পাঁচগাঁওয়ের শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা

Durga puja special dance songসজল ঘোষঃ এসেছেন শারদীয় শ্রীশ্রী দুর্গা মা। পূজিত হচ্ছেন ঘরে ঘরে, বিশ্বজুড়ে। মহাসমারোহেই এবার শারদোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে সমস্ত ভুবনেই। মাতৃভূমি বাংলাদেশও এই আনন্দ উৎসব হতে ব্যতিক্রম নয়। সারা বাংলাদেশে শারদ উৎসব ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদ্যাপন হচ্ছে। আমাদের সিলেট বিভাগেও সর্বত্রই দুর্গোৎসব চলছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার পাঁচগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী শারদোৎসবও এবার বর্ণিল আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। এক অলৌকিক ঘটনার পরিপ্রেেিত পাঁচগাঁওয়ে প্রতিবছর দুর্গোৎসব আয়োজিত হয়। পাঁচগাঁওয়ে প্রত্যেক বছর লাখো লাখো ভক্ত-পূজারী দেশ-বিদেশ থেকে আসেন মহামায়ার শ্রীরাঙ্গা রাতুল চরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের প্রত্যাশায়। কী অলৌকিক ঘটনার জন্য পাঁচগাঁওয়ে পূজো হয়? তারই সংপ্তি তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

তিনশ বছর পূর্বে-
তৎকালীন সময়ে পাঁচগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন রাজারাম দাস। এই বিশিষ্ট জমিদার রাজারাম দাসের সাধক পুত্রের নাম সর্ব্বানন্দ দাস। সাধক সর্ব্বানন্দ দাস তৎকালীন সরকারের মুন্সী পদবীর কাজ করতেন। ভারতের আসামের শিবসাগর জেলায় ছিল সর্ব্বানন্দ দাসের কর্মস্থল। ওই সময় তিনি কামাখ্যাধামের পূজা করার বাসনা মনে পোষেন। নিজের বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে যথাবিহিত পূজা করার জন্য স্ত্রী এবং কর্মচারীদের নির্দেশ প্রদান করেন। যথাযথভাবেই কামাখ্যাধানে সর্ব্বানন্দ দাস পূজার আয়োজন করলেন। মহাষ্টমী দিনে পঞ্চম বর্ষীয়া কুমারী পূজা দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে চলতে লাগল। পূজা শেষ হলো। সর্ব্বানন্দ দাস ভগবতীকে প্রণাম করলেন। প্রণাম করার পরই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তিনি অবলোকন করেন। তিনি দেখলেন- কুমারীর পুরো শরীরের বর্ণ পরিবর্তন হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সর্ব্বানন্দ দাস জানতে চাইলেন- মাগো পূজা সুসম্পন্ন হলো কী না? ভগবতী দেবী বললেন, ‘হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এই লাল বর্ণে তোর বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে আবির্ভুত হয়েছিলাম। এখন থেকে এই লাল বর্ণে তুই আমার পূজা করবি।’ সর্ব্বানন্দ দাস ভয়ে ভয়ে বলল- মাগো তুমি যে আমার বাড়িতে আবির্ভুত হয়েছিলে তার প্রমাণ কী? উত্তরে দেবী বললেন, ‘তোর দুর্গা মণ্ডপের বেড়ার উপর আমার হাতের ছাপ রেখে এসেছি, তুই দেখিস তা।’ ভগবতী সর্ব্বানন্দের পূজোয় সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে, সর্ব্বানন্দ দাস ভগবতীর শ্রীপাদপদ্ম কামনা করেন। ভগবতী দেবী অন্য বর চাওয়ার আহ্বান জানালে সর্ব্বানন্দ দাস প্রার্থনা করেন অন্য একটি বর। প্রার্থিক বরটি ছিল- ‘আমার বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে স্থাপিত দুর্গামণ্ডপে তুমি চিরস্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত থাকবে।’ ভগবতী দেবী তথাস্তু বলে তাঁর নিজ মাথার পরিহিত সোনার সিঁথি খুলে সর্ব্বানন্দ দাসের হাতে তুলে দেন। তিনি নির্দেশ করেন- ‘প্রতিবছর মহাস্নানের সময় এই সিঁথি দ্বারা স্নান করানোর জন্য।’ তখন সর্ব্বানন্দ দাস মহামায়ার শ্রীরাঙ্গা রাতুল চরণে লুটিয়ে পড়েন।

