৭২০০০ শিক্ষকের কান্না

ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন আলো ছড়িয়ে। শিক্ষা বিলিয়ে গেছেন অকাতরে। যৌবনে পেশায় ঢুকে এখন এসে পৌঁছেছেন বার্ধক্যে। এ সময়ে এসে একটু সুখের দেখা পাবেন, এটাই ছিল তাদের স্বপ্ন। আর তাদের সেই স্বপ্নের গোড়া হলো অবসর আর কল্যাণভাতা। কিন্তু না! ৭২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর আর কল্যাণভাতার জন্য গুমড়ে কাঁদছেন। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও তাদের ভাগ্যে জুটেনি প্রাপ্য ভাতা। আশায় আশায় কেউ পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। চাকরি জীবনে জমানো এ টাকা পেতে শিক্ষকদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৪ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত। নীলক্ষেতের ব্যানবেইস ভবনের নিচতলায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ সুবিধা বোর্ড। এ দুটি অফিসে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৭২ হাজার। শিক্ষকদের আশা, জীবনের শেষ সময় এ টাকাগুলো পেলে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবনটুকু পার করা যেত।
ভোগান্তির চিত্র: চট্টগ্রামের খাজা আজমিরী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহসিন কবির। ২০১১ সালে ডিসেম্বরে অবসরে যান। তারপর সব কাগজপত্র জমা দেন অবসর বোর্ডে। ৪ বছর পার হলেও তিনি অবসর-ভাতার আলোর মুখ দেখেননি। গতকাল রাজধানীর নীলক্ষেতের ব্যানবেইস ভবনের নিচতলায় অবসর বোর্ডে এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার আবেদনই সঠিক হয়নি। তার আবেদনের স্ট্যাটাচে (তথ্য) কিছু লেখা নেই। একজন উপপরিচালকের কক্ষ থেকে সহকারী পরিচালকের রুমে পাঠান। সেখান থেকে পাঠানো হয় অন্য সহ-পরিচালকের রুমে। এভাবে তিনি ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত জানতে পারেন তার আবেদন সঠিকভাবে হয়নি। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, টাকা পাবো এ আশায় মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার নিয়ত করেছি। সেই আশায় এখন পানি ঢেলেছেন তারা।
আলমডাঙ্গা সিনিয়র আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক ফয়জুল হাকিম মারা গেছেন দুই বছর আগে। তার ছেলে মমিন দুই বছর ঘুরছেন অবসর বোর্ডের বারান্দায়। কিন্তু টাকা পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তিনি। এ অবস্থায় ছোট বোনকে বিয়ে দিলেও আরেক বোনের বিয়ে আটকে আছে। তিনি জানান, আমাদের এ সমস্যা লিখিত আকারে জানানোর পরও কোন সুরাহা হয়নি। বাধ্য হয়ে এ অফিসের একজন ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। দেখি তিনি কী করতে পারেন। শুধু মোহসিন কবির বা মমিন নয়, প্রতিদিন এ রকম শত শত শিক্ষক অবসর বোর্ডে এসে ভোগান্তি, বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বাড়ি ফিরেন।
বোর্ডের কর্মকর্তা বলছেন, এখানে ভোগান্তির অন্যতম কারণ অর্থ-সংকট। শিক্ষকরা যখন আবেদন করেন তখন তাদের বলা হয়, আপনার আবেদন নিষ্পত্তি হতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লাগবে। কিন্তু শিক্ষকরা ৬ মাস না যেতেই এখানে এসে তদবির শুরু করতে চান। এ সুযোগে কেউ তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতে পারে। তবে কাউকে সিরিয়াল ব্রেক করে আবেদন নিষ্পত্তি করার কোন সুযোগ নেই। কারণ ২১ সদস্যের বোর্ড চেক অনুমোদন দেয়।
