প্রচারণাযুদ্ধ শেষ, এবার ভোটযুদ্ধের অপেক্ষা
ডেস্ক রিপোর্টঃ প্রথমবারের মত দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা নির্বাচনের প্রচারণাযুদ্ধ শেষ হয়েছে, এবার ভোটযুদ্ধের অপেক্ষায় দেশবাসী। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত প্রায় সবগুলো দলই অংশ নিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা না থাকায় তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, তবে সে দলের অনেক নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থিতার মোড়কে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
এদিকে সোমবার মধ্যরাত অর্থাৎ রাত ১২টার পর থেকে দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়েছে। এর আগে রাত ৮টাতেই বন্ধ হয়ে যায় মাইকে প্রচার ও ভোট প্রার্থনা। নির্ধারিত সময়েই নির্বাচনী মিছিল-সমাবেশ ও প্রচারসভা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পক্ষকালের কোলাহলমুখর পরিবেশ হঠাৎ করেই নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
আজ মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) দিনভর প্রচারবিহীন একটি দিন কাটবে প্রার্থীদের।তবে ঘরোয়া প্রচারের সুযোগ নিয়ে রাতভর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের দোয়া প্রার্থনা থেমে ছিল না। এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিরাপদে ভোট অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছে।
৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল নির্বাচনের এ আনুষ্ঠানিক প্রচার। আর ১৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় প্রার্থীদের প্রতীকসহ প্রচার কার্যক্রম, যা গতকাল সোমবার মধ্যরাতের পর শেষ হয়েছে।
আগামীকাল বুধবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২৩৪টি পৌরসভার তিন হাজার ৫৫৫টি ভোটকেন্দ্রের ২১ হাজার ৭১টি কক্ষে একযোগে ভোট নেওয়া হবে। এরপর শুরু হবে ভোট গণনা। তার পর রাতেই জানা যাবে ভোটের ফলাফল।
তবে ভোট নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর শঙ্কার রেশ ছিল গতকালও। যেসব পৌরসভায় গত কয়েক দিন ধরে সংঘাত-সহিংসতা চলেছে, সেসব স্থানে এ উদ্বেগের মাত্রা ছিল তুলনামূলক বেশি। শেষ পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকবে কি-না, সবাই ভোট দিতে পারবেন কি-না- তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা কম নেই। ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার বিষয়ে অনেক প্রার্থীরও সংশয় রয়েছে।
এদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের বাড়তি তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সোমবারই অধিকাংশ এলাকায় বিজিবি মোতায়েন শুরু হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ অন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ শুরু করেছেন। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ভোটকেন্দ্রগুলোর দিকে রয়েছে বাড়তি নজর।
সারাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৬১৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন, যা মোট ভোটকেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক। বিভাগভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র আছে খুলনা বিভাগে। এই বিভাগের ৪৮১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৬৯টিই ঝুঁকিপূর্ণ।
বুধবার দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ২৩৪টি মেয়র, দুই হাজার ১৯৩টি সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ৭৩১টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ভোট নেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, এসব পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থী সংখ্যা ৯৪৩ জন। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এরই মধ্যে ছয়জন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
সিলেটে প্রার্থী ও সমর্থকদের গণসংযোগ, শোডাউন, পথসভা, জনসভা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে সিলেট বিভাগের ১৬টি পৌরসভায় আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়েছে। আনুষ্ঠানিক প্রচারের শেষপর্যায়ে এসে টাকা বণ্টনের অভিযোগের গুঞ্জনও ছড়িয়েছে কয়েকটি পৌরসভায়।
সিইসি বলছেন:
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে নেওয়া হয়েছে অধিকতর নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
সোমবার রাতে ইসি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। দেশে প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে সিইসি বলেন, প্রথমবার পৌর নির্বাচন রাজনৈতিক প্রতীকে হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, তাদের অনুসারী ও সমর্থকদের নির্বাচনী শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করতে কমিশনকে সহায়তা করতে হবে।
পর্যবেক্ষণে চার কমিশনার:
ভোটের আগের রাত বিবেচনায় কমিশন সদস্যরা আজ রাত থেকেই ইসি কার্যালয়ে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সিইসি কাজী রকিব চার কমিশনারের মধ্যে বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন করেছেন। ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন কমিশন জাবেদ আলী। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার আবু হাফিজ এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং মাঠপ্রশাসনকে দ্রুত নির্দেশনা দেবেন কমিশনের সদস্যরা।
মনিটরিংয়ে সেল গঠন:
ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ে বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকির জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিনকে প্রধান করে সাত সদস্যের মনিটরিং সেলের অন্য সদস্যরা হলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, একজন পুলিশ সুপার (এসপি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রতিনিধি, র্যাবের প্রতিনিধি, আনসার ও ভিডিপির মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার অথবা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যায়ের কর্মকর্তা। ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ-সচিব সামসুল আলম জানিয়েছেন, কমিটি ২৩৪ পৌরসভার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তদারক ও পর্যবেক্ষণ করবে। যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইসিকে অবহিত করবে এবং প্রয়োজনে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবে।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১২ হাজার:
২৩৪ পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ১২ হাজার ১৬৯ জন। এর মধ্যে মেয়র পদে ৯৪৩ জন ও সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে আট হাজার ৭৪৬ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে দুই হাজার ৪৮০ জন। ইতিমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র পদে সাত জন এবং কাউন্সিলর পদে ৯৪ জন নির্বাচিত হয়েছেন।
দায়িত্বে ৬৭ হাজার কর্মকর্তা:
নির্বাচনে ২৩৪ জন রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ তিন শতাধিক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া ২৩৪ পৌরসভায় ৬৬ হাজার ৭৬৮ জন কর্মকর্তা ভোটগ্রহণে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতি কেন্দ্রে একজন করে তিন হাজার ৫৫৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, প্রতি বুথে একজন করে ২১ হাজার ৭১ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং প্রতি বুথে দু’জন করে ৪২ হাজার ১৪২ জন পোলিং কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নির্বাচনে তিন হাজার ৫৫৫টি ভোটকেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হবে। ২৩৪ পৌরসভায় মোট ভোটার ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ২৮৪ জন এবং নারী ভোটার ৩৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬০ জন।
এ ছাড়া পৌর নির্বাচনে মাঠে থাকবেন এক হাজার ২০৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট। এর মধ্যে ৯৬৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ২৩৫ জন। গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে আচরণবিধি তদারকিতে মাঠে কাজ করছেন ২৩৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে ভোটের পরও দুই দিন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ৭৪ হাজার সদস্য:
নির্বাচনে মোবাইল ফোর্স হিসেবে পর্যাপ্ত সংখ্যক র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবেন। আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত থাকবেন ৭৪ হাজার পুলিশ-আনসার-ভিডিপির সদস্য। প্রতি সাধারণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় কমপক্ষে পাঁচ জন পুলিশ (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার একজন (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত এপিসি (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার/ ভিডিপি ১২ জন সদস্য (নারী-৬, পুরুষ-৬) থাকবেন। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও হাওর এলাকায় শুধু পুলিশের সংখ্যা বেড়ে দু’জন হবে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রে ছয়জন অস্ত্রধারী পুলিশসহ মোট ২০ সদস্যের নিরাপত্তা দল থাকবে।