শিক্ষকদের প্রতি সরকার কতটা আন্তরিক সেটাই দেখার বিষয়

akমুহাম্মদ আবদুল কাহহার : শিক্ষকদের ছোট করতে চাই না। শিক্ষকরা সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। আমাদের শিক্ষকরা বিচারপতি, সচিব, বড় বড় অফিসার ও গবেষক তৈরি করছেন। মর্যাদা-ইজ্জত-সম্মান আর বেতন-ভাতার দিক থেকে আমরা শিক্ষকদের উচ্চকিত করতে চাই’-গত ৯ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের সম্পর্কে এভাবেই কথা বলেছেন। যে কোন ব্যক্তি বা পেশা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর এমন কথা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আশা আর হতাশার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক ও তাদের পরিবার। সম্প্রতি অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো দেয়ায় স্বস্তির চেয়ে অস্থিরতাও কম নয়। ২২ ধাপ বিশিষ্ট এই বেতন কাঠামোতে চতুরতার সাথে শিক্ষকদের কয়েক ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। পৃথক বেতন কাঠামো ও অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল গ্রেড সমস্যা নিরসনে আন্দোলন করছেন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা পুরো অক্টোবর মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন।

এ সময়ের মধ্যে সরকার যদি সম্মানজনক সমাধান না করেন তাহলে কাঠোর কর্মসূচি দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। একই সাথে পে-স্কেলে নির্দেশিত গ্রেড বিন্যাসের কারণে শিক্ষকরা আর সরকারি অনার্স-মাস্টার্স এবং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে পারবেন না। ফলে কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসতে যাচ্ছেন। এ কারণে কলেজের শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করছেন। এই বৈষম্য নিরসনে তারা পাঁচ স্তরের পদ এবং নয় স্তরের বেতন কাঠামো দাবি করছেন। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১তম গ্রেডে নির্ধারণসহ কয়েকটি দাবিতে ৪ অক্টোবর থেকে ৪ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালনসহ ১০ অক্টোবর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত পূর্ণদিবস কর্র্মবিরতি পালন করেছেন। অপরদিকে দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকা প্যানেলভুক্ত শিক্ষকরা এখনো নিয়োগ যন্ত্রণায় ভুগছেন। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত শিক্ষক ও সহকারী গ্রন্থাগারিকরা এমপিওভুক্ত করার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, অনশনসহ একের পর এক কর্র্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু এ যেন দেখার কেউ নেই। সরকার যদি তাদের ন্যায্য অধিকার পূরণ না করেন তাহলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এই বেতন কাঠামো সচিবদের তৈরি বলে এখানে অন্যদের মতের প্রতিফলন হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ কথার প্রতিধ্বনি করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, ‘অবশ্যই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা মর্যাদার প্রশ্নে আপস করা যাবে না। শিক্ষকরা যে মর্যাদা চান সামাজিকভাবে দেশের মানুষ দিতে রাজি আছে। কিন্তু তা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে।’

এ থেকে স্পষ্ট হলো প্রতিটি স্তরের শিক্ষকরা নিজ নিজ দাবি সরকারের কাছে পেশ করার চেষ্টা করছেন। এখন পর্যন্ত তিন ঘণ্টা, ছয় ঘণ্টা, অর্ধদিবস ও তিন দিনের কর্মবিরতির চেয়ে বড় কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। এসব কর্মসূচির ফলে শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও শিক্ষকরা কোন সময়ই শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করে আন্দোলন করতে চান না। শিক্ষকরা চাইলে মাসের পর মাস কর্মবিরতি পালন করতে পারেন কিন্তু সেটা তারা করছেন না। আমরা দেখেছি, আন্দোলনের মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তারা মনে করেন, অন্যসব আন্দোলনের ভাষা আর শিক্ষকদের প্রতিবাদের ভাষা এক নয়, এক হতে পারে না। সরকারকে এসব বিষয় ভেবে শিক্ষকদের অবস্থান ও শিক্ষার সংকট দূর করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

শিক্ষকদের কথা সরকারের জানা দরকার। কারো মানবিক আচরণকে দুর্বল ভাবা ঠিক নয়। যদি তা করা হয় তাহলে সরকার সেটা ভুল করবেন। শিক্ষামন্ত্রীর সুহাসিতে শিক্ষকদের সমস্যা দূর হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সরকার প্রধানের আন্তরিকতা। কেউ শিক্ষকদের ছোট করতে যদি না চানÑএ কথাটি যদি সত্য হয় তাহলে তাদের চেপে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন তা বোধগম্য নয়। সম্মানের সাথে সম্মানীর চিন্তাটাও যথার্থ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ৫ গুণ বাড়িয়েছেন বলে কেউ কেউ প্রচার করছেন। একশত টাকা থেকে ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলতে হয়তো তাদের লজ্জা হয়। তাই শিক্ষকরা জানতে চান, কোন বস্তিতে গেলে ৫০০ টাকায় ঘরভাড়া পাওয়া যাবে আর কোন ডাক্তার ৩০০ টাকায় চিকিৎসার ভার নেবেন? শিক্ষকরা যদি রাষ্ট্রের চোখে বড়ই হতেন তাহলে শিক্ষকদের বেলায় ন্যায়বিচার করতেন।

রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সর্বদাই বলছেন, শিক্ষা খাতকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট (৪৪তম) পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, এ বছরের বাজেটই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেট। যার আকার ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সেই বৃহৎ বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। যা মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয় কিন্তু সেদিকে থেকে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ! শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত বরাদ্দে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রী হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন খাতে অনেক মন্ত্রণালয়কে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। আমাদের দেয়া হয়েছে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। আমরা কি ভবন বানিয়ে দেবো নাকি বেতন দিবো? জাতীয় উৎপাদনের কমপক্ষে ৪ ভাগ থেকে ৬ ভাগ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা প্রয়োজন।’ শিক্ষামন্ত্রীর এসব কথা থেকে মনে হয়, তিনিও অসহায়। বাংলাদেশে যে ১০টি মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন বরাদ্দ পেয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হলো ৮ নম্বরে। কেনিয়ার মতো রাষ্ট্র বাজেটের শতকরা ৩১ ভাগ শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। সেখানে আমাদের জাতীয় আয়ের (জিডিপি) মাত্র ২.৬% শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয় যা আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশের চেয়েও কম। ভাবতে অবাক লাগে যেই দেশ নিয়ে এত গর্ব সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে খেলাধুলার চেয়েও কম গুরুত্ব দেয়া হয়।

বিভিন্ন কারণে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা কমছে না বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শিক্ষাঙ্গন অসুস্থতার আরেক উপসর্গ, প্রশ্নপত্র ফাঁস! কয়েক বছর যাবৎ প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা অহরহ ঘটছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে এরকম কাজ দু’একটিই যথেষ্ট। সম্প্রতি মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তা ওমর সিরাজ র্যা ব হেফাজতে মারা যাওয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি আরেকবার প্রমাণিত হলো। অথচ কর্তৃপক্ষ সে কথা বরাবরের মতোই অস্বীকার করে যাচ্ছেন। কোনো অপরাধ হলে অপরাধীদের শনাক্ত করার পরিবর্তে অনিয়মের পক্ষে সাফাই গাওয়া যেন, নতুন করে আরেকটি অপরাধ করার বৈধতা দেয়া। শিক্ষাঙ্গনের নানা অস্থিরতার মাঝে অর্থমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন বলা হয়, ‘শিক্ষকদের একটু বেশিই দিয়ে ফেলছি। কমিয়ে দেয়াই বোধ হয় ভালো ছিল।’; ‘শিক্ষকতায় যিনি এসেছেন তিনি বেতন কাঠামো জেনেই এসেছেন’ এ ধরনের অবান্তর মন্তব্য যেন অস্থিরতাকে আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এসব কথায় শিক্ষকসমাজ ও সাধারণ মানুষ বিস্মিত! এসব কথাই প্রমাণ করে শিক্ষকদের প্রতি সরকার কতটা আন্তরিক।

৯১ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছে দাবি করা হলেও এতে করে শিক্ষকদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তারাই বেশি উপকৃত হয়েছেন। প্রাইভেট পড়ানো ও ছুটির দিনে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার বিষয়টিকে বড় করে দেখার কিছু নেই। শিক্ষকরা ওইসব ক্লাস নিতে বাধ্য হন। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারি কর্মকর্র্তাদের মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা শিক্ষকরা পেলে সব ধরনের অস্থিরতা কমে যাবে। কিন্তু শিক্ষকদের বাস্তব অবস্থা না জেনে মন্তব্য ন্যায্য দাবিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যা কাম্য নয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী করতেই এক শ্রেণীর আমলারা কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের অপশক্তির হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবাইকে সোচ্চার হওয়া উচিত। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনে শিক্ষকের মান তাদের সম্মানী বাড়াতে হবে। কোন কোন শিক্ষকের সন্তানকে ক্লাসের বাহিরে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে পড়ালেখার টাকা জোগাড় করতে হচ্ছে এমন দৃষ্টান্ত সমাজে কম নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদেশে মডেল বাস্তবায়ন করা হবে অথচ তাদের সেই দেশের শিক্ষকদের মতো এখানের শিক্ষকরা সুবিধা পাবেন না, এটা কী ধরনের ন্যায়বিচার বা সমতা সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

অস্থিরতার আরেকদিক হলো সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ কোন্দল। সব আমলেই ছাত্রদের এ ধরনের কোন্দল অব্যাহত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ছাত্রদের সন্ত্রাসী কর্মকা- সব আমলকেই ছাড়িয়ে গেছে। প্রায়ই নিউজ হচ্ছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কিংবা ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা নিয়ে। এত করে সেশনজট লেগে থাকে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

শাসক শ্রেণী হয়তো চান, অধিকাংশ সচিব, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, কাস্টমস, ট্যাক্স অফিসের কর্র্মকর্তা ও কর্মচারীদের মতো অবৈধভাবে সম্পদ আহরণে শিক্ষকরাও প্রতিযোগিতা করুক। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বেতন-ভাতা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগের জায়গাটা হলো মর্যাদার অবনমন নিয়ে। ভালো শিক্ষক হয়েও আর্থিক ও সামাজিক সম্মান ও স্বীকৃতি না পাওয়ার হতাশাকে ছোট করে দেখা অনুচিত। শিক্ষার মান, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, সরকারের উদাসীনতা, শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ স্তরের মর্যাদা না দেয়াসহ নানা কারণে উদ্বিগ্ন হওয়ার অসংখ্য কারণ বিদ্যমান। বিশ্বের যেসব দেশ উন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে তারা শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতা পেশায় আসে সেজন্য সব ব্যবস্থা করা হয়। অথচ এ দেশে তার ব্যতিক্রম ঘটছে। শিক্ষকদের প্রতি সরকারের মনোভাব দেখলে মনে হয় মেধাবীদের শিক্ষা খাত থেকে দূরে রাখতেই যতসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে প্রতিনিয়ত মেধাবীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এটি কোনো ভালো লক্ষণ নয়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]