অবসর বোর্ডের উপপরিচালক মো. খসরুল আলম বলেন, অবসর বোর্ডের অর্থ-সংকট সারা দেশের শিক্ষকরা জানেন। তারপর তারা এখানে ভিড় জমান। কিন্তু আমাদের পক্ষে কিছুই করার থাকে না। কারণ মূল সমস্যা অর্থ-সংকট। এটি নিরসন করতে না পারলে এ সংকট দূর করা সম্ভব না। তিনি বলেন, শিক্ষকদের ভোগান্তি কমাতে অসুস্থ ক্যাটাগরিতে জটিল রোগী (ক্যানসার, ওপেন হার্ট অপারেশন, কিডনি বিকল), মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক-কর্মচারী ও হজে গমনেচ্ছু শিক্ষক-কর্মচারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আবেদন নিষ্পত্তি করে চেক দেয়া হয়। গত বছর কয়েক শ আবেদন এসব ক্যাটাগরিতে নিষ্পত্তি করেছি।
কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাজাহান সাজু বলেন, শিক্ষকদের এ কষ্ট আমাদের ব্যথিত করে। তার পরও কিছু করতে পারি না। আমরা অসুস্থ, মুক্তিযোদ্ধা, হজ ক্যাটাগরিতে যারা আবেদন করেন তাদেরটা দ্রুত নিষ্পত্তি করি। আমি গত বছর কয়েকটি স্থানে হাসপাতালে গিয়ে চেক দিয়ে এসেছি। এখানে অর্থ থাকলে শিক্ষকদের শেষ সময়ে সেবা করার সুযোগ পেতাম।
আবেদনের পাহাড়: বেসরকারি অবসর সুবিধা বোর্ডের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ৪৭ হাজারের বেশি। এ আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। প্রয়োজনীয় ঘাটতি পূরণে অর্থ মন্ত্রণালয়কে বারবার চিঠি দিয়েও কোন সুফল পাচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, মূল সমস্যা অর্থ-সংকট। বর্তমানে সারা দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন থেকে ৪% হারে প্রতি মাসে ১৭ কোটি টাকা আয় হয় অবসর বোর্ডের। আর প্রতি মাসে গড়ে সারা দেশের ১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে যান। তারা সবাই অবসর-ভাতার জন্য আবেদন করেন। আবেদন নিষ্পত্তি করতে মাসে প্রয়োজন ৫৬ কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে ঘাটতি ৩৯ কোটি টাকা। বছরে ঘাটতি ৪৫৬ কোটি টাকা। একই চিত্র কল্যাণ ট্রাস্টেও।
কল্যাণ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, গত আগস্ট পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ২৫ হাজারের বেশি। এ আবেদন নিষ্পত্তিতে প্রয়োজন অতিরিক্ত ৫০০ কেটি টাকারও বেশি। প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন থেকে ২% হারে কল্যাণ ট্রাস্টে যায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। অথচ প্রয়োজন ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাজাহান সাজু বলেন, এখানে মূল সমস্যা অর্থ-সংকট। আমাদের টাকা দিলে দুই মাসে সব আবেদন নিষ্প্রতি করে দেবো। তিনি বলেন, সরকার আবার নতুন করে পে-স্কেল ঘোষণা করেছে। শিক্ষকরা পে-স্কেলভুক্ত হওয়ায় এ টাকার অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। তিনি জানান, আগে যে পরিমাণ টাকা দিয়ে যেসংখ্যক আবেদন নিষ্পত্তি করা যেত, এখন তার চেয়ে অনেক কম আবেদন নিষ্পত্তি হবে। সরকারের কাছ থেকে এককালীন অর্থ বরাদ্দ পেলে সমস্যার সাময়িক সমাধান হতে পারে, তবে স্থায়ী সমাধান করতে হলে বিকল্প অর্থ-উপার্জন করতে হবে।
অর্থের স্থায়ী সমাধান দাবি: অবসর ও কল্যাণের অর্থ-সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে একসময় এ সংকট দূর করা সরকারের পক্ষে আর সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ দিন যতই যাচ্ছে অর্থের সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে সপ্তম পে-স্কেলে শিক্ষকদের বেতন বাড়ার কারণে অর্থের সংকট বেড়ে যায়। সর্বশেষ অষ্টম পে-স্কেলে বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়েছে সরকার। এতে অর্থের সংকট আরও বাড়বে। কারণ শিক্ষক-কর্মচারীরা যখন অবসরে যান তখন তার বেতন