মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধু জেনারেল জ্যাকব আর নেই

general jacobডেস্ক রিপোর্টঃ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালীন নানাভাবে সহায়তাকারী ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) জেএফআর জ্যাকব বুধবার চলে গেলেন।
ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
লেফটে‌ন্যান্ট জেনারেল জ্যাকব ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ ছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়ে নিজে হাতে দলিলের খসড়া লিখেছিলেন তিনি। যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার পালিত ভূমিকার জন্য ভারত সরকার তাঁকে পিভিসিএম পদকে ভূষিত করেন।

একাত্তরের অবদানের জন্য ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জেনারেল জেএফআর জ্যাকবের হাতে সম্মাননা তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুলাই ১৯৭৮-এ জ্যাকব সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি ভারতের পাঞ্জাবের গভর্নর ও চন্ডিগড়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হন।
বেশ কিছুদিন অসুস্থতার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল বুধবার সকালে দিল্লির একটি সামরিক হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।

general jacob2ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে যে দলিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে জন্ম হলো নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সে ঐতিহাসিক দলিলের খসড়া রচনা করেছিলেন তিনি। এবং পাকিস্তানের নিয়াজীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কৃতিত্বও তার।

জেনারেল জ্যাক ফ্রেডেরিক রালফ জ্যাকবের জন্ম ১৯২৩ সালে। জ্যাকব ১৯২৩ সালে অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে সংগঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বিখ্যাত।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ হতে অবসর গ্রহণকারী জেনারেল জ্যাকব ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। ৩৬ বছরের সেনাবাহিনী জীবনে তিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি জে.এফ.আর জ্যাকব এবং জেনারেল জ্যাকব নামেও পরিচিত।

১৯৪২ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তাঁর পিতা তাকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে আপত্তি জানান কিন্তু তার পরেও তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।

‘সারেন্ডার ইন ঢাকা, বার্থ অফ এ নেশন’ এবং ‘অ্যান ওডেসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’ বইয়ে জ্যাকব লিখে গেছেন সেইসব আগুনঝরা দিনের কথা, যে পথ ধরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এএকে নিয়াজী ঢাকার তখনকার রেসকোর্স ময়দানে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে যেটুকু আলোচনা তার বেশিরভাগই তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেক্শকে ঘিরে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বীরত্বের জন্য ‘মিলিটারি ক্রস’ অর্জন করেন।

সেই দিনগুলোতে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার ওপর খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছিলেন না মানেক্শ। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সমর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় তখনকার মেজর জেনারেল জ্যাকবের ওপর।

মুক্তিযুদ্ধে ‘এস ফোর্স’ এর অধিনায়ক ও সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘জে এফ আর জ্যাকবের সহযোগিতাতেই ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর আত্মসমর্পণ পত্রের খসড়া তৈরি এবং এ সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা ঠিক করা হয়।

“জ্যাকব একজন দক্ষ সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিপর্যয়ের শুরুতেই জ্যাকব তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখন, কোথায় ও কীভাবে আত্মসমর্পণ করবে সেটাও ঠিক করেছিলেন তিনি।”

১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করার কথা থাকলেও পরে তা ছয় ঘণ্টা পেছানো হয়। পরে জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে আলোচনা করেই প্রস্তাবগুলো মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নিয়াজী।