সিলেট বাংলা ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ
আজিজুল হক মানিক: এদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবীতে যে আন্দোলন হয়েছিল তা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা ৷ বাংলা আমাদের মাতৃভাষা ৷ রাষ্ট্রভাষা কোনো জাতির সার্বিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷ জীবনকে নিবিড়ভাবে-গভীরভাবে অনুভব ও উপভোগ করার জন্য মাতৃভাষাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ শিক্ষা ও সৃষ্টিশীল কাজের জন্যও মাতৃভাষা গুরুত্বপূর্ণ ৷ মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যুক্ত ৷ রাষ্ট্রভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয় ৷ প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদিতে রাষ্টভাষা ব্যবহৃত হয় ৷
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মাইলফলক ৷ একুশের রক্তস্নাত অধ্যায়ের ফলেই বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মুক্ত হয় ৷ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টম্বর, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ৷ এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক (পরে প্রিন্সিপাল ) আবুল কাসেম ৷ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বাস্তবায়নের জন্য এই সংগঠনটি একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে ধারাবাহিক সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে ৷ ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে রশিদ বিল্ডিং-এ তমদ্দুন মজলিসের অফিসে অনুষ্ঠিত এক সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ৷ এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন তমদ্দুন মজলিসের ড.নূরুল হক ভূঁইয়া ৷ প্রথম সংগ্রাম পরিষদের নাম ছিল ‘তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটি’ ৷ ভাষা-আন্দোলনে এই পরিষদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক ঐতিহাসিক সভা ৷ উক্ত সভায় গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ৷ এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, কলকাতা ইসলামীয়া কলেজের সাবেক ভিপি, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা জনাব কাজী গোলাম মাহবুব ৷ বিভিন্ন সংগঠন ও ছাত্রাবাস থেকে প্রতিনিধির সমন্বয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ৷ সভায় প্রাক্তন মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর, ইসলামী ব্রাদারহুডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন প্রমুখ বক্তৃতা করেন ৷ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে ৷ ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ব্যাপকতায় সরকার ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে ৷ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল, বিক্ষোভ ও সভা-সমাবেশের ব্যাপক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় ৷ সৃষ্টি হয় এক অভাবনীয় গণচেতনা ৷
আমাদের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তে রাঙা একটি দিন ৷ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এদিনে এবং পরবর্তীতে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর, অহিউল্লাহসহ আরো নাম না জানা অনেকেই ৷
মাতৃভাষা বাংলার উন্নতি এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সিলেট বিভাগের জনগণের অবদান নিরপেক্ষ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে ৷ চর্যাপদের ভাষা যেহেতু বাংলা ভাষার আদি লিখিত নিদর্শন বলে স্বীকৃত, সেহেতু বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন স্তরে সিলেট বিভাগের কবিদের অবদান ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা থাকবে ৷ সঙ্গী সাথী বলে কথিত ৩৬০ আউলিয়া সহ হযরত শাহজালাল (রহঃ) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট বিভাগে আসার পর থেকে বাংলাভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রে এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা সংঘটিত হয় ৷ বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক চর্চার জন্যে কঠিন-জটিল বাংলার বিকল্প লিপি হিসেবে জন্ম নেয় ‘সিলেটি নাগরী হরফ’ নামের লিপিমালা ৷ রচিত হতে শুরু করে নানা শ্রেণীর গ্রন্থাদি ৷ অসংখ্য মরমী মারফতী সংগীত রচিত হওয়ার সাথে সাথে সিলেট বিভাগের ভেতর ব্যাপক ভাবে প্রসারতা লাভ করে সূফীইজম ৷ বিংশ শতাব্দীতে এসে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যে বৃটিশ সরকারের সাথে যিনি অদম্য সাহস আর দুর্দমনীয় মনোবল নিয়ে মর্দে মুজাহিদের ন্যায় বৃটিশের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে মৌখিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পর জয়ী হয়েছিলেন, তিনি হলেন সিলেট বিভাগেরই এক ক্ষণজন্মা বীর পুরুষ জনাব আব্দুল হামিদ চৌধুরী ওরফে সোনা মিয়া ৷ জন্মে ছিলেন তিনি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার রনকেলী গ্রামে ৷ বৃটিশদের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও আসাম পার্লামেন্টে বাংলা ভাষার প্রশ্নোত্তরের দাবী আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি ৷ শুধু বৃটিশ যুগেই নয়, পাকিস্তান আমলেও বাংলাদেশের ভেতর সিলেট বিভাগের কৃতি সন্তানেরা পথিকৃৎ হিসবে অগ্রণী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে নজির বিহীন অবদান রেখেছেন ৷
