বনশ্রীর দুই শিশু হত্যা-রিমান্ডে যা বলছেন মাহফুজা মালেক
ডেস্ক রিপোর্ট :: গতকাল ছিল জেসমিনের পাঁচ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন। তাকে থানার মহিলা হাজতখানায় রাখা হয়েছে। দুজন নারী পুলিশ সদস্য সর্বদা তার সঙ্গে থাকেন। গতকাল সকালে, দুপুরে ও রাতে তিনি স্বাভাবিকভাবে খাবার খেয়েছেন। রাতে ও দিনের বিভিন্ন সময়ে কৌশলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু প্রতিবার জিজ্ঞাসাবাদেই তিনি একই কথা বলছেন। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ নেই বলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তিনি। সূত্র জানায়, তদন্তের প্রয়োজনে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ কারণে হত্যাকাণ্ডের সময় ওই বাসায় থাকা দুই ভাইবোনের দাদি হাসিনা বেগম, তাদের তিন গৃহশিক্ষক, ঘটনাস্থলে প্রথম উপস্থিত হওয়া খালা আফরোজা মালেক নীলা, দুই শিশুর বাবা আমানের বন্ধু জাহিদ, আজিম ও তাদের গাড়িচালকসহ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশের কাছেও একই কথা বলছেন দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেই স্বীকারোক্তি দেয়া মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। তিনি বলছেন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণেই তাদের হত্যা করেছেন তিনি। বর্ণনাও দিচ্ছেন একই। কিন্তু র্যাবের মতো তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরাও এই যুক্তি মেনে নিতে পারছে না। রিমান্ডে নিয়ে নানা কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তারা। জানার চেষ্টা করছে দুই শিশু হত্যার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না। কিংবা জেসমিনের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে আর কেউ সম্পৃক্ত ছিল কি না।
এদিকে দুই সন্তানকে হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন স্বজনরা। তারা মনে করেন, অন্য কেউ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এতে ফেঁসে গেছেন দুই সন্তানের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। এ ঘটনায় দুই গৃহশিক্ষকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। কিন্তু দুই গৃহশিক্ষক কেন তাদের হত্যা করবে বা তাদের লাভ কী- এ বিষয়ে কোনো উত্তর নেই তাদের কাছে। কিংবা জেসমিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না থাকলে কারা হত্যা করলো? শয়নকক্ষে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে জেসমিনও ছিলেন। তার সামনেই যদি অন্য কেউ হত্যা করে তবে তাদের নাম তিনি বলছেন না কেন? এসব কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি স্বজনরা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনাটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। মা নিজেই বারবার স্বীকার করছে সে নিজেই দুই সন্তানকে হত্যা করেছে। হত্যার কারণও বলছে আগের মতোই। এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না তা জানার চেষ্টা চলছে।
নিহত দুই শিশুর খালা আফরোজা মালেক নীলা জানিয়েছেন, বোনের ফোন পেয়ে তিনি যখন ওই বাসায় যান তখন বাসার দরজা খোলা ছিল। তিনি শয়নকক্ষে গিয়ে অরণীকে মেঝেতে ও আলভীকে খাটে দেখতে পান। অথচ বন্ধু জাহিদ জানিয়েছেন, তিনি ওই কক্ষে গিয়ে দুজনকেই খাটে দেখেছেন। কিন্তু ঘটনার বিহ্বলতায় তারা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাননি এটি হত্যাকাণ্ড হতে পারে। তাহলে হাসপাতালে নেয়ার আগে তারা পুলিশকে খবর দিতেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টার কারণে অনেক আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। দুই শিশুকে বাসা থেকে প্রথমে স্থানীয় আল-রাজী হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। এ কারণে দুই শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যায় ব্যবহৃত আঙুলের ছাপ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। তার পরও পুলিশ অন্তত ৮টি নমুন সংগ্রহ করে আদালতের অনুমতি নিয়ে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, এসব পরীক্ষা শেষ হতে অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগবে।
এদিকে জেসমিনের বরাত দিয়ে তার চাচাতো ভাই জামালপুরের চর পলিশা জেএল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সোলায়মান সরকার জানান, ঘটনার দিন ২৯শে ফেব্রুয়ারি গৃহশিক্ষক শিউলি অরণীকে পড়াচ্ছিলেন। আরেক গৃহশিক্ষকের আসার কথা সন্ধ্যার পরে। কিন্তু ওই গৃহশিক্ষক বেলা ৩টার পরেই বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন। একপর্যায়ে জোহরের নামাজ পড়ার অজুহাতে ভেতরে যান ওই গৃহশিক্ষক। নামাজ পড়ার সময়ে ভেতরের কক্ষে ঘুমিয়েছিলেন জেসমিন। ঘুম থেকে জেগে দুই শিশুর নিস্তেজ দেহ দেখতে পান তিনি। সোলায়মান মনে করেন, এখানে রহস্য রয়েছে। এজন্য ওই দুই মহিলা গৃহশিক্ষককে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত জেসমিন নিজেই র্যাবের কাছে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তা বিশ্বাসযোগ্য না বলে মনে করেন তিনি। একইভাবে স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল জলিল বলেন, আমানউল্লাহ আমান উদীয়মান ভালো একজন ব্যবসায়ী। আমান-জেসমিন দম্পতির দুই সন্তানও ভালো স্কুলে লেখাপড়া করতো। সেখানে হত্যাকাণ্ডের যে কারণের কথা বলা হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। এছাড়া তাদের পরিবারের কারও মানসিক সমস্যা ছিল বলেও জানা নেই কারও। জামালপুরের ইকবালপুরের শহীদ আবদুল হামিদ সড়কের জেসমিনদের শান্তি নীড় নামক বাড়িতে গেলে কথা হয় জেসমিনের একমাত্র ভাই জাকির হোসনে সরকার বুলবুলের সঙ্গে। বুলবুল জানান, তার বোন জেসমনি ও ভগ্নিপতি আমানের মধ্যে সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল। জেসমিনের কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না। তবে ২০০০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তার পিতা আবদুল মালেক সরকারের মৃত্যুর পর থেকে রাতে কম ঘুম হয় তার মায়ের। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই বলে জানান তিনি। জেসমিন তার সন্তানদের হত্যা করতে পারে তা বিশ্বাস করেন না বুলবুল। তিনি মনে করেন, অন্য কেউ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তবে কারা ঘটাতে পারে এ সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই তার।
বুলবুল জানান, প্রথম দিকে জেসমিন ও আমানের মায়েরও মনে হয়েছে একদিন আগে বাসায় আনা চাইনিজ খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। জেসমিনের ছোট বোন মিলি যখন ঘটনার পরপর বাসায় যায় তখন আমানের মা তাকে এ কথা বলেন বলে জানান বুলবুল। যে কারণে সন্তানদের ময়নাতদন্তেও অনীহা প্রকাশে করেন জেসমিন।
অর্থ-সম্পত্তি সম্পর্কে আমানের স্বজনরা জানিয়েছেন, আমান-জেসমিনের পরিবার স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু জামালপুর সদরে এবং গ্রামের বাড়িতে তেমন কোনো সম্পত্তি নেই তার। কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই কারও। তবে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এদিকে, দুই সন্তান নুসরাত আমান অরণি ও আলভী আমান হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার মাহফুজা মালেক জেসমিনের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই সাংবাদিক ও স্বজনরা জামালপুরের ইকবালপুরের জেসমিনদের বাড়িতে ভিড় করেন। কিন্তু কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাননি পরিবারের সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি রামপুরা বনশ্রীর বি ব্লকের চার নম্বর সড়কের নয় নম্বর বাড়িতে হত্যা করা হয় অরণী ও আলভীকে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রথমে রেস্টুরেন্টের খাবারের বিষক্রিয়ার কারণের কথা বলা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। তবে ময়নাতদন্ত শেষে ১লা মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস জানান, তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। পরে জামালপুর থেকে দুই শিশুর পিতা আমানুল্লাহ, মা জেসমিন ও খালা আফরোজা মিলাকে আটক করে র্যাব। ৩রা মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায় জেসমনি নিজেই তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। নিহত আলভী আমান বনশ্রীর ওই বাসার পাশের হলি ক্রিসেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের নার্সারির ছাত্র। স্কুলের প্রভাতী (গোলাপ) শাখায় পড়তো সে। আলভীর বোন নুসরাত আমান ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।