ভালোবাসা দিবসের স্বপ্ন
স্বপন তালুকদার: ভালোবাসা কি এ নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই।এমন কি কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ভালোবাসা নিয়ে গানে গানে প্রশ্ন রেখে গেছেন।ভাবনা কাহারে বলে, সখি যাতনা কাহারে বলে? তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা সখি ভালোবাসা কারে কয়?সেকি কেবলই যতনময়, সেকি কেবলই চোখে জল, সেকি কেবলই দুখের শ্বাস, লোকে তবে কি সুখের তরে করে এমন দুখের আশ। শেক্সপিয়ার তাঁর এক নাটকের সংলাপে প্রশ্ন রেখেছেন, What is Love? ভালোবাসা নিয়ে যত দু:খ-কষ্ট, বেদনা- সংশয়, নেতিবাচকতা থাক না কেন, সবাই একটুকু ভালোবাসার জন্য হন্য হয়ে খুঁজে বেড়ায়।ভালোবাসা ব্যতীত জীবন জগৎ সংসার যে অচল তা প্রাণি জগতের সব প্রাণির জীবন ধারাতেই বিদ্যমান। বনের হিংস্র প্রাণিও ভালোবাসা পেলে পোষ মানে। মানুষ কেন পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণি খোঁজে পাওয়া মুশকিল হবে যারা ভালোবাসা অনুভব করে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভালোবাসা জরুরি। ভালোবাসাহীন কোন কাজেই সুন্দর ফল লাভ সম্ভব নয়। ভালোবাসা রূপ, রস গন্ধ বর্ণহীন শব্দ হলেও, ভালোবাসা দিয়েই পৃথিবীর অন্য প্রান্ত জয় করা সহজ হয়।ভালোবাসা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধুমাত্র অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। এটি একটি মানবিক নান্দনিক অনুভূতি। ভালোবাসাহীন সকল কর্মই শ্রীহীন। ভালোবাসায় যে জাগরন, তা অন্য কিছুতে পাওয়া শুধু কঠিনই নয়, দুরূহও বটে। ভালোবাসার মধ্যমে জাগিয়ে তোলার, জীবনকে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রকৃত শক্তি নিবিষ্ট। যদিও ভালোবাসার রং-রূপ-গন্ধ কিছুই নেই, আছে শুধু অনুভূতি। বিশেষ কোন বস্তু বা ব্যক্তির জন্য আবেগের স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয় তো এমন মুহূর্তকেই স্মরণ করে লিখেছিলেন, ‘দোহাই তোদের, এতটুকু ভালোবাসিবারে, দে মোরে অবসর।’ জীবজগতের মধ্যে পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্ক হল ভালোবাসা। যার শক্তিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জয় করা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চরিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ভালোবাসা’। একে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ভাগ করা যায়। যেমন: ধর্মীয় ভালোবাসা, বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা, প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা প্রভৃতি। পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীর মধ্যে ভালোবাসা বিদ্যমান। ভালোবাসায় যৌনকামনা বা শারীরিক লিপ্সা একটা গৌণ বিষয়। এখানে মানবিক আবেগটাই বেশি গুরুত্ব বহন করে। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ প্রায় সময়ই অতি আনন্দদায়ক হতে পারে এমনকি কোন কাজ বা খাদ্যের প্রতিও। আর এই অতি আনন্দদায়ক অনুভূতিই হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান, পরিবার, সমাজ এমনকি দেশের জন্যও ভালোবাসা। ভালোবাসা শুধু প্রাপ্তি নয়, ভালোবাসা প্রকৃত যে বিষয় তা হলো ত্যাগ। একে অন্যের জন্য, বিশেষ বস্তু বা কাজের জন্য, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার। কিন্তু দু:খের সাথে বলতে হয় আমাদের প্রায় প্রতিটি কাজেই ত্যাগের মানসিকতার বড়ই অভাব। হীন ব্যক্তি স্বার্থ চরিত্রার্থ করতেই যেন আমাদের প্রতিযোগিতা। এই মাসটি ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় চেতনার মাস, ভাষার দাবি আদায়ের মাস। এ মাসেই রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা আরও অনেকেই আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবেসে জীবন দিয়েছেন। এই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির ভালোবাসা ও ত্রিশ লাখ শহীদের ত্যাগের ফসল। কিন্তু আজ প্রায় প্রতিদিনই ভালোবাসাহীন, অমানবিক কাজের সংবাদ, সংবাদ পত্রে দেখতে পাই, যা আমাদের ব্যথিত করে। গত কিছুদিন পূর্বে