পাকিস্তানের জন্মের পরপরই সর্ব প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ সিলেট’ নামক প্রতিষ্ঠান, এর মুখপত্র মাসিক ‘আল-ইসলাহ’ এবং উল্লিখিত সংসদ ও পত্রিকা সম্পাদক জনাব মুহম্মদ নূরুল হক কাজ করে অগ্রণী বা পথিকৃতের মর্যাদায় সমাসীন হয়েছেন ৷ ১৯৪৭ সালের আগষ্ট সংখ্যা আল-ইসলাহর সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হউক ইহা কখনো সমর্থন করিতে পারি না ৷’ এর পরপরই ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের একাদশ বর্ষের দ্বিতীয় সাহিত্য সভায় মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্যভাষা ৷ এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও লেখক মুসলিম চৌধুরী পাঠ করেন প্রবন্ধ ৷ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক ঐ প্রবন্ধে বিরুদ্ধবাদীদের সম্ভাব্য যুক্তি নাকচ করে দিয়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে জোরালো মত ব্যক্ত করেন ৷ একই সংখ্যা আল-ইসলাহর সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়, ‘বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পাইলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিশেষ বাঙালি মুসলমানদের যে ক্ষতি হইবে তাহা কখনও পূর্ণ হইবে না ৷’ ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হওয়া উচিত এ বিষয়ে আয়োজিত এক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত রস-সাহিত্যিক অনুবাদক মতিন-উদ-দীন আহমদ ৷ উক্ত সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে অভিমত প্রকাশ করা হয় ৷ জনাব মুহম্মদ মুসলিম চৌধুরী এবং তাঁর বড় ভাই এডভোকেট জনাব মফিজ চৌধুরী(মুসলিম লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য) নিবেদিত প্রাণ মুসলিম লীগার হওয়া সত্ত্বেও, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে অন্য কোন ভাষার সাথে আপোষ করতে পারেননি ৷ সেজন্যে চাকুরী যাওয়া বা মাথা কাটা যাওয়ার ব্যাপারে কোন ভয় ছিলোনা তাঁর ৷ তবে, চাকরীর ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত তার তাঁর বড় ভাই সামাল দিয়েছিলেন, সে কথা না বললেও চলে ৷
১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর বিশিষ্ট সাহিত্যিক ডঃ সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা ভাষার স্বপক্ষে একটা ঐতিহাসিক ভাষন দান করেছিলেন ৷ সে ভাষনের সারাংশই পরবর্তীকালে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে কলকাতার ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকাতে ছাপা হয় ৷ ভাষা সংত্রুান্ত প্রবন্ধ সিলেটে পাঠ করার কারণে সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব পাকিস্তান সরকারের বিরাগভাজন হন ৷ এর ফলশ্রুতিতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পরিত্যাগ করে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণে বাধ্য হন তিনি ৷
ভাষা আন্দোলনে সিলেটের মহিলারাও ছিলেন পথিকৃৎ ৷ ভাষা আন্দোলনে সিলেট বিভাগের পত্র-পত্রিকা ছিল পথিকৃৎ ৷সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাতে পর্যন্ত পত্র-পত্রিকার আকাল না থাকায় ‘নও বেলাল’ –এর গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাগুলো একই সময়ে বের হতো সিলেট এবং ঢাকা থেকে ৷ কোন দৈনিক পত্রিকা না থাকায় ‘নও বেলাল’-কেই Leading Newspaper Of East Pakistan বলে গন্য করা হতো তখন ৷ ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের ক্ষেত্রে পত্রিকা ‘নওবেলাল’- এর অবদান সবচেয়ে বেশি ৷ ‘নও বেলাল’-এর মালিক ঝানু রাজনীতিবিদ জনাব মাহমুদ আলী সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন ৷ এ পত্রিার প্রথম সম্পাদক জাতীয় অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফও সুনামগঞ্জের এক নামকরা কৃতি সন্তান ৷ তাঁর জন্ম হয়েছিলো সুনামগঞ্জ শহরের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া মৌজাতে অবস্থিত প্রখ্যাত মরমী কবি নানা দেওয়ান হাছন রাজার বাড়িতে ৷
সিলেট শহরে ১৯৫১ সালের ২২ থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ত্রুমাগত বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ৷ কয়েকদিন দু’বার করে সভা হয় ৷ ২১ফেব্রুয়ারী রাত্রে সিলেটের লোক রেডিও-এর মাধ্যমে জানতে পারেন যে ওইদিন ঢাকায় বেশ কয়েকজন লোক নিহত আর আহত হয়েছেন ৷ ২২ তারিখ শহরে ও শহরতলীতে পূর্ণ হরতাল হয় ৷ ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর কর্মীবৃন্দের উপর শারীরিক হামলার ঘটনা সিলেটেই প্রথম ৷
আমাদের স্বাধিকার, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচক হিসেবে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনকে আখ্যায়িত করা যায় ৷