ভয়াল ৯/১১ এর ত্রয়োদশ বার্ষিকীতে গ্রাউন্ড জিরোতে স্বজন হারানো বাংলাদেশীদের আহাজারি
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ সন্ত্রাসে লিপ্তদের প্রতি ধিক্কার এবং ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় ১১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার পালিত হলো আমেরিকায় ভয়াল সন্ত্রাসী হামলার ১৩তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলায় ধুলিসাত হওয়া ট্যুইন টাওয়ারের স্থান তথা গ্রাউন্ড জিরোতে শোকার্ত মানুষদের আহাজারি আশপাশের পরিবেশকে ভারী করেছিল। নিহতদের নাম খচিত ‘মেমরিয়াল প্লাজা’য় ঐ হামলার অসহায় শিকারদের নাম দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেখানে সন্তানসহ উপস্থিত মনসুরা শাহজাহানের কান্নায় অন্য সকলেই অশ্র“সিক্ত হন। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহান নিহত হন ঐ হামলায়। তার রেখে যাওয়া শিশু সন্তানেরা এখন কৈশোর পেড়িয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। তারাও ছিলেন মায়ের সাথে। তারা এসেছিলেন ফ্লোরিডার টেম্পা থেকে। ঐ হামলায় আরো ৫ বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। তারা হলেন মুক্তাগাছার নূরল হক মিয়া এবং তার স্ত্রী মৌলভীবাজারের শাকিলা ইয়াসমীন, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার হাবিবপুর গ্রামের সাব্বির আহমেদ, সিলেটের গোপালগঞ্জ উপজেলার ভাদেস্বর গ্রামের সালাহউদ্দিন চৌধুরী এবং আবুল কে চৌধুরী। তাদের স্বজনেরাও ছিলেন হাজারো স্বজন হারানো মানুষের মাঝে। কেউ এসেছিলেন নিহত স্বজনের ছবি সংবলিত পোস্টারসহ, আবার অনেকে নিহত স্বজনের ছবি আঁকড়ে ছিলেন পরম মমতা এবং গভীর শ্রদ্ধায়।
নিউইয়র্কের সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, নিউজার্সী এবং নিউইয়র্কের স্টেট গভর্ণর, সিটি মেয়ররাও অংশ নেন গ্রাউন্ড জিরোর অনুষ্ঠানে। গত বছরের মত এবারও সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের নাম উচ্চারণ করেন তাদের স্বজনেরা। প্রথম বিমান আঘাতের সময় সকাল ৮.৪৬ মিনিটে নিরবতা পালনের মাধ্যমে শুরু হয় এ অনুষ্ঠান। এরপর আরো ৩ বার নিরবতা পালন করা হয়। অর্থাৎ হামলা এবং টাওয়ার দুটি ধ্বসে পড়ার সময় সকলে নিরবতা পালন করে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা এবং সন্ত্রাসীদের ধিক্কার জানান। উল্লেখ্য যে,
১/১১ সন্ত্রাসী হামলায় ৬ বাংলাদেশীসহ ৯০ দেশের মোট ২৯৯৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ১৯ ছিনতাইকারীও রয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বরকে ‘ন্যাশনাল ডে অব প্রেয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। হোয়াইট হাউজে মিশেল ওবামাকে পাশে নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিরবতা পালন করেন সকলে। সারা আমেরিকায় নিজ নিজ ধমীয় রীতি অনুযায়ী প্রার্থনা সমাবেশে মিলিত হন আমেরিকানরা এবং সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তবে গত ১৩ বছরেও কী ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে কেউ শিক্ষা নিয়েছেন-এ প্রশ্ন মানবাধিকার সংগঠক ড. পার্থ ব্যানার্জির। নিউইয়র্কের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী ড. ব্যানার্জি এনআরবি নিউজকে বলেন, যেসব কারণে ঐ জঘন্য হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে সুধীজন মনে করছেন সে সব কারণ অপসারণে প্রশাসন সত্যিকার অর্থে কি মনোযোগী হয়েছে? তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর মাস এলেই নানা শংকা তৈরী হয় জনমনে। এর ফলে মুসলিম-আমেরিকানসহ দক্ষিণ এশিয়ানরা ভীতিকর পরিস্থিতিতে নিপতিত হন। আবারো সন্ত্রাসী হামলা হলে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুথী হতে হবে বিরাট এ জনগোষ্ঠি সে আশংকায় ভোগেন।’ তাই সময় থাকতেই সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন এই মানবাধিকার সংগঠক।
