সিলেটে চাকরীর প্রলোভনে আদিবাসী তরুণীকে ধর্ষণ, ভিডিওচিত্র ধারণ, হুমকি
ডেস্ক রিপোর্টঃ দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তার ওপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বয়স প্রায় কুড়ি। নুন আনতে পানতা ফুরানো সংসারের হাল। তবুও মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন মা-বাবা।
মেয়েটি ২০১৩ সালে এসএসসি ও ২০১৫ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে এইচএসসি সমমান পরীক্ষায় পাস করে। তাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন বাসা বাঁধে পরিবারের সবার মনে।
মেয়েটিও ভাবে, কি করে একটু হলেও ঘুচানো যায় পরিবারের দুর্দশা। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিও খুঁজতে থাকে সে। আর চাকরি নামের সেই সোনার হরিণ খুঁজতে গিয়েই সে আটকা পড়ে এক সর্বনাশের জালে। এক প্রতারকের খপ্পরে পড়ে যায় সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জলুরমুখ লক্ষ্মীর হাওরের মেয়েটি। ওই দুর্বৃত্ত সুযোগ নেয় তার অসহায়ত্বের। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সে মেয়েটিকে অপহরণ করে। তারপর চালায় ধর্ষণ। শুধু তাই নয়, মোবাইল ফোনে মেয়েটির বিবস্ত্র অবস্থার ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। এরপর কেটে দেয়া হয় মাথার চুল।
ভয়ংকর এ ঘটনা ঘটেছে ২৯ ডিসেম্বর। প্রতারিত, নির্যাতিত মেয়েটির পরিবার প্রতিকার চেয়ে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কিন্তু কেউ দরিদ্র পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়নি। উপরন্তু এ ঘটনায় কোনোরকম মামলা না করতেও প্ররোচিত করছে। ফলে ঘটনার পর গত এক মাসেও মামলা করতে পারেনি ভুক্তভোগী।
এ ঘটনাকে ঘিরে পুরো উপজেলায় তোলপাড় চললেও কোনো গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসেনি। এই সুযোগে অপহরণ, ধর্ষণ ও পাচারের পরিকল্পনাকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা উল্টো ভুক্তভোগী মেয়েটির পরিবারটিকেই চাপে রাখতে তাদের কয়েকজনের নামে গোয়াইনঘাট থানায় ডাকাতির মামলা করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল জলুরমুখ লক্ষ্মীর হাওরের এই মেয়েটি চাকরি খুঁজতে থাকলে পরিচয় ঘটে অনেকের সঙ্গে। পরিচয়ের এক পর্যায়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে লোক নিয়োগের খবর জানায় সাজু মিয়া নামের এক যুবক। সিলেট শহরতলির খাদিম পরগনাবাজারে তার বাড়ি। তার পরামর্শে আবেদন করার পর মেয়েটির নামে একটি প্রবেশপত্রও আসে কৃষি অধিদফতরের খামারবাড়ি ঠিকানা থেকে। সেখানে রোল নম্বর লেখা রয়েছে ১১৩১০। প্রবেশপত্রটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক (প্রশাসন) নারায়ণ চন্দ্র বসাকের স্বাক্ষরিত। ইস্যুর তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০১৬।
প্রবেশপত্রে উল্লেখ রয়েছে লিখিত পরীক্ষার জন্য ২৯ জানুয়ারি ঢাকার সেগুনবাগিচা সরকারি গার্লস স্কুলে উপস্থিত থাকতে হবে। তবে এ প্রবেশপত্র আসল না ভুয়া তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়।
বিষয়টি নিশ্চিত হতে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রবেশপত্রে উল্লিখিত নম্বরে ফোন করে নারায়ণ চন্দ্র বসাককে পাওয়া যায়নি। অন্য এক ব্যক্তি ফোন ধরে জানান, তিনি (বসাক) এখন চাকরিতে নেই, অবসরে চলে গেছেন অনেক আগেই। তাহলে অবসরে থাকা ব্যক্তির স্বাক্ষরে সাম্প্রতিক নিয়োগের প্রবেশপত্র ইস্যু হয় কিভাবে? জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন, এ নম্বরে কথা বললে জানা যাবে প্রবেশপত্রটি সঠিক না ভুয়া।
