নদীর অবস্থা ভয়াবহ : পদ্মা শুকিয়ে মরা নদী

Padma Lonch sink2মাওলানা জুলফিকার: বরাবরে মতেই এবারো শীতকালেই প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে পদ্মার শাখা-প্রশাখা মাথাভাঙ্গা, কুমার, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়ালখাঁ, মধুমতি, পশুর, কপোতাক্ষ, মহানন্দাসহ অন্তত ৩৬টি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পদ্মার বুকে জেগে উঠছে বিশাল বিশাল চর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ, মৎস্যসম্পদ ও নৌযোগাযোগ।
গত ২ জানুয়ারি-২০১৬ ঈসায়ী জেআরসি’র (ভারত ও বাংলাদেশের) প্রতিনিধিদল পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেছে। নদীতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলে প্রতিনিধিদল জানায়। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সবকিছুতে কী মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, তা মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। কিন্তু কেন? মিঠাপানি ছাড়া কৃষি তথা কোনো ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। ফারাক্কার কারণে পদ্মার তলদেশ উপরে উঠে এসেছে। এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশের বিচরণত্রে ছিল রাজশাহী থেকে পাবনা পর্যন্ত। মাছ আসার জন্য পানিতে যে পরিমাণ প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। গাঙ্গেয় পানি ব্যবস্থায় দুই শতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল। সেগুলোর বেশির ভাগই এখন বিলুপ্তির পথে। পদ্মা নদীতে পানিস্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন গাঙচিল, মাঠরাঙা বেলেহাঁস আর ধবল দেখা যায় না। দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাছ প্রায় শূন্য পদ্মা। যে কারণে সাদা বক গাঙচিল আর বেলেহাঁসের দেখা পাওয়া যায় না।
পদ্মা নদী অববাহিকায় আয়তনে এত বিশাল সমতল বদ্বীপ পৃথিবীতে আর কোনো নদীর নেই। এ নদীর অববাহিকায় বাস করে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ। পদ্মার দুই তীরে ২৯টি প্রথম শ্রেণীর শহর রয়েছে। প্রতিটি শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণীর শহর রয়েছে ২৩টি। শহরগুলোর প্রতিটির জনসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ। এছাড়া ৫০ হাজার কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহর রয়েছে ৪৮টি। ভারতের উত্তরপ্রদেশের কানপুরে গঙ্গা (পদ্মা নদীর ভারতীয় অংশের নাম) নদীর উপর নির্মিত হয়েছে ‘লব-কুশ ব্যারাজ’। এই বাঁধ দিয়ে ভারত প্রতিদিন ১৯ হাজার মিলিয়ন লিটার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এই পানি বিশুদ্ধ করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের কম দেখা গেলে দুই দেশের সরকার তাৎক্ষণিকভাবে জরুরী ভিত্তিতে আলোচনা করে সমন্বয় সাধন করতে পারবে বলা হলেও কার্যত কিছুই হচ্ছে না। অনুচ্ছেদ-২এ বলা হয়েছে- উভয় পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করবে। এই কমিটি ফারাক্কা পয়েন্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা ও ফিডার ক্যানেল এলাকায় পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণের জন্য একটি টিম নিয়োগ করবে। এই টিম উভয় সরকারের কাছে পানিপ্রবাহের সংগৃহীত ডাটা-উপাত্ত পেশ করবে। তা যদি করত তাহলে পদ্মায় পানিপ্রবাহ থাকতো।
পদ্মার প্রধান শাখা নদী হলো মাথাভাঙ্গা, কুমার, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়ালখাঁ প্রভৃতি। প্রশাখা হলো মধুমতি, পশুর, কপোতাক্ষ। উপনদী একটি মহানন্দা। মহানন্দা রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানায় পদ্মায় মিলিত হয়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে শুকনো মৌসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর পানি দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন, তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠতো না। কিন্তু নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ভারতÑ তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১,১০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০ (১১ হাজার ট্রিলিয়ন অথবা ১১ লাখ বিলিয়ন টাকা) টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের পানি চুরির অভিযোগে ভারত অভিযুক্ত বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
‘নেপাল স্টাডি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ হ্যাভ সিরিয়াস ওয়াটার ডিসপিউটস’ শিরোনামে সম্প্রতি ওই নিবন্ধটি প্রকাশ করে নেপালের টেলিগ্রাফ পত্রিকা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গঙ্গা পানি চুক্তি কার্যকরের চৌদ্দ বছর শুরু হয়েছে এ বছর। পদ্মা শুকিয়ে এখন মরা খাল। পরিবেশগত হুমকির মুখে ৬ জেলার ২ কোটি মানুষ। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কর্মকর্তারা সম্প্রতি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পদ্মার পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ পানি বিশেষজ্ঞ দল ভারতের ফারাক্কা ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে এবং সে অনুযায়ী পানি বণ্টন হয়ে থাকে। তবে পানি চুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো বছরই বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা নদী বেষ্টিত ৬টি জেলায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে ফারাক্কার প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের ৫৪টি নদী শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এত নিচে নেমে গেছে যে, এভাবে চললে ১০ বছর পর এ অঞ্চলে পানি পাওয়া কঠিন হবে।
ভারত শুধু পদ্মা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধই নয়, বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে। এর কারণে বাংলাদেশের ৮০টি নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়া আরো ১০০টি নদী মৃতপ্রায়। এবছর খরা মৌসুমে এসব নদীর অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এর প্রভাবে এসব নদীর সাথে যুক্ত অসংখ্য খাল-বিল এখনই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে প্রায় অর্ধকোটি সেচযন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে আছে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপসহ ৬ ধরনের টিউবওয়েল। এগুলোর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ভূ-উপরিস্থ পানি সেচের জন্য রয়েছে লো-লিফটসহ যান্ত্রিক পাম্প ও সনাতন পদ্ধতির নানাবিধ সেচপদ্ধতি। এগুলোর সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। এসব সেচযন্ত্র প্রায় দেড় কোটি হেক্টরে বছরের বিভিন্ন সময় পানি সরবরাহ করে।
জানা যায়, এক যুগের ব্যবধানে দেশে সেচযন্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেচের জমি বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর। এসব সেচযন্ত্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের বড় নদী, শাখানদী, উপশাখা ও প্রশাখাগুলোর সাথে যুক্ত অসংখ্য খাল, হাওর, বিল প্রভৃতির পানির উৎস থেকে পানি সরবরাহ করে। ফলে যেকোনো নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা মানেই সরাসরি ওই নদীকেন্দ্রিক সেচব্যবস্থার উপর আঘাত হানা। ভারতের এই নদী রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে অচল করে ফেলতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত শুধু আধিপত্যবাদী ভূমিকাই পালন করছে না; বরং রীতিমতো লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসী প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে। ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতি এদেশের জাতীয় চরিত্রকে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মতে মুসলমানদের সর্বপ্রথম শত্রু হলো ইহুদী অতঃপরই এ মুশরিকরা তথা ভারত। অথচ সে ভারতের মুশরিকদের প্রতি বাংলাদেশ সরকার নতজানু ও বড় দাদা সুলভ পররাষ্ট্রনীতি চালিয়ে আসছে। আমরা মনে করি, এর এক্ষুণি অবসান দরকার। এক্ষেত্রে শুধু সরকার কর্তব্যই শেষ নয়, দেশের জনগণকেও পবিত্র ঈমানী জযবায় আপ্লুত হতে হবে। নচেৎ দ্বীন-দুনিয়া দু’ক্ষেত্রেই পস্তাতে হবে। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে- “যখন মুসলমানরা মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে ওয়াদার খিলাফ করে, তখন তাদের উপর বিদেশী শত্রু চাপিয়ে দেয়া হয়।”
কাজেই এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার নছীহত মুবারক গ্রহণ করলেই সব আগ্রাসন ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ইনশাআল্লাহ!