পূজোয় বাধা, অতঃপর-
কামাখ্যাধাম হতে সর্ব্বানন্দ দাস নিজ বাড়িতে আসেন। তিনি দেখতে পান, ভগবতী দেবীর হাতের ছাপ পূজো মণ্ডপের বেড়ার উপর। পরের বছর সর্ব্বানন্দ দাস পাঁচগাঁওয়ে পূজোর আয়োজন করা শুরু করেন। ভগবতী দেবীর আদেশ অনুযায়ী মাতৃমূর্তিকে কামাখ্যাধামের কুমারীর শরীরের লাল বর্ণের সাদৃশ্য রঞ্জিত করান সর্ব্বানন্দ দাস। ভগবতীর ধ্যানে উল্লেখ আছে, ‘ভগবতী দুর্গা দেবী অতশী পুষ্প বর্ণভা’। কিন্তু পাঁচগাঁওয়ে ভগবতী দেবীকে লোহিত লাল বর্ণ করে সাজালে- সর্বস্তরের গ্রামবাসী, সর্ব্বানন্দের আত্মীয়স্বজন, গুরু-পুরোহিত বলতে লাগলেন, ‘ভগবতী দেবী লাল বর্ণা শাস্ত্রবিরুদ্ধ’। তারা এই অভিযোগ এনে পূজোর আয়োজন থেকে বিরত থাকার জন্য সর্ব্বানন্দ দাসকে চাপ প্রয়োগ করেন। সর্ব্বানন্দ দাস কামাখ্যাধামের চাুস অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করলে সকলেই একবাক্যে মনগড়া ও পাগলামী বলে পূজোয় যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বৎসর ষষ্ঠ দিন থেকে রাত পর্যন্ত কেউ পূজোয় আসেন নি। পুরোহিতের অভাবে সেদিন দেবীর বোধন সম্পন্ন হলো না। সর্ব্বানন্দ দাস বিচলিত হলেন। তিনি পাগলের মতো ভগবতী দেবীকে ডাকতে লাগলেন। চোখের জলে পূজোমণ্ডপ ভাসালেন। রাত পোহাবার আর কিছু সময় বাকি। এমনি মুহূর্তে গ্রামবাসী, জাতিবর্গ, গুরু-পুরোহিতসহ সর্বস্তরের ভক্ত-পূজারীরা দলে দলে পূজামণ্ডপে আসতে লাগলেন। তারা এসে ভগবতী দেবীকে প্রণাম দিয়ে জানান- ‘ভগবতী দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, লাল বর্ণে পূজো করতে হবে।’ তখনই শুরু হয় মহাসপ্তমির পূজা। ঢাক-ঢোল, শঙ্খ-ঘণ্টা এবং উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পূজামণ্ডপ। সে বছর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যেই ভগবতী দেবীর পূজা সম্পন্ন হয়।

খণ্ডিত মহিষ জীবিত-
জনশ্র“তি রয়েছে- সর্ব্বানন্দ দাস তাঁর গুরুকে বলেছিলেন- তন্দ্রে যেমন মহাবলী দেবার বিধান আছে, তেমনি সাধন বলে খণ্ডিত মহিষকে জীবিত করারও বিধান রয়েছে। গুরুদেব সর্ব্বানন্দ দাসের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, খণ্ডিত মহিষকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। সর্ব্বানন্দ দাস খণ্ডিত মহিষকে কেউ স্পর্শ না করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি পূজামণ্ডপের চারিদিকে সন্ধ্যার পর থেকে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সন্ধ্যার পর একটি বড় মশারি দ্বারা মহিষকে আচ্ছাদিত করা হয়। এরপর খণ্ডিত মস্তক মহিষের গলার সঙ্গে সংযোজন করেন সর্ব্বানন্দ দাস। তারপরেই গুরু-শিষ্য দু’জন মিলে সারারাত মশারির ভেতর বিধিমতো তান্ত্রিক পূজা সম্পন্ন করেন। ভোরের সূর্য উদিত হবার পর সর্ব্বানন্দ দাসকে নিয়ে সেই মহিষ দণি দিকে দৌগ শুরু করে দিল। তার সাথে সাথে গুরুদেবও কমন্ডলু হাতে নিয়ে দৌড় দিলেন। নাগের বাড়ির পুকুর পাড়ের কাছে যাবার পর গুরুদেব কমন্ডলু থেকে মন্ত্রপূত জল মহিষের উপর ছিটিয়ে দেন। এর পরপরই মহিষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায়। সেই সময় মহিষের গলায় মস্তক সংযোজন করা হয়।

