আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের হিট লিস্টে ‘কুমকুম মামা’
সুরমা টাইমস রিপোর্টঃ গল্পটি আলমগীর কুমকুমের। না তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কুমকুম নন। চলচ্চিত্র জগতেরও কেউ নন তিনি। তবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক নেই একথা মোটেও বলা যাবে না। বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দুটো অধ্যায়ের সারথীদের সঙ্গে তার অবিচ্ছিন্ন যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশের’ নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার বাবা মো. কামরুজ্জামান, যিনি ছবিটিতে অভিনয়ও করেছিলেন। আলমগীর কুমকুমের জন্মের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে চলচ্চিত্রের পরশ। মুখ ও মুখোশের মহরত হয়েছিল যেখানে সে শাহবাগ হোটেলেই মুখ ও মুখোশের কাছাকাছি সময়ে জন্ম হয় তার। আবার এ আলমগীর কুমকুমই বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন দিগন্তের সূচনাকারী অভিনেতা সালমান শাহ’র মামাও। আর সে সুবাদে পুরো সিলেটেই তিনি ‘মামা’ হিসেবে পরিচিত। সিলেট নগরজুড়ে তার ছোট্ট পরিচয় ‘কুমকুম মামা’। তবে এ পরিচয়ে নয় নিজস্ব পরিচয়েও বারবার আলোচনায় আসেন তিনি। তাকে ঘিরে নগরজুড়ে নানা রহস্য, কৌতূহল। একবার মাঝরাতে গুলি ছুড়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন একটি মৃত্যু ঘটনায়। তার বাসার ড্রয়িংরুমে আকস্মিক মৃত্যু হয় তারই এক বন্ধুর। কৌতূহলী মানুষগুলো এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে নিয়ে আবার আলোচনায় মেতে ওঠে।
সিলেট নগরীর দাড়িয়াপাড়ায় আলমগীর কুমকুমের নিবাস। বর্তমানে যে বাসার নামফলকে লেখা ‘সালমান শাহ ভবন’। বাসাটি সিলেট নগরীতে একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবেই এখন পরিচিত। সালমান শাহ’র ভক্তরা বাসাটিতে উঁকিঝুঁকি মারেন। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য ভক্ত-দর্শনার্থী বাসায় আসেন, সালমান শাহ’র জন্মের স্থান দেখতে। তাদের নিরাশ করেন না আলমগীর কুমকুম। দর্শনার্থীরা বাইরে ড্রয়িং রুমে সাজানো সালমান শাহ’র কিছু ছবি আর স্মৃতিচিহ্ন দেখে ফিরে যান। তারা জানতেও পারেন না ভেতরে আরও কত কি দেখার আছে। অবশ্য সেগুলো সালমান শাহ সংশ্লিষ্ট নয়। ভেতরে আলমগীর কুমকুমের নিজস্ব ভুবন। নিজের পছন্দের মানুষ ছাড়া যেখানে কারো ঢোকার তেমন সুযোগ নেই। নগরীর কোলাহলের মাঝখানে আলমগীর কুমকুমের ভেতরবাড়ি যেনো এক ছোট্ট চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা না বলে অভয়াশ্রম বলাটাই বোধহয় বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। বাড়ির ভেতরজুড়ে পশু-পাখির নির্ভীক পদচারণা। দুটো প্রশিক্ষিত কুকুর, চিল, কালিম, বকসহ কয়েক প্রজাতির পাখি, বানর আর সারা গায়ে কাঁটা নিয়ে আছে সজারুও। ছোট্ট জলাধারে মাছও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসী জীবন ছেড়ে এসব নিয়েই দিন কাটছে তার। স্ত্রী-সন্তানরা আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতি বছরই নিয়ম করে গিয়ে তাদের দেখে আসেন। বাকি সময় পশু-পাখিরাই তার সঙ্গী-সাথী। সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে পাখিদেরই খাওয়ান, এরপর নিজে খান।
আলমগীর কুমকুমের রক্তের মাঝেই যেনো মিশে আছে সংস্কৃতির প্রতি টান। অবসরে গান শুনেন। তবে তিনি সবার মতো গান শুনেন না। তিনি গান শুনেন গানের মাঝে ডুবে গিয়ে। সে জন্য তিনি আলোছায়াময় আলাদা এক পরিবেশ তৈরি করেন নিজের রুমে। সে আলোছায়ার আসরে নিয়মিত আসেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠিত মানুষজনেরা, যাদের অধিকাংশই আলমগীর কুমকুমের বন্ধু। আলমগীর কুমকুমের এমন বন্ধুভাগ্যও অনেকের হিংসার কারণ। তারাই নানা গল্প ছড়ান আলমগীর কুমকুমের নামে।
নির্বিরোধী মানুষ আলমগীর কুমকুম, