এসএমপি পুলিশ লাইনে বিস্ফোরণের আশঙ্কা
কাইয়ুম উল্লাস :: নিয়ম হচ্ছে গুলি বাংকার পদ্ধতিতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে রাখা হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে গুলি-গ্রেনেড বিস্ফোরণ হলে গুলি-স্পিøন্টার ছিটকে যাবে মাটির নিচ দিয়ে। কিন্তু এসএমপি (সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ) পুলিশ লাইন ভবনের ৩য় তলায় ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে হাজারো গুলি-গোলাবারুদ। আছে বড় বড় গ্রেনেড। যে ভবনে গুলি রাখা হয়েছে, এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হয়েছে বহু বছর আগেই। কিন্তু পরিত্যক্ত সাইনবোর্ড সরিয়ে এটি বাসভবন ও অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদি ভূমিকম্পে ভবনটি ধসে পড়ে বা আগুন লাগে, তাহলে বোমার মতোই বিস্ফোরিত হবে। ঘটবে মারাত্মক ধ্বংসলীলা ।
শুধু কী তাই ? এই ভবনে পুলিশকে গাদাগাদি করে কারাগারের বন্দিদের মতো ঘুমোতে হয়। পাশেই একটি গাড়ির গ্যারেজ। এটিও ব্যবহৃত হচ্ছে পুলিশের বাসস্থান হিসেবে। এসএমপি পুলিশের মতো জেলা পুলিশেরও আবাসন সমস্যা প্রকট।
সরেজমিনে দেখা গেল, নগরীর মিরের ময়দানে এসএমপি পুলিশ লাইন ভবন। ভবনটি তিন তলা বিশিষ্ট। দোতলায় পুলিশ সদস্যরা থাকেন। বড় একটি হলঘর। এখানেই থাকেন প্রায় আড়াই শ পুলিশ। একটি খাটের সঙ্গে লেগে আছে আরেকটি খাট। শোয়ার পর কারো পাশ ফেরানোর জায়গা নেই। অনেক পুলিশ কনস্টেবলকে একই বিছানায় পালা করে ঘুমোতে হয়। ইউনিফর্ম ঝুলছে বিছানার ওপর। টুকটাক জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গাদগাদি করে দীর্ঘদিন ধরে এই ভবনে এসএমপি পুলিশ সদস্যরা মানবেতরভাবে বসবাস করে আসছেন। তদুপরী মাথার উপরে যেন এক জীবন্ত বোমা । সিসিক পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে এ ভবনটি। অথচ এই ভবনের ৩য় তলায় গুলি, গ্রেনেড রাখা হয়েছে। ভূমিকম্প হলে প্রতিনিয়তই পুলিশ সদস্যরা দুর্ঘটনার শঙ্কায় ভোগেন।
পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, এসএমপির বয়স প্রায় ৮ বছর। তখন থেকেই পুলিশ সদস্যরা এখানেই আছেন। বার বার চিঠি চালাচালির পরও আবাসনের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সাবেক পুলিশ কমিশনার অমূল্য ভূষণ বড়–য়া গাড়ি রাখার জন্য একটি টিনশেডের গ্যারেজ বানিয়েছেন। সেখানেও গাদাগাদি করে আরও দেড় শতাধিক পুলিশ বসবাস করছেন। আর রোদে-বৃষ্টিতে থাকছে দামি গাড়ি। এমনকি ওই একটি ভবনের নিচ তলায় রয়েছে খাদ্যগুদাম। ওই ঘরটিতে খাবার সামগ্রী রাখার জায়গা নেই।
এসএমপি সূত্রে জানা গেল, সম্প্রতি এই ভবনের পাশে নতুন ভবন নির্মাণ করতে মাটি পরীক্ষা করে গেছে বিশেষজ্ঞ দল। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে নতুনভবন নির্মাণের কোনো প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না। এসএমপি পুলিশের স্থায়ী লাইন নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বরং নেওয়া হচ্ছে অস্থায়ী উদ্যোগ। দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে একটি তিন তলা বাসা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এটি ব্যয়বহুল ও অপর্যাপ্ত একটি উদ্যোগ বলে অভিযোগ করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এখানে এক শ কনস্টেবল থাকতে পারবেন। কিন্তু তাতে আবাসন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না।