ঐ হামলায় নিহত কুমিল্লার শাহজান মিয়ার স্ত্রী মনসুরা শাহজাহান ৪ সন্তান নিয়ে বাস করছেন ফ্লোরিডার টেম্পায়। সেখানকার স্লাই মসজিদে ৫ শতাধিক মুসল্লীর অংশগ্রহনে ১১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে কোরানখানী অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাউন্ড জিরোতে মনসুরা শাহজাহান এনআরবি নিউজকে বলেন, ‘শিশু সন্তান রেখে গিয়েছিলেন তিনি। ওরা এখন বড় হচ্ছে। বড়ছেলে ইউসুফ শাহজাহান (২১) ইউনিভার্সিটি অব টেম্পা থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রশাসনে ব্যাচেলর করেছেন। দ্বিতীয় সন্তান শিরিন শাহজাহান (২০) একই ভার্সিটি থেকে ফিজিক্যাল থেরাপির ওপর ব্যাচেলর করছেন। তৃতীয় সন্তান যানান শাহজাহান ব্যাচেলর করছে একই ভার্সিটিতে বায়োলজিতে। সর্বকনিষ্ঠ লায়লা শাহাজাহান পড়ছে টেম্পা বে টেকে একাদশ গ্রেডে। তারা গ্রাউন্ড জিরোতে নির্মিত ‘৯/১১ মেমরিয়্যাল মিউজিয়াম’ পরিদর্শন করেন। যেখানেই শাহজাহান মিয়ার স্মৃতি চিহ্ন রয়েছে সেখানেই তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মনসুরা শাহজাহান এ সময় বলেন, সেপ্টেম্বর মাস এলেই ওরা ভেঙ্গে পড়ে, আমাকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করে। আমি ওদের কোনভাবেই শান্তনা দিতে পারি না। ১১ সেপ্টেম্বর এলেই ওরা এক ধরনের বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। তিনি প্রবাসীদের দোয়া চেয়েছেন যাতে সন্তানদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়তে পারেন। উল্লেখ্য যে, জনাব শাহজাহান সে সময় বাস করতেন নিউইয়র্কের রকল্যান্ড কাউন্টিতে। তিনি কাজ করতেন ট্যুইন টাওয়ারের ৯৬ তলায়। শার্স টেকনোলজি কোম্পানীর সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার ছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান।
ভয়ংকর ঐ হামলার শিকার নুরল হক মিয়া এবং শাকিলা ইয়াসমীনের নামে নিউইয়র্ক সিটির ব্র“কলীনে থার্ড এভিনিউ এবং ওভিংটন এভিনিউর কর্ণারের নামকরণ করা হয়েছে ২০০৬ সালের ২৪ জুন তারিখে। সেখানে তাদের নাম জ্বলজ্বল করে জ্বলছে নিয়ন বাতির আলোয়। এ দম্পতির নামে মৌলভীবাজারের গিয়াস নগরে শাকিলা আবাসন এবং মুক্তাগাছায় একটি এতিমখানা-কাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শাকিলা ইয়াসমীন (২৬) কাজ করতেন এক নম্বর টাওয়ারে ৯৭ তলায় মার্শ এন্ড ম্যাকলিন্যান কোম্পানীতে। আর স্বামী নূরল হক মিয়া (৩৫) কাজ করতেন ৪ তলা নীচে একই কোম্পানীর অপর অফিসে অডিওভিজ্যুয়াল পরিচালক হিসেবে। তাদের পরিচয় ঘটে নিউইয়র্কে একটি বিয়ের আসরে। এরপর তারা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের প্রথম বার্ষিকী অতিবাহিত হওয়ার আগেই সন্ত্রাসী হামলায় এ দম্পতি হারিয়ে যায় জাগতিক এ বিশ্ব থেকে। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন ফুটফুটে সন্তানের এবং আমেরিকার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠা উজ্জ্বল ভবিষ্যতে সাজানো সংসারের। তাদের সে স্বপ্নকে লালন করে চলেছেন শাকিলার বাবা শরিফ চৌধুরী। শাকিলা ছিলেন তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান। তাই শাকিলার স্মৃতিকে ধরে রাখতে নিজ গ্রাম মৌলভীবাজারের গিয়াস নগরে ৭ একর ভূমি ক্রয় করেন তিনি। নাম দিয়েছেন শাকিলাবাদ। সেখানে নির্মাণ করেছেন ২২টি টিনশেড বিল্ডিং। বসিয়েছেন নলকূপ এবং স্যানিটেশন ল্যাট্রিন। বাড়ির পাশেই তৈরী করা হয়েছে গোয়াল ঘর। রয়েছে একটি পুকুর। দূর থেকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তা যেন শাকিলা স্মৃতি আবাসনের আবেদনকে মহিমান্বিত করে স্বপ্নের নীড় বলে মনে হয়। যাদের ছিল না মাথা গুঁজার একটু ঠাঁই, তাদের কাছে এ যেন স্বর্গের চেয়েও বড়কিছু।