অসন্তুষ্ট দেবী, সর্ব্বানন্দ দাসের নির্দেশনা-
প্রায় ২-৩ বছর পর সর্ব্বানন্দ দাস কামাখ্যাধামে গিয়ে পুনরায় কুমারী পূজা করেন। সর্ব্বানন্দ দাস কুমারী দেবীর কাছে জানতে চাইলেন, তার বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে পূজো সম্পন্ন হচ্ছে কী না? উত্তরে দেবী বললেন, ‘গত বছর নবমীর দিনে যে শাড়িখানা দেবী দুর্গাকে দেওয়া হয়েছিল, তা ছেঁড়া ছিল এবং পরিবারের গৃহিনীর শাড়ির চাইতেও তা নিম্নমানের ছিল।’ সর্ব্বানন্দ দাস খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, দেবীর কথাই সঠিক। পূজো, ধারাবাহিকতা, ১০৮ চণ্ডীপাঠ, দশ হাজার হোম ও পূজোর অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য সর্ব্বানন্দ দাস গুরু-পুরোহিত, প্রতিমা গঠক ও পূজার সামগ্রি প্রস্তুতকারীদের জন্য পৃথক পৃথক ভূমি প্রদান করেন। সর্ব্বানন্দ দাস দেবীর সেবার কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মৃত্যুর পূর্বে তদপুত্র কমলচরণ বাবুকে একখানা নির্দেশনামা দিয়ে যান। কমলচরণ বাবু ও তদপুত্র কালীকিশোর বাবুকে এবং কালীকিশোর বাবু ও তদপুত্র কালীপদ বাবুকে অনুরূপ একখানা নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করে দেন। কালীপদ ৪৮ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় তাঁর পুত্রগণ ঘি এর মূল্য বৃদ্ধি পাবার কারণে হোম কমিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। এ খবর কালীপদ বাবু জানতে পেরে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি নির্দেশনামার সিদ্ধান্ত ঠিক রাখার জন্য জোর নির্দেশ দেন। পুত্রগণ কালীপদ বাবুর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। কালীপদ বাবুর অসুস্থতার পর তৃতীয় পুত্র শান্তি বাবু ভগবতীর পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শান্তি বাবু যথাবিহিত পূজা প্রতিবছরই সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে আয়োজনে মগ্ন হন। ১৩৩৮ বাংলায় শান্তি বাবু দেহত্যাগ করেন। ১৩৬২ বাংলার ১লা বৈশাখ হতে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়। জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির পর দুর্গাপূজা ভেতর বাড়িতে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন ভক্ত-পূজারীরা সমবেত হয়ে যথারীতি পূজার কার্যাদি আগের মতোই পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী পূজা প্রতিবছরই চলতে থাকে। শান্তি বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র শ্রী সঞ্জয় দাস প্রতিবছর প্রবাস থেকে পূজোর সময় পাঁচগাঁওয়ে আসেন। তিনি এসে যথারীতি শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজনে নিয়োজিত থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধ, সিঁথি রা-
১৩৭৭ বাংলার শেষ দিকে জনৈক ভক্ত প্রদত্ত রূপার তৈরি ৮০ ভরি ওজনের একটি মুকুট, রূপার তৈরি একটি চরণপদ্ম, সোনার চুড়ি, সোনার নোলক ও সোনার আংটি লুণ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র কুমারীর মাথার সোনার সিঁথিটা রা পায়। যে মানুষ মুকুটসহ অন্যান্য সামগ্রি নিয়েছিল পরবর্তীতে সে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে মারা যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শান্তি বাবু কুমারী দেবীর সিঁথি কূলপুরোহিত স্বর্গীয় রাজিব ভট্টাচার্য্যরে নিকট রেখে ভারতে চলে যান। যুদ্ধে রাজিব ভট্টাচার্য্যরে সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংস হয়। কিন্তু সিঁথি তিনি বুকের মধ্যে আগলে রাখেন। শান্তি বাবু দেশে ফিরলে রাজিব ভট্টাচার্য্য সিঁথিটি সমঝাইয়া দেন। শান্তি বাবুর বাড়িঘর পাকিস্তানি হিংস্র হায়েনারা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু দুর্গামণ্ডপ রাসায়নিক দ্রব্য দিয়েও পোড়াতে পারেনি জানোয়ার হায়েনারা। নরপিশাচ পাক-হানাদার বাহিনীর অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

মানুষের ঢল, বলি হবে-
যথারীতি এবারও বলি অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবছর পাঁচগাঁয়ে লাখো লাখো মানুষের মিলনমেলায় মুখরিত হয়। দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের শ্রীচরণে প্রণাম দেবার বাসনায়। পূজো উপলে পাঁচগাঁওয়ে বর্ণাঢ্য মেলা বসে। পূজোয় পাঁচগাঁও বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়। সর্বস্তরের মানুষের পদচারণায় দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার সম্মিলন কেন্দ্র। ‘শাশ্বতী’ নামে প্রতিবছরই একটি সাহিত্য সংকলন পাঁচগাঁও থেকে প্রকাশিত হয়। ‘শাশ্বতী’ ইতিমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
সারা পৃথিবীতেই আজ এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেই অস্থিরতা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকেও আঁকড়ে ধরেছে। এমনি এক দুঃসময়-দুর্দিনে মহামায়া, জগজ্জননী ও দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মা এসেছেন এবার পূজো নিতে। আমরা প্রত্যাশা রাখছি মহামায়ার আগমনী ধ্বনিতে সকল অস্থিরতা, সংকট ও সংঘাতের পতন হবে। সমস্ত পৃথিবীতেই সুখ-শান্তির আলোয় মাতোয়ারা হবে মানুষের মনপ্রাণ। মানুষ শুধু ভালোবাসাতেই বেঁচে থাকবে চিরকাল। হিংস্র মহিষাসুরদের নশ্বর হাতের কালো থাবা হতে দশভূজা বাঁচাবেন সমগ্র মানবজাতিকে। প্রতিপ্রত্যেক মানুষ সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে নিরাপদ নির্ভাবনায় জীবনযাপন করুক প্রতিটি প্রহর।

সজল ঘোষ
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
বি-৬০,পল্লবী আ/এ,পনিটুলা,সিলেট।৩১০০
০১৭১৬-৮৯১১৮৬
তারিখ-২৯-০৯-১৪ইং সোমবার