ধর্ষণের আলামত পরীক্ষায় ডিগ্রি ছাড়াই ৩ চিকিৎসক!!

60266ডেস্ক রিপোর্টঃ পেশাগত ডিগ্রি নেই। নেই কোনো প্রশিক্ষণও। তারপরও তারা করে যাচ্ছেন ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা। এ অবস্থায় পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের কথা, র‌্যাপ ভিকটিম এক্সামিনেশন অদক্ষদের মাধ্যমে করতে গিয়ে কখনো পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষক, কিংবা কখনো ধর্ষণ না করে ফেঁসে যাচ্ছেন কেউ কেউ। আর এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে দেশে ডিপ্লোমা ইন
ফরেনসিক মেডিসিন (ডিএফএম) ডিগ্রিধারী নারী চিকিৎসকের অভাবে। সারা দেশে এ সংক্রান্ত চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৩ জন। এ তিনজন দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ফলে দেশের ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ৬৪টি হাসপাতালের মধ্যে ৬১টিতে ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা করছেন অদক্ষরা। অন্যদিকে ধর্ষণের পর ২৪ ঘণ্টা পার হলে প্রায় ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে যায় আলামত। আর শহর বা গ্রামে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থানা-পুলিশ করে হাসপাতালে পৌঁছুতে বেশির ভাগ নারীর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। অনেকে হাসপাতালে পৌঁছায় এক সপ্তাহ পরও।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক এবং পেশাজীবীদের সংগঠন দি মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি ডা. আ ম সেলিম রেজা বলেন, দেশের ৩১ সরকারি মেডিকেল কলেজের সবটিতেই ফরেনসিক বিভাগে শিক্ষকের পদ খালি। জেলা হাসপাতালগুলোয় তো ফরেনসিক চিকিৎসকের পদই নেই। আর দেশে ডিএফএমধারী নারী চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র তিনজন। ফলে সারা দেশে যারা ধর্ষিতার আলামত পরীক্ষা করছে তাদের পেশাগত ডিগ্রি তো নেইই, কোনো প্রশিক্ষণ পর্যন্ত নেই। এতে অজ্ঞতা ও অদক্ষতার কারণে অনেক সময়ই ধর্ষণের আলামত পরীক্ষায় ভুল প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। পার পেয়ে যাচ্ছে বহু ধর্ষক। এছাড়া এমনিতেই প্রায় ধর্ষিতাকে আলামত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে আনা হয় এক দিন বা তারও পরে।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং আদালত সূত্র মতে, এমবিবিএস পাসের পর ডিপ্লোমা ইন ফরেনসিক মেডিসিন (ডিএফএম) বিভাগ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া চিকিৎসকরা এ বিভাগে যোগদান করেন। এ বিভাগের শিক্ষক ও চিকিৎসকদেরই ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা বা লাশের ময়নাতদন্তের দায়িত্ব। কিন্তু পেশাগত নানা অসুবিধার কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি বা ডিএফএম নিতে অনিহা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজের সবগুলোতে ডিএফএম ডিগ্রিধারী শিক্ষক ও চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধ্যাপকের দুটি পদের মধ্যে একটি এবং সহযোগী অধ্যাপকের দুটি পদই শূন্য। এছাড়া কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ দেশের বেশির ভাগ কলেজ ও হাসপাতালে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক ও চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে। শুধু তাই নয়। জেলা পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ নেই এমন জেলা হাসপাতালে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ বা চিকিৎসকের পদই নেই। দেশে এমন জেলার সংখ্যা প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। জেলাগুলোয় সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জন, অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসক, আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ও মর্গ সহকারী বা কর্মচারীরাই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করছেন। ২০১৪ সালের ২০শে এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ধর্ষিতার মেডিকো লিগ্যাল এক্সামিনেশন ও বয়স নারী চিকিৎসক দিয়ে সম্পন্ন করার আদেশ দিয়েছিলেন। এর আগ পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে পুরুষরাই ধর্ষণের আলামত ও নারীর বয়স নির্ধারণী পরীক্ষা করতেন। ওই আদেশের পর থেকে পরীক্ষাগুলো নারী চিকিৎসক দিয়ে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু দেশের ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ ৬৪ জেলার হাসপাতাল মিলিয়ে ডিএফএম ডিগ্রিধারী নারী শিক্ষক ও চিকিৎসক মাত্র তিনজন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক পদে কর্মরত রয়েছেন একজন। তার নাম ডা. মমতাজ আরা। বাকি দুজন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। অপর দিকে আর কোনো সরকারি হাসপাতালে ডিএফএমধারী নারী শিক্ষক বা চিকিৎসক নেই। ফলে বাকি সব সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোয় ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা করছে অন্য বিভাগের শিক্ষক বা চিকিৎসক, সিভিল সার্জন, আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ও মর্গের কর্মচারীরা।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনা সত্য হওয়া সত্ত্বেও ভুল প্রতিবেদনের কারণে ধর্ষণ প্রমাণ করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওই বিভাগে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ১ হাজার ৫৪১টি মামলা তদন্তের জন্য গেছে। এর মধ্যে ৮৬৮টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে ৫০৮টি মামলার। বাকি ৬৫ মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। ওই দেড় সহস্রাধিক মামলার মধ্যে ধর্ষণের মামলা রয়েছে ৩৪৫টি। এর মধ্যে শতাধিক মামলায় ধর্ষণের আলামত বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে প্রকৃত পক্ষে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও আলামত পরীক্ষায় অদক্ষতার কারণে প্রমাণ না মেলায় ধর্ষণ হয়নি মর্মে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার ঘটনাও রয়েছে বলে জানান একাধিক তদন্তকারী কর্মকর্তা। রাজধানীর বাইরে এই চিত্র আরও খারাপ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ওই মামলাগুলোর মধ্যে মিথ্যা ধর্ষণ মামলাও রয়েছে।
রাজধানীর নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মুক্তা ধর বলেন, তদন্তের বাহ্যিক প্রমাণে ধর্ষণের সত্যতা পাওয়া গেলেও অনেক সময় ধর্ষণ হয়নি মর্মে মেডিকেল রিপোর্টও পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে আমরা বাহ্যিক প্রমাণগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত পরিচালনা করি। ধর্ষিতা দেরিতে ময়নাতদন্ত করানোর কারণে এমনটা হতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চক্রবর্তী লোকবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা যদি সরকারি মেডিকেলে যোগ দেন এবং সরকার তাদের প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়োগ দেয় তবেই এ সংকট ঘুচবে।
দি মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশের পর সরকারি হাসপাতালে পুরুষের মাধ্যমে নারীর ধর্ষণের আলামত ও বয়স পরীক্ষা আর হচ্ছে না। কিন্তু যাদের মাধ্যমে তা হচ্ছে তারা বিষয়ের চিকিৎসক বা লোক নন। এ অবস্থায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ধর্ষণের আলামত পরীক্ষায় সঠিক প্রতিবেদন বা মতামত না পাওয়ার সমূহ ঝুঁকি রয়ে গেছে। – মানবজমিন