এসএমপি সূত্র আরও জানায়, শুধু কনস্টেবলই নন; খোদ পুলিশ কমিশনারেরই সুন্দর একটি স্থায়ী বাসভবন নেই। এসএমপি নামে মাত্রই, এখানে গত আট বছরে স্থায়ী কোনো কিছুই হয়নি। এমনকি নাইওরপুলস্থ বর্তমান কার্যালয়টি নিয়েও বিতর্ক কাটেনি। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড এসএমপিকে সামান্য কিছু ভূমি দিয়েছিল। সম্প্রতি তারা এসএমপিকে ১০ একর জমি দিয়েছে। কিন্তু পুরোটা ছাড়ছে না। তাই এসএমপির হেডকোয়ার্টার নাইওরপুলে নির্মিত হচ্ছে না। এসএমপি হেডকোয়ার্টার নির্মাণের জন্য দক্ষিণ সুরমার পারাইরচকে ২৫ একর জমি দেখার কাজ চলছে। সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে সময় লাগবে অন্তত পাঁচ বছর। কিন্তু ততদিন এসএমপি পুলিশ কনস্টেবলদের বর্তমান লাইনে গোয়াল ঘরের মতো থাকতে হবে।
একজন পুলিশ সদস্য বলেন, এসএমপি ভবনে জায়গা নেই। থাকছি গ্যারেজে। মাঝে মাঝে গ্যারেজটি গোয়াল ঘরের মতো মনে হয়।
আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানালেন, এখানে যেমন বাসস্থানের পরিবেশ নেই, তেমনি নেই প্রশিক্ষণের স্থান, গোসলের ব্যবস্থা, খেলাধুলার ব্যবস্থা। পুলিশ তো গাদাগাদি করে থাকছেই, এখানে নিরাপদে অস্ত্র রাখারও জায়গা নেই।
এসএমপি অস্ত্রাগারের ইনচার্জ এসআই হায়দার আলী জানান, বর্তমানে এখানে যে অস্ত্রাগার আছে। এরকম আরও তিনটি অস্ত্রাগার দরকার।
এসএমপি পুলিশের রেশন ইনচার্জ এসআই মুহিদুর রহমান জানালেন, এখানে ছোট্ট একটি রুমে ২ হাজার ১২৪ জন পুলিশ সদস্যের রেশন সামগ্রী রাখা হয়। এক সাথে রাখা যায় না। চাল ৪৮ টন, গম ৪৪ টন, ডাল ১২ টন, তেল ১২ টন, চিনি ৭ টন রাখতে হয়। বর্তমান গুদামঘরের মতো আরও দুটি গুদাম নির্মাণ প্রয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা গেল, এসএমপির কনস্টেবলদের রাতে ঘুমানোর জায়গা না থাকায় একটি দল সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে দীর্ঘদিন ধরে ভিআইপি রুমে থাকছে। আবার কেউ কেউ থানা কোয়ার্টারে ও আশপাশ এলাকার বাসাবাড়িতে থাকেন।
সিলেটে বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রায়ই আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। একটা আন্তর্জাতিক মানের খেলা হলে সিলেটের বাইরে থেকে ১০ হাজার পুলিশ আসেন। কিন্তু তাদের থাকার জায়গা নেই। পুলিশ লাইন স্কুল ছুটি দিয়ে সেখানে থাকতে হয় পুলিশকে। কনস্টেবল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবারই একই অবস্থা। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। সরকারের কাছ থেকে বাসা ভাড়ার যে ভাতা পাওয়া যায়, তার তিনগুণ টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া নিতে হয়। এতে কর্মকর্তাদের আবাসন খাতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। এছাড়াও এখানে ফ্যামিলি কোয়ার্টার না থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বেশিদিন থাকতে চান না।
এসএমপির আরআই (রিজার্ভ ইনস্পেক্টর) মো. নুরুল ইসলাম (পিপিএম) বলেন, এসএমপির ৮ বছর। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। শুধু আবাসনই নয়, পানি নেই, অস্ত্রাগার নেই, প্রশিক্ষণের একটি গ্রাউন্ডও নেই। বার বার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
এসএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ( গণমাধ্যম) রহমত উল্লাহ স্বীকার করেই বলেন, এখানে গ্যারেজে থাকছে পুলিশ। থাকার জায়গা নাই। অস্ত্র-গোলাবারুদ আলাদা রাখার নিয়ম। এখানে একসঙ্গে রাখা হচ্ছে। ফোর্সের বাথরুম করার ব্যবস্থা নেই। এই সমস্যা সমাধানে পারাইরচকে ২৫ একর জমি অধিগ্রণ হয়েছে। তবে, কবে সেখানে এসএমপির ভবন হবে তা সুনির্দষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
সিলেট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) নুরে আলম মিনা জানান, পুলিশ লাইনের এই জায়গাটি জেলা পুলিশের। এখানে এসএমপির দু হাজার ফোর্সসহ আরআরএফ ফোর্স ও জেলা পুলিশ ফোর্স থাকছেন। আবাসনের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন। এখান থেকে আরআরএফ ও এসএমপি চলে গেলে জেলা পুলিশেরও আবাসন ভবন করা যাবে।