স্কেলের ওপর ভিত্তি করে অবসর, কল্যাণে টাকা দেয়া হয়। তার বেতন যদি দ্বিগুণ হয় অবসর-ভাতা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু সরকার বেতন বাড়িয়েছে কিন্তু অবসর বোর্ডে ফান্ড তো বাড়ায়নি। এ ঘাটতি কীভাবে মিটবে। এজন্য এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান এখনকার কর্তাব্যক্তি ও শিক্ষকরা। তারা বলেন, সরকারি অনুদানের চেয়ে এখানে নিজস্ব অর্থ উপার্জন বাড়িয়ে বিকল্প ঘাটতি মেটানোর ভাবনা করতে হবে। তাহলেই বরং এটির স্থায়ী সমাধান সম্ভব। অবসর বোর্ডের সদ্য বিদায়ী সদস্য সচিব অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, এ অর্থ-সংকটের জন্য সরকার ২০০২ সালে একটি কমিটি হয়। এ কমিটি সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিল। শিক্ষকদের বেতন থেকে বর্তমানে ৪% হারে কর্তন করে রাখা হয়। সেই টাকা বাড়িয়ে ৮ ভাগ করা হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তির সময় বার্ষিক ৫০ টাকা করে আদায় করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন না করলে আমাদের কিছু করার নেই।
কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাজাহান সাজু বলেন, আমরাও একই সময় সরকারের কাছে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। এর মধ্যে ছিল শিক্ষকদের বেতন থেকে এখন ২% হারে যে টাকা কাটা হয় সেটি বাড়িয়ে ৪% করা। আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০% হারের বার্ষিক চাঁদা আদায় করা। এ ছাড়া আমাদের একাকালীন বড় অঙ্কের ফান্ড দেয়ার প্রস্তাব ছিল। সেটিকে না ভাঙিয়ে, বিকল্প অর্থ-উপার্জন করে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান করা যায়। তিনি বলেন, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত কল্যাণ ট্রাস্ট বন্ধ এবং ২০০২ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বার্ষিক চাঁদা নেয়া বন্ধ না হলে আজকে এ সংকট এ পর্যায়ে পৌঁছাতো না। তিনি বলেন, শিক্ষকরা এখন অষ্টম পে-স্কেলে বেতন পাবেন। তাদের চাঁদার হার ৪ থেকে ৮ আর ২ থেকে ৪% বাড়াতে শিক্ষকদের তেমন কোন ঝামেলা হবে না। আর স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বার্ষিক টাকা আদায় করলেও এ অর্থের সংকট প্রায় কাভার হয়ে যাবে।
সুপারিশের ছড়াছড়ি: মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী আমলা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তদবিরে সুপারিশের ছড়াছড়ি। এসব সুপারিশ রাখতে না পারলেও তাদের ফোন রিসিভ করতে হয় নিয়মিত। এসব তদবির কীভাবে সামলান জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সাজু তার টেবিলের নিচ থেকে দুটি ভর্তি ফাইল দেখিয়ে বলেন, এগুলো তদবিরের ফাইল। শুধু যে তদবির করে রেখে দিছে তা নয়। কয়েক দিন পর পর ফোন তো আছেই। এরপর কাজ করতে হচ্ছে। এখানে যে চাপ নরমাল, যে কেউ এখানে এসে টিকতে পারবেন না। তিনি বলেন, নানাভাবে তাদের ম্যানেজ করতে হয়। তাদের বোঝাতে হয় অর্থ-সংকটের বিষয়টি। তার পরও শিক্ষক। সেই বিষয়টি আমাদের মাথায় থাকে। যারা তদবির করছেন সবাই কিন্তু শিক্ষকদের জন্য করছেন। কিন্তু এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। কারণ এসব তদবির রাখতে গেলে নিয়মিত আবেদনের কেউ টাকা পাবেন না।
আর অবসর বোর্ডের উপপরিচালক মো. খসরুল ইসলাম বলেন, তদবির রক্ষা করতে গেলে এখানে নিয়মিত আবেদনকারীরা বেকায়দায় পড়বেন। তার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদবিরগুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেই। (মানবজমিন)