোরের দল মেঠো পথে হাঁটছে জলাশয়ের দিখে। এ যে শিল্পীর জলরঙের চলমান গ্রাম চিত্র। দিগন্ত ছোঁয়া তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলার ২৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ৫০ টি বিলের টাঙ্গুয়ার হাওর। এ অঞ্চলের জন কন্ঠে প্রচলিত আছে “৬ কুড়ি কান্দা আর ৯ কুড়ি বিল” এর নাম হল টাঙ্গুয়ার বিল। সত্যি বলতে কি দিগন্ত ব্যাপ্ত জল আর জল চিক চিক তরঙ্গ রাশ্মি। পশ্চিমে কুশিয়ারা নদী পূর্বে জাদুকাটা নদী টাঙ্গুয়া ছোয়েঁ। উত্তরে মেঘালয় পাহাড়। ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় তিন চার হাজার ফিট উচ্চতার সবুজ পাহাড়ে ঘেরা । নিসর্গে মেঘ পরীদের হামাগুড়ি। এখানে বরফ আর নৌ হোটেল থাকলে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের ডাক লেককেও হার মানাত। গোধুলির সোনালী মেঘে এ হাওর যেন রোমান্টিক হয়ে ওঠে। ফুরফুরে বাতাসে নৌকার ছইয়ে বসে দোলা খাওয়া পর্যটকদের একটা মনোরম মাত্রা এনে দেয়। এযেন বর্ননাতীত ভ্রমন জগৎ। নৌকার ছইয়ের উপর আরাম দোলায় ষোলকলার চাঁদনী রাত হয়ে উঠে এক দাম চাঁদের বুড়ির সাথে আলাপ চারিতার মত। চোখ বন্ধ করলেই যেন মনে হয় সুরমা ধনুদিয়ে ভেসে চলছি মেঘনায়। জীবনান্দের কবিতার মত হয়ে উঠে ছন্দপ্রাণ। টাঙ্গুয়ায় নৌকা ভাসান শরৎ মেঘের লুকোচুরির জ্রোৎনা ধোঁয়া অবকাশ পর্যটন। হাওরের শৈবাল উদ্যানের বুক থেকে ওঠে কলে¬াল। টাঙ্গুয়ায় ভাসতে থাকা সূর্র্যোদয়ের লৌহিত আলোয় আর গোলাবাড়ির হিজল, করচ বনের অতিথি পাখিদের কলরব মুগ্ধ টাঙ্গুয়া। অতিথি পাখিদের ডাকাডাকি আর হাওরের চিক চিক জলরশ্মির কলে¬ালে ঘুম ভাঙে জলদাসদের। টাঙ্গুয়ার হাওর এ যেন নির্সগর রূপ কথা। মেঘ জল প্রকৃতির কথা। সাইবেরিয়ান পরিযায়ী পাখিদের এ হাওরে রিফিউজি হয়ে অতিথি হিসাবে সংসার পাতার গল্প।
গাছ, মাছ ও পাখিদের অভয়াশ্রম, শীত মৌসুমে এখানে দেখা মেলে নানা প্রজাতির অতিথি পাখির । এখানে প্রতিদিনই হাজারো দেশী – বিদেশী পর্যটকদের আগমন ঘটে। গতকাল শুক্রবার ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প আর বারেক টিলাতে ঘুরতে আসা পর্যটক আল আমিন এর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের আগানগর গ্রামে তার বাড়ি। কিন্তু তিনি ৫ বছর আগে ইতালী (ইউরুপ) চলে যান। ইতালী থেকে গত কয়েক দিন হয় বাংলা দেশে এসেছি। এসেই বন্ধুদের কাছ থেকে তাহিরপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা শোনে দেখতে আসি। আসলে (সত্য) জায়গা গুলো খুবই সুন্দর কিন্তু এখানে আসা পর্যটকদের জন্য থাকা খাওয়ার কোন সুব্যবস্থা না থাকায় কষ্ট করতে হয়। তিনি আরও বলেন থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা থাকলে আরও কিছু দিন থাকতেন। তাহিরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানিতে প্রতিদিন তাহিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটলেও এখানে তাদের থাকা খাওয়ার কোন সু- ব্যবস্থা নেই । অবকাঠামোগত উন্নয়ন না থাকার ফলে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকার পর্যটন শিল্পে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।