প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে পাঁচ বছরের এক শিশুর লাশ, ঝিনাইদহেই তিন শিশুকে ঘরে দরজা বন্ধ করে আগুণে পুড়িয় মারা হয়েছে। যা কিনা সামান্য কটি টাকার জন্য। রাকিব, ত্বকী, সিলেটে রাজন হত্যাকান্ড। কারখানায় আগুণ লেগে মারা যায় মানুষ, গার্মেন্টসে পানি খেয়ে অসুস্থ হলেন শতাধিক, কতজন মারা গেলেন তার হিসাব নেই! হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশুসহ মারা যাওয়া, কত জানা-অজানা অকালমুত্যু ঘটছে। আগুণ লেগে আর ভবন ধসে শ্রমিকের লাশের সারি, ফিটনেস বিহীন বাস-ট্রাক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু তো অবিরাম। তিন দশক আগে নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দাবি জানিয়ে ছিলেন নিরাপদ সড়ক চাই। চার দশক আগে নির্মল সেনের “স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই”। এত বছর পরও এ দাবি পুরন হয়নি। কিন্তু এটা তো একটি সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজের নাগরিকের সামান্য দাবি।আমাদের নাগরিকদের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর বহু পথ চালু রেখেছেন এদেশের স্বার্থপর ক্ষমতাবানেরা, বিত্তশালীরা। এমন কি পাবলিক পরীক্ষার সময় হরতাল অবরোধ মতো রাজনৈতিক সহিংসতা তারও কমতি নেই। বাস-ট্রেনে পেট্রল বোমায় পুড়িয়ে মারা হয় নিষ্পাপ শিশুসহ যাত্রী। এছাড়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে, ধর্ষণ-হত্যা,ঘুষ-দুর্নীতি বিরামহীন অনেক কিছু।তালাক যৌতুকের মতো সীমাহীন কর্মকান্ড। এমন কি বৃদ্ধ মা-বাবার স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে! এতো সব স্বার্থপরতা, মানবিকতাহীন কর্মকান্ড ভালোবাসার অভাব ও অপব্যবহারের বহি:প্রকাশ। পরিবার, রাষ্ট, সমাজ, সংগঠণ সবগুলো প্রতিষ্ঠান ভালোবাসার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই সমাজ, রাষ্ট্র, সংগঠণ, পরিবার যে কোন জায়গা থেকে ভালোবাসার দাবি পুরণে স্ব-স্ব দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশটা শুধু প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা- খালেদা জিয়া বা কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিকবিদেরই নয়। দেশটা আমার আপনারও।এই দেশটাকে বা পৃথিবীটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার, ভালোবাসায় পূর্ণ করে তোলা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব শুধু শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া বা রাজনীতিবিদদেরই নয়, আমাদেরও। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস। প্রতি বছরই এই দিনটি ঘটা করে পালিত হয় সারা বিশ্বে। ভালোবাসা শুধু একটি দিনের নয়। ভালোবাসার প্রত্যাশা প্রতিদিনের, প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার।শুধু একটি দিন ভালোবাসা দিবস পালনের মাধ্যমে এই দিনের গুরুত্ব পুরণ হয়ে যায় না। আর ভালোবাসা শুধু নারী-পুরুষ, প্রেমিক-প্রেমিকার স্ব-স্ব চাহিদা, যৌন লালসা পুরনের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। নিজে ভালো থাকাসহ পাড়া-প্রতিবেশি, রাষ্ট্র-সমাজ-সংসারের সবার ভালো থাকা, পরস্পরের ভালোবাসা পাওয়া, সকলের প্রতিদিনের প্রতিটা কাজের মাঝে ভালবাসার পরশ থাকা অবশ্যক। তাই ভালোবাসা হউক প্রতিদিনের, প্রতিটা কাজেই যেন ভালোবাসার ছাপ থাকুক এ প্রত্যাশা সকলের। পৃথিবী থেকে সবাইকে একদিন বিদায় নিতে হবে, কিছুই নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই যাবার আগে কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের অনুপম সুন্দর গানের ভাষায় এ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক, স্বপ্ন হোক “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে। তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, তোমার করুণ হাসির অরুণ রাগে, অশ্রু-জলের করুণ রাগে। রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে। যাবার আগেযাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে যাও।
সবাইকে ভালোবাসা দিবসের নিরন্তর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।