ওই নম্বরে কল করা হলে যিনি রিসিভ করেন তিনি নিজেকে উপপরিচালক (পার্সোনাল) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলে পরিচয় দেন। তাকে প্রবেশপত্রের ভাষা, স্মারক নম্বরসহ বিস্তারিত পড়ে শোনানোর পর তিনি বলেন, প্রবেশপত্রটি সম্পূর্ণ ভুয়া। কোনো একটি চক্র ভুয়া প্রবেশপত্র ইস্যু করে নিয়োগের নামে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
অন্যদিকে অপহরণ, ধর্ষণ, বিবস্ত্র ভিডিও চিত্র ধারণ ও চুল কেটে নেয়ার পর লজ্জায়, অপমানে এবং অপরাধীদের লাগাতার হুমকির মুখে মেয়েটি আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
মেয়েটি বলে, মা-বাবার কষ্ট লাঘব করতে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি খুঁজতে থাকি। একসময় পরিচয় হয় সাজু মিয়া নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন সাজিদ রহমান নামের আরেকজনের সঙ্গে। তারা কৃষি মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেয়ার কথা বলে। একপর্যায়ে একটি প্রবেশপত্র হাতে দিয়ে ছবি ও কাগজপত্র জোগাড় করতে বলে। পরে সাজনা বেগম নামে এক মহিলা ফোন করে কাগজপত্র নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলা হয় গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন অফিসের সামনে। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে বলে চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি প্রয়োজন।
এ কথা বলে তারা আমাকে একটি গাড়িতে তোলে। গাড়িতে তোলার পর সাজিদ আমার নাকে একটি রুমাল চেপে ধরে। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি একটি অচেনা ঘরে বন্দি।
সাজিদ তখন জানায়, এলাকাটি নরসিংদীর বেলানগর। তখন আমি কান্নাকাটি শুরু করলে আমাকে মারধর ও হত্যার হুমকি দিয়ে ধর্ষণ করে। এরপর আমার মাথার চুল কেটে দেয়। একই কায়দায় সাজিদ আমাকে বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করার পাশাপাশি মোবাইল ফোন দিয়ে ধর্ষণের সময় বিবস্ত্র ভিডিও চিত্র ধারণ করে। এক সময় সে কার সঙ্গে যেন মোবাইলে কথা বলে।
সাজিদকে তখন বলতে শুনি, ‘চেহারাটা তেমন সুন্দর না হলেও নতুন। রেট একটু বাড়িয়ে দিলে আপনার ওখানে পৌঁছে দেব।’ তখন আমি আরও বেশি কান্নাকাটি করলে একটি বস্তা ও দা এনে আমার সামনে রাখে। সাজিদ বলে, বেশি হাউমাউ করলে গলা কেটে লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেব। এ সময় আমার কান্নাকাটি দেখে স্থানীয় এক মহিলা আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ করে সাজিদকে। পরে আমার অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরে সাজিদ আমাকে নিয়ে সিলেটে ফিরে আসে। এরপর আমাকে দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর নিয়ে আসে। সেখানে রোজি বেগম নামে এক মহিলার কাছে আমাকে রাখে এবং পরিচয় দেয় রোজি তার স্ত্রী। ওখানে কয়েক ঘণ্টা রাখার পর সাদা কাগজে কয়েকটি স্বাক্ষর নেয়।
এরপর সাজিদ আমাকে বলে, ‘তোমার চাকরির কাজ প্রায় হয়ে গেছে। এখন তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসব। আর যা হয়েছে বা ঘটেছে তা কাউকে জানাবে না। জানালে চাকরি তো হবেই না, তোমার জানটাও যাবে। বেঁচে থাকলেও মুখ দেখাতে পারবে না কারও সামনে। তোমার বিবস্ত্র ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেব।’
এ কথা বলে সাজিদ আমাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। পথে একটি ওষুধের দোকানে বসা চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর বেশকিছু ওষুধ দিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলে। ওসব খেলে নাকি আমার টেনশন কমবে নতুবা প্রেশার বেড়ে মারা যেতে পারি। ভয়ে আমি সব ওষুধ খাই। পরে একটি প্রেসক্রিপশনে আরও কিছু ওষুধ লিখে দেন ওই চিকিৎসক। তারপর আমাকে সালুটিকরের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সাজিদ চলে যায়। প্রথমে মানসম্মানের ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখলেও পরে দেখি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি। তাছাড়া সাজিদ সবাইকে বলে বেড়াতে থাকে আমি নাকি তার বউ। এসব শুনে আমি চরম হতাশ হয়ে পড়ি। পরে পুরো বিষয়টি প্রথমে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের জানাই। পরে স্থানীয় অনেকের কাছে এ ব্যাপারে বিচারপ্রার্থী হই।
এরপর থেকে প্রভাবশালীদের শেল্টারে থাকা সাজিদ, সাজু মিয়া, সাজনা বেগমসহ তাদের সহযোগীরা আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ও হুমকির বিষয়টি স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানসহ অনেককেই আমি জানিয়েছি। তবে বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর অভিযুক্তরা প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় উল্টো মামলা দিয়ে আমার পরিবারকেই জিম্মি করতে চাইছে।
মেয়েটি বলে, আমি অসহায়, গরিব বলে কি বিচার পাব না? আমি দেশের আইন অনুযায়ী বিচার চাই।
২৯ ডিসেম্বর অপহৃত মেয়েটি বাড়িতে পৌঁছে ১ জানুয়ারি। এরপর থেকে বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিলেও কেউ তার অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের উদ্যোগ নিচ্ছেন না। ভয়ে মামলাও করতে পারছে না তার পরিবার।
এ ব্যাপারে নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার দশরথ সরকার বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে নির্যাতিত মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়েছে। পুরো ঘটনা শুনেছি। তারা গরিব, সামর্থ্যহীন বলে অনেকেই মামলা করতে নিরুৎসাহিত করছে।
স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশের উপদেষ্টা আসাদ্দর আলী চৌধুরী বলেন, ছেলেটা (সাজিদ) চরিত্রহীন। চাকরির প্রলোভন দিয়ে মেয়েটার সর্বনাশ করেছে। আমি বলেছি মামলা করতে। তবে অনেকেই নানা ভয় দেখিয়ে মামলা করতে দিচ্ছে না। অপরাধীরা বড় চতুর। তারা মেয়েটির পরিবারকে জিম্মি করতে উল্টো ডাকাতি মামলা করেছে নিরীহ লোকদের ওপর।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই মামলায় অভিযুক্ত ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসাদ্দর আলী চৌধুরী থানায় যান। তিনি বলেন, ডাকাতির মামলাটি মিথ্যা। কারণ যারা ডাকাতি মামলার বাদী তারাই আসামিদের চেনে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মহেন্দ সরকার বলেন, আমি ভিকটিমের বাড়িতে গিয়ে ঘটনা শুনেছি। তাদের মামলা করার জন্য বলেছি।
গোয়াইনঘাট উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আফিয়া বেগম বলেন, লোকজনের কাছ থেকে ঘটনাটি শুনেছি। তবে ভিকটিম আমার কাছে আসেনি।
নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামীম আহমদ বলেন, মেয়েটার পরিবার খুব গরিব। মামলা করতে গেলেই টাকা লাগবে। তাদের সে সামর্থ্যও নেই। তাছাড়া অপরাধীদের সঠিক ঠিকানাও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বলেছি, ‘সবর’ করে নিতে।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভিকটিমকে যে বা যারা বিভ্রান্ত করছে তাদের কথা শোনার দরকার নেই। ভিকটিম যদি সোজা থানায় আসে এবং অভিযোগ দেয় আমরা অবশ্যই মামলা নেব। অভিযোগের সত্যতা তদন্তও আদালতের বিচার্য বিষয়। সূত্র : যুগান্তর