পালেরমো পৌরসভার নির্বাচনে বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করেছে সিলেটি ডালিয়া আক্তার সুমি
নাজমুল হোসেন ,ইতালি থেকেঃ নারী রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ গনতান্ত্রিক বিশ্বে এক দৃষ্টান্ত স্তাপন করেছে। সংসদ নেতা ও সরকার প্রদান একজন নারী। সংসদ উপনেতা বিরোধীদলীয় নেতা,স্পীকার ও নারী। বাংলাদেশ এ অর্জন অর্থনীতি সহ সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে। ঠিক তেমনি প্রবাসেও বাংলাদেশি নারীরা থেমে নেই। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন কর্মসংস্থান ব্যবসা বাণিজ্য ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের যুক্ত করে বাংলাদেশ এর মুখ উজ্জ্বল করে যাচ্ছেন। পরিবার ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নারী অধিকার নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার যে প্রত্যাশা তা যেন দিন দিন এগিয়ে চলছে। যার একটি প্রমান ইতালির পালেরমোতে বসবাসরত বাঙ্গালী মেয়ে ডালিয়া আক্তার সুমি। পালেরমো পৌরসভার উপদেষ্টা পরিষদ নির্বাচনে ৮ জন বাংলাদেশী প্রার্থীর মধ্যে সবথেকে বেশী ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে পালেরমোর বাংলাদেশীদের জন্যে রচনা করেন নতুন এক ইতিহাস।
২০১৩ সালে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত পালেরমো কমুনির উপদেষ্টা পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ তরুণপ্রজন্ম পালেরমো ইতালি সংগঠনের সর্বসম্মতি ক্রমে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। তিনি সে সময় বাংলাদেশ তরুণ প্রজন্ম পালেরমো সংগঠনের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। উক্ত নির্বাচনে ৮ জন বাংলাদেশী প্রার্থী সহ অন্যান্য দেশের মোট ৪৫ জন প্রাথী অংশগ্রহন করেন তার মধ্যে সুমি ৬০৯ টি ভোট পেয়ে বাংলাদেশী প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম ও ৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে বিজয় লাভ করেন।উৎসব মুখর এই নির্বাচনে ৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ২১ জন নির্বাচিত হন এবং ৮ জন বাংলাদেশী প্রার্থীর মধ্যে প্রথম সুমি, ৪৪০ টি ভোট পেয়ে আনোয়ার হোসেন দ্বিতীয় ও মোঃ আল আমিন ৪৩৬ টি ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ।তারপর ২১ জন নির্বাচিত উপদেষ্টার মধ্যে আবার ও ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সম্মানিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুমি দায়িত্ব গ্রহন করেন ।এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশী সহ সকল প্রবাসীরা ইতালিতে প্রথম বারের মত ভোটাধিকার লাভ করেন।
ডালিয়া আক্তার সুমি ১৯৯০ সালে মৌলভীবাজার জেলার রাজাপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে পরিবারের সাথে পালেরমোতে অভিবাসিত হন যেখানে তিনি ক্লাশ ২ থেকে পড়াশোনা শুরু করেন, পড়াশোনায় খুব মনোযোগী হওয়ায় খুব অল্প সময়েই ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী হয়ে উঠেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি পা রাখেন পালেরমোর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, ২০০২ সালে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পালেরমোর হাত ধরে প্রথম বারের মতো সিনেমা ফিনকিয়ারতে নৃত্য পরিবেশন করে মুগ্ধ করেন পালেরমোবাসীকে তার এই নৃত্য পরিবেশনা পালেরমোর সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে নিয়ে গিয়েছিলো এক নতুন মাত্রায়।তার পর যেন সুমির সামনে এগিয়ে যাওয়া খুব অল্প সময়ে সুমি হয়ে উঠেন সকলের সুপরিচিত।২০০৫ সালে পালেরমো পৌরসভার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশ নিয়ে পিয়াচ্ছা বলনিয়াতে আয়োজিত এক কালচারাল অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন, তার নূপূরের ছন্দে মুগ্ধ করে মন জয় করেছেন দেশী বিদেশী নানান দর্শকের তার পর ২০০৭ সালে পালেরমোর খ্যাতনামা থিয়েটার থেয়াত্র পলিতেয়ামাতে নৃত্য পরিবেশন করেন,একই সালে ইউনিভার্সিটি দি পালেরমোতে একটি কালচারাল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে তিনি অর্জন করেন বিভিন্ন সম্মাননা পুরুষ্কার তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পালেরমো থেকে পাওয়া সম্মাননা ক্রেস্ট।
পড়াশোনা ও নৃত্যের পাশাপাশি খুব অল্প বয়সে সুমি সামাজিক কর্ম কান্ডে জড়িয়ে পরেন। ইতালি ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের একটি দেশ হলেও তাদের নিজস্ব ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করে না বললেই চলে সম্পূর্ণ অন্য রকম একটি ভাষা হওয়ায় তা বিদেশীদের জন্যে শেখা খুবই কঠিন তাই বিদেশীদের বিভিন্ন অফিস আদালতে সম্মুখীন হতে হত নানা প্রতিকূলতার।বিশেষ করে মহিলাদের ডাক্তার বা হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে নিজেদের সমস্যার কথা ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে না পারায় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হত।
মানুষের এই দুরাবস্থা দেখে তিনি এই সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে থাকেন বাংলাদেশী প্রবাসীদের সহজ ভাবে ইতালীয়ান ভাষা শেখানোর জন্যে একটি স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেন,এই পরিকল্পনা মাথায় রেখে তিনি ২০০৮ সালে মকার্তা নামে একটি ইতালীয়ান সংগঠনের সাথে যোগ দেন এবং পালেরমোর তরুণদের নিয়ে একটি ক্রিকেট টিম গঠন করেন ও পাকিস্তান শ্রীলংকান দের সাথে বিশাল টুর্ণামেন্ট আয়োজন করেন, একই সালে তিনি এ এসোসিয়েশন গাঞ্জে অনলুস নামে একটি সংগঠনে যোগ দেন, এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিলো বিদেশীদের জন্যে কাজ করা, এক বছর এই সংগঠনের সাথে কাজ করার পর তিনি তার আরো দুই শ্রীলংকান বন্ধুকে নিয়ে তৈরী করেন ইয়ুথ ইন এ্য়াকশন(যুবসমাজ) নামে একটি এসোসিয়েশন,উল্লেখ্য যে তারা তিন জন গাঞ্জে অনলুস এসোসিয়েশনে একই সাথে কাজ করতেন। তাদের গড়া এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশী ও শ্রীলংকানদের জন্যে ইতালিয়ান ভাষা শিক্ষা ও চর্চার ব্যবস্থা করা সহ সৌজন্য সেবা, পাসপোর্ট সেবা ইত্যাদি দিয়ে আসছেন, বর্তমানে তিনি এই সংগঠনের সম্মানিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্তব্যরত রয়েছেন। ২০০৯ সালে তিনি এ্য়াকাউন্টিং এ ডিপ্লোমা লাভ করেন ,তার পর ২০১২ সালে নিজের শ্রম মেধা ও একাগ্রতা দিয়ে পালেরমো স্টেশন এলাকায় শুধু বাংলাদেশীদের জন্যে একটি বাংলা পাত্রনাত উদ্বোধন করেন তার এই বাংলা পাত্রনাতের মাধ্যমে তিনি কমুনি সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ দক্ষতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন।
নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সুমি শাহ মুহিম আহমেদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, নির্বাচনের মতো একটি বিশাল আয়োজনে তার স্বামী সবসময় তার পাশে থেকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছেন। তার এই গৌরবময় সাফল্যে পৌঁছাতে তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা বাধা বিপত্তির কিন্তু এই সাহসী নারী থেমে যাননি অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা মেধা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তার সপ্ন পূরণের জন্যে কাজ করে গিয়েছেন বাঙ্গালী কমিউনিটির জন্যে। আজ তার মত আরো অনেক তরুন পালেরমোর বাংলাদেশী কমিউনিটিকে আরো সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
সদ্য নির্বাচিত তরুণ এই উপদেষ্টারা পালেরমোর বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নয়ন ও কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাবেন বলে পালেরমো বাসী মনে করছেন।
ইতিমধ্যে তারা বিদেশীদের সুবিধার্থে কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যে একটি মসজিদ ও মন্দির একটি বাংলা স্কুল ও একটি স্থায়ী শহীদ মিনার । অবশ্য এই প্রকল্পগুলি তাদের তিনজনের ই নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে ছিল ।এখন পালেরমো বাসী তাদের মাধ্যমে এই সুযোগ সুবিধা গুলি ভোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।