তারাপুরের গল্প-স্টার থেকে তারা স্টার থেকে ভিলেন

4466_b8ডেস্ক রিপোর্ট  :: তারাপুর চা বাগানের প্রথম নাম ছিল ‘দি স্টার টি গার্ডেন’। মালিক ছিলেন বৃটিশ ব্যবসায়ী সি কে হার্ডসন। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে বাগানের মালিকানা পান ডব্লিউ আর হার্ডসন। ১৮৯২ সালের ১০ই জুন ডব্লিউ আর হার্ডসন রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে বাগানটি বিক্রি করে দেন বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের কাছে। মালিকানা পরিবর্তনের পর বাগানের নামেরও পরিবর্তন হয় ‘স্টার’ থেকে ‘তারা’- তারাপুর চা বাগান। তারাপুরের সে বাগানটি দখল করে ছিলেন সিলেটে ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত রাগীব আলী। তারাপুরের বাগান ঘিরে তিনি গড়ে  তোলেন আবাসন প্রকল্প, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বাগানের আয়ের কিছু অংশ দান করে কিনে নেন ‘দাতা’র খ্যাতি। সিলেটে নিজেকে গড়ে তোলেন এক ‘স্টার’ বা ‘তারা’ হিসেবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে সে তারারই যেন পতন হলো। আদালতের নির্দেশনা, ৬ মাসের মধ্যে তারাপুর বাগানে প্রতিষ্ঠিত জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ সকল স্থাপনা সরিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে বাগানের পুরনো রূপ। বাগানটিতে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার পূর্বের স্থান।
৪২২.৯৬ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা তারাপুর বাগানটি পুরোটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯১৫ সালে বাগানটির তৎকালীন মালিক বৈকুণ্ঠচন্দ্র গুপ্ত বাগানটিতে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ বছরের ২রা জুলাই রেজিস্ট্রি দলিলমূলে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতার নামে দান দলিল করে দেন। তখন থেকে বাগানটি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবেই পরিগণিত হতে থাকে। দেবতার নামে দান করে দেয়ায় বাগানটি হস্তান্তর অযোগ্য জমিতে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাগানটিকে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করে। দেশ স্বাধীনের পর আবার বাগানটি দেবোত্তর সম্পতির মর্যাদা পায়। বিশাল এ বাগানটিতেই এক সময় চোখ পড়ে রাগীব আলীর। সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তের সাথে যোগসাজশে তিনি বাগানটি গিলে খেতে চান।
১৯৮৮ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর পঙ্কজ কুমার গুপ্ত দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে বাগানটি ইজারা প্রদানের অনুমতি চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। ১৯৮৯ সালের ১২ই অক্টোবর ভূমি মন্ত্রণালয় শর্ত সাপেক্ষে সে অনুমতি
প্রদান করে। অনুমতি পাওয়ার আগেই হস্তান্তরে যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রাখেন পঙ্কজ কুমার। ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাইয়ের কাছে তারাপুর চা বাগানের ৪২২.৯৬ একর জমি বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এরই প্রক্রিয়ায় সেবায়েত পঙ্কজ কুমারের পক্ষে আমমোক্তার হিসেবে রাগীব আলীর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, মেয়ে রোজিনা কাদির, জামাতা আবদুল কাদির ও নিকটাত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদ ১৯৮৮ সালের ১২ই নভেম্বর আবদুল হাইয়ের সাথে বায়নামা দলিল (নং: ১২১৪০) সম্পাদন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বাগানটির সম্পূর্ণ জমি, বাসাবাড়ি, কলকারখানা ৯৯ বছরের জন্য আবদুল হাইকে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে লিজ প্রদান করা হয়। সেবায়েতের পক্ষে কথিত আমমোক্তার দেওয়ান মোস্তাক মজিদ দলিলটি (নং : ২৩৯৫) সম্পাদন করেন।
তারাপুর চা বাগানের পুরো কর্তৃত্ব চলে আসে রাগীব আলীর হাতের মুঠোয়। তিনি চা বাগান পরিচালনার পাশাপাশি বাগানের ভূমিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেন। গড়ে তোলেন নিজের ও তার স্ত্রীর নামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। নিজের অবস্থান মজবুত করে তুলতে লাভের কিছু অংশ থেকে ‘দান-খয়রাত’ও করতে থাকেন। বাগানের আয়ের বাইরে সরকারের কাছ থেকেও ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা ২০ পয়সা আদায় করে নেন তিনি। শাহ্‌জালাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনার কাজে বাগানের জায়গা অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি এ টাকা পকেটে পুরে নেন।
দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তরের নিয়ম না থাকায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে। আলোচনা পৌঁছে জাতীয় সংসদ পর্যন্তও। ১৯৯৯ সালের ২৫শে আগস্ট গঠিত জাতীয় সংসদের ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১০ নম্বর সাব-কমিটি বিষয়টির তদন্তে নামে। বরগুনা-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত সে কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন, খুলনা-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য সদস্য শেখ রাজ্জাক আলী, হবিগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, টাঙ্গাইল-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও রাজশাহী-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য কবির হোসেন। ১৯৯৯ সালের ২০শে নভেম্বর সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সাব-কমিটির সদস্যগণ তারাপুর চা বাগান পরিদর্শনও করেন।
সংসদীয় কমিটির পর্যবেক্ষণেও তারাপুর চা বাগান হস্তান্তরের বিষয়টি অবৈধ বলেই বিবেচিত হয়। তাছাড়া তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে আদেশের প্রেক্ষিতে তারাপুর বাগানটি লিজ দেয়া হয়েছে সে আদেশটির ক্ষেত্রেও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। আদেশে যার স্বাক্ষর ছিলো ভূমি মন্ত্রণালয়ের সেই কর্মকর্তা সংসদীয় কমিটিকে জানিয়েছিলেন, আদেশের কপিতে তিনি স্বাক্ষর করেননি। এমনকি যে শাখা থেকে আদেশটি দেয়া হয় ঐ শাখায় তিনি কখনও দায়িত্বও পালন করেননি। তদন্ত শেষে রাগীব আলীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনাসহ বাগান উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি আসে দখলকারীদের নামে।
হস্তান্তরের বৈধতা নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে। ২০০৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাগীব আলীর বিরুদ্ধে সিলেট সদর উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম আবদুল কাদের কোতোয়ালি থানায় মামলা (নং: ১১৭) করেন। মামলায় ৮০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয় রাগীব আলী, তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, ছেলে আবদুল হাই, মেয়ে রোজিনা কাদির, জামাতা আবদুল কাদির, সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ও দেওয়ান মোস্তাক মজিদের বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালের ২রা নভেম্বর সিলেট দুদকের উপ-পরিচালক আর কে মজুমদার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় আরও একটি মামলা (নং: ১২) করেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের দু’টো চিঠিকে বেআইনি ঘোষণা এবং ও তাদের ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় দায়েরকৃত দুটো মামলার বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ২০০৫ সালে একটি রিট পিটিশন (নং: ৯০০৮) দাখিল করেন আবদুল হাই ও তার বাবা রাগীব আলীসহ অন্যরা। রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি কোতোয়ালি থানায় দায়েরকৃত মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখেন। পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে ২০০৬ সালের ২৩শে আগস্ট বাদীর পক্ষে রিটটির নিষ্পত্তি হয়।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রায়ের বিরুদ্ধে সিভিল আপিল (নং: ১৬৩) দায়ের করে। চলতি বছরের ১২ ও ১৯শে জানুয়ারি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে সরকার পক্ষে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া। বিবাদী পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইন ও হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৯শে জানুয়ারি রায় প্রদান করেন। রায়ে বলা হয়, ৬ মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি না করে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল অন্যত্র স্থানান্তর, কলেজ, আবাসনসহ অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে চা বাগানে রূপান্তর করতে হবে। শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউ দেবতাকে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি ৭ দিনের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ নেয়া ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা ২০ পয়সা সেবায়েতের নামে জমা দিতে হবে। চা রফতানি বাবদ আয়ের ৫ কোটি টাকাও সেবায়েতের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। কোতোয়ালি থানার মামলাগুলোও সচল করার নির্দেশনা দেয়া হয় রায়ে।
মানবজমিন-এর কথা হয় রাগীব আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি শুনেছেন। রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পাননি। রায়ের কপি হাতে পেলে অবশ্যই রিভিউর জন্য আবেদন করবেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদিন জানান, তারাও এখন সার্টিফায়েড কপি পাননি। পেলে আদালতের নির্দেশনামতোই তা পালন করবেন। (মানবজমিন)