আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে অনিশ্চিত গন্তব্যে সৌদি আরব!

saudi arabia_abdullahসুরমা টাইমস ডেস্কঃ ক্ষমতা, বিভিন্নভাবেই তা একটি পারিবারিক ব্যবসা। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বুশ-ক্লিনটন পরিবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে নজর রাখলেও আপনি হয়তো এ ধারণা সম্পর্কে আরো কিছু বিষয় পরিষ্কার করে বুঝতে পারবেন।
সৌদি আরবেও একই দশা। তবে সৌদি আরবের রাজনীতিতে পারিবারিক ব্যবসার পরিসর আরো ব্যাপক। আর সৌদি আরবের রাজনীতির সঙ্গে অর্থকড়ির বিষয়টি আরো ব্যাপক পরিসরে সংশ্লিষ্ট। আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে অনিশ্চিত গন্তব্যে সৌদি আরব!
যাইহোক, দুঃসংবাদটি হল সৌদি রাজ পরিবারের রাজনীতি ব্যবসা এই প্রথমবারের মতো হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কারণ আরব উপদ্বীপসহ পুরো আরবজাহানজুড়েই রাজ-পরিবারগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে।
গত কয়েকবছরে লিবিয়ার গাদ্দাফি এবং মিশরের হোসনি মোবারকের পরিবারের মতো দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা পরিবারগুলোর পতন ঘটেছে ব্যাপক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ও কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে।
King Abdullah এই পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি রাজ পরিবারের সমালোচকরাও দেশটির ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ-সংঘাতের ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। বিশেষকরে গত শুক্রবার বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজের মৃত্যুর পর থেকে আরো জোরালোভাবে এই ভবিষ্যদ্বানী শুরু করেছেন তারা।
সমালোচকরা প্রত্যাশা করেছিল, আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে সৌদির শাসক পরিবারের ভেতরকার প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার ফাটল ও বিরোধ চরম আকার ধারণ করবে। আর ওই সংঘাত সৌদি আরবের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তেমনটি এখনও ঘটেনি।
এবং আপাতত দেখা যাচ্ছে যে, সংকটময় মুহূর্তেও কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয় সে পারদর্শীতাও প্রদর্শন করছে সৌদি রাজপরিবার। বাদশাহ আব্দুল্লাহর মৃত্যু ও দাফন-কাফনের পর যত দ্রুত সম্ভব তার উত্তরসূরি নির্বাচন করা হয়েছে।
২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে বসে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আল সৌদ রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাকে কোন পদে নিয়োগ দেওয়া হবে তা নিয়ে একটি সুদুরপ্রসারি তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তার ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হল- নতুন রাজা সালমানের তার সৎভাই প্রিন্স মুকরিনকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগদান এবং সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন।
প্রিন্স মুকরিন সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান এবং সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতার বেঁচে থাকা সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।
আর মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগদান সিংহাসনের উত্তরাধীকার নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে ভবিষ্যতে ঠিক কী ঘটবে তা এখনই স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। আর দীর্ঘমেয়াদী উত্তরাধিকার নিয়েও ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে তাও নিশ্চিত। গত কয়েকবছরধরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়।
রাজপরিবারের আভ্যন্তরীন রাজনীতির পাশাপাশি দেশের ভেতরে এবং বাইরেও সৌদি আরবের শাসক পরিবারের প্রতি হুমকি বহুগুনে বেড়েই চলেছে।
স্বদেশে সৌদি রাজপরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হল, দেশটির ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক সংকট। আর এই সংকট থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান এখনো কেউ হাজির পারেননি।
দেশটিতে এখন বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। অন্যদিকে জনসংখ্যাও বাড়ছে অব্যাহত গতিতে। আর দেশটির তরুণরা পরিবর্তনের জন্য অস্থির ও ক্ষুধার্ত হয়ে রয়েছে।
king abdullahসৌদি আরবের বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের ক্যারিয়ারে উন্নতির জন্য সরকারি চাকরির উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, দেশটির মানবাধিকার পরস্থিতি সারাবিশ্বেই নিন্দা কুড়োচ্ছে। সৌদি আরব নারীদের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে আছে। গাড়ি চালানোসহ চলাফেরা এবং অসংখ্য বিষয়ে দেশটির নারীদের কোনো স্বাধীনতা নেই। আর নারীদের এই দুর্দশাই বিশ্বব্যাপী দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠার প্রধান কারণ।
এদিকে সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার কেন্দ্র দেশটির রাজধানী রিয়াদের বাইরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটা অব্যাহত রয়েছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলের শিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েই চলেছে।
পার্শ্ববর্তী বাহরাইন সুন্নী শাসিত হলেও দেশটিতে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনই সংখ্যাগুরু। দেশটিতে সুন্নী শাসকদের বিরুদ্ধে শিয়াদের বিদ্রোহ চলছে, যা সৌদি আরবের রাজপরিবারের জন্যও একটি অশনি সংকেত। অন্যদিকে, ইয়েমেনের শিয়া বিদ্রোহীরা সম্প্রতি দেশটির সুন্নী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
কিন্তু সৌদি রাজপরিবারের সবচেয়ে বড় শত্রু হল, ইরান। আর সৌদি আরবও মনে করে তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্রের পেছনেই তেহরানের হাত রয়েছে।
সৌদি আরব ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তবে শিয়া জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে ইরাকের উপর ইরানের প্রভাব বিস্তার নিয়েও ব্যাপক ভীতিতে রয়েছে সৌদি আরব।
এছাড়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বহুমুখী অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার জঙ্গি সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটও সৌদি আরবের জন্য একটি বড় আঞ্চলিক হুমকি হয়ে উঠছে।
এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সৌদি সফর দেশটির ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের জন্য বড় একটি আস্থার উৎস হয়ে উঠবে।
বিশাল এক অনুগামী বহর নিয়ে ওবামা সৌদি সফরে গেছেন। তার ওই সফরের মধ্য দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে। ইরান ইস্যুতে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক টানাপোড়েন গেছে। তবে সম্পর্ক অটুট রয়েছে।
কিন্তু পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের সম্পর্ক অটুট থাকায় অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকই বিস্মিত হচ্ছেন। অনেকেই এটা বুঝতে পারছেন না কেন গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিশেষকরে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সৌদি রাজ পরিবারের সঙ্গে এখনো সখ্যতা বজায় রেখেছে।
এর একটি কাঁচা উত্তর হতে পারে সৌদি রাজপরিবারের হাতে প্রচুর অর্থ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অর্থ এ ক্ষেত্রে একটি উপাদান মাত্র।
সৌদি রাজপরিবারের হাতে প্রচুর নগদ টাকার রিজার্ভ আছে। গত কয়েকদশক ধরে তারা এই রিজার্ভ গড়ে তোলেন।
আর পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাংকিং থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পর্যন্ত সব খাতেই সৌদি রাজপরিবারের অর্থ বিনিয়োজিত আছে। আর পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের সখ্যতার আরেকটি বড় কারণ হল সৌদি আরবের তেল।
সম্প্রতি এমন এক সময়ে এসে সৌদি আরব বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে যখন রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র বিরোধ চলছে। সৌদি আরব তেলের মূল্য কমিয়ে দেয়ায় রাশিয়ার অর্থনীতি প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই সুখকর হয়েছে।
সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি এবং পশ্চিমা স্বার্থ ও মূল্যবোধের বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সৌদি আরবের ধনী নাগরিকদের গোপন অর্থ সহায়তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে কেন সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারছে না তা বুঝতে হলে বিষয়টি নিয়ে এমন কোনো মার্কিন নেতাকে প্রশ্ন করতে হবে যিনি সৌদি রাজ পরিবারকে বাদ দিয়েই একটি মধ্যপ্রাচ্যের কল্পনা করেন।
কিন্তু বাস্তবতা হল, সৌদি রাজপরিবারকে বাদ দিয়ে একটি মধ্যপ্রাচ্যের মুহূর্তের কল্পনায়ও ওয়াশিংটনের বেশিরভাগ নীতি-নির্ধারকের শিরদাঁড়া অবশ হয়ে আসবে!