৭১ এর গণহত্যা : কমলগঞ্জের বধ্যভূমিগুলো আজও অরক্ষিত

deora chora bodhyo vumi-1বিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ প্রতিনিধিঃ ৭১ এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মত কমলগঞ্জেও পাক হানাদারদের অত্যাচার এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হন অনেকেই। এখানকার শমশেরনগর বিমান বন্দর, চৈত্রঘাট, দেওরাছড়া ও আদিয়া এলাকার বধ্যভূমির মাটি খুঁড়লে আজও শত শহীদের হাড় ও মাথার খুঁলি পাওয়া যাবে। সর্বপ্রথম ২৭ মার্চ পাক হানাদাররা গুলী চালিয়ে হত্যা করে সমশের নগরে সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যাক্তিকে। ২৯ মার্চের পর থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষের উপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ,অগ্নিসংযোগ আর লুণ্ঠন। দেশীয় কুলাঙ্গারদের সহায়তায় পাক হানাদাররা সর্বপ্রথম হানা দেয় ছাত্রলীগ নেতা এম,এ, গফুরের বাড়ীতে। SAMSER NAGAR BODHYO VUMI-1তার বৃদ্ধ পিতা এ,এ গণি এবং দুই ভাই এম,এ, আলী ও এম,এ, নূরকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শমশেরনগর বধ্যভূমিতে। এরপর থেকেই একাধারে প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন গ্রাম ঘেরাও করে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে এনে শমশেরনগর বিমান বন্দরের রানওয়ের ওপর দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় স্বয়ংক্রীয় অস্ত্রের গুলিতে। হানাদারদের এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন শিংরাউলির আমজাদ আলী, ভরতপুরের আরজু মিয়া, হুরমত আলী, রাধানগরের পাখী মালাকার, বিজয় মালাকার, আবুল কাশেম, সারংপুরের বারিক মিয়া, হানিফ মিয়া, সোনপুরের প্রতাপ পাল, পীযুষ পাল, ভানুগাছের কৃষ্ণপদ দত্ত, প্রসন্ন দত্ত, বড়গাছের মছদ্দর আলী, চন্ডিপুরের আজিজ মিয়া, গোকুলনগরের বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য ময়না মিয়া, সোনাপুরের দশম শ্রেণীর ছাত্র মবশ্বীর আলী, আলীনগর চা বাগানের নীরোদ নাগ, মিছিরিয়া নুনিয়া, গগন নুনিয়া, ইন্দ্রজিৎ নুনিয়া প্রমুখ।
১৭ মে হানাদাররা শ্রীসূর্য্য, পতনউষার, মসুরপুর ও পলকিরপার গ্রাম ঘেরাও করে ধরে নিয়ে হত্যা করে শিক্ষক রমেশ চন্দ্র দাস, ব্যবসায়ী যোগেন্দ্র চন্দ্র দাশ, আব্দুল করিম, আক্তার আলী, আপ্তাব আলী, কৃপেশ চন্দ্র দত্ত , ডাক্তার ছওয়াব ও আব্দুস শহীদকে। ৩ এপ্রিল হানাদাররা দেওরাছড়া চা বাগান থেকে ৭০ জন শ্রমিককে ধরে এনে অস্ত্রের মুখে সবাইকে বিবস্ত্র করে পরিধেয় কাপড় দিয়ে প্রত্যেকের হাত বেঁেধ বাগানের এক নির্জন স্থানে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পেন্টাগানের গুলিতে শহীদ চা শ্রমিকরা হলেন উমেশ শবর, লক্ষীচরণ , হেমলাল , সুধীর কর্মকার, রসিক কর্মকার, বাবুলাল , আকুল ঘটুয়ার, শিবলাল , মহিলাল , ধনিয়া ঘটুয়ার, সোনারাম , জহন গোয়ালা, অনিল গোয়ালা, লক্ষণ মুড়া, রঘু মুড়া, বিনোদ নায়েক, প্রহাদ , বিশ্বনাথ , বাবুরাম ,শাবজান , ভূবন কানু, ভাঁদো ভূঁইয়া, আগলু ভূঁইয়া, হরেন্দ্র , কুরুয়া কানু, তাঁরাপদ , গোবর্ধন , বিজয় , মংরু বড়াক, মেথু বড়াক, বধুয়া কুর্মী, লক্ষীচরন, লটু কুর্মী, বলরাম , মংরু উরাং, দুর্গাচরণ , গাঙ্গানা তেলেঙ্গা, বন্ধু শম্ভু , শ্রীধর , রাম কিশোন উপাধ্যান, গোপাল বৈদ্য, গোলক নারায়ন , গগন মৃধা, গুরুদাস, রবিদাস, কনকরাজ তাঁতী, শ্রীপঞ্চ রৌতিয়া। অন্যান্যদের নাম জানা যায়নি। দেওড়াছড়ার শ্রমিকরা সরকারের কাছে শহীদদের স্বরণে একটি ফলক নির্মানের দাবী জানালেও তাদের সে দাবী আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ২৭ মে হানাদাররা চৈত্রঘাট, পার্বর্তীপুর ও লক্ষীপুর গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করে ইরেশ লাল দত্ত, যতীন্দ্র মোহন দত্ত, মন্মথ দত্ত, রাম কুমার দেব, ডাঃ আং রশিদ, নরেন্দ্র কুমার দেব, নৃপেন্দ্র কুমার দেব, সুখময় দেব ও খোকা দেবকে।হত্যা করে আদমপুরের হাজির খাঁন ও আদিয়ার ওয়াজিদ আলী খাঁনকে। ১২ আগষ্ট হানাদাররা ভানুবিল, মঙ্গলপুর, ফুলতলি ও হোমেরজান গ্রামে প্রবেশ করে মনিপুরী ব্রাহ্মণ সার্বভৌম শর্মা,তমাল সিংহ, মদন সিংহ, চিত্ত সিংহ সহ ১৪ জনকে বাড়ী থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। আর ভারতে যাওয়ার পথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারান মঙ্গলপুর গ্রামের খাম্বা সিংহ ও উত্তর পলকির পর গ্রামের আরজু মিয়া। কমলগঞ্জের নারী সমাজ ও রেহাই পায়নি হানাদারদের হাত থেকে। অসংখ্য মা বোন বাধ্য হয়ে পশুদের ভোগের সামগ্রী হয়েছেন।দীর্ঘদিনের অযতœ অবহেলায় লোক চক্ষুর আড়ালে পড়ে থাকা শমশেরনগর বধ্য ভূমিটি সম্প্রতি সংস্কার করা হলেও আজও সংস্কার বিহীন অবস্থায় পড়ে আছে এই উপজেলার চৈত্রঘাট, আদিয়া ও দেওড়াছড়া বধ্যভূমি। এ তিনটি বধ্য ভূমিতে শহীদদের স্মরণে আজও নির্মিত হয়নি কোন সমাধি সৌধ। বধ্য ভূমিগুলো এখনও ঝোঁপ- জঙ্গলে আচ্ছাদিত। মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিবাহী এই বধ্য ভূমিসমূহ অবিলম্বে চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা অতীব জরুরী। আমাদের জাতীর স্বাধীনতা বীরত্ব ও আত্মত্যাগ, বেদনা ও গৌরবের ইতিহাস বিজড়িত এই স্থান সমূহের রক্ষণাবেক্ষনে সংশিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাযত পদক্ষেপ গ্রহন করবেন এটাই সচেতন মহলের প্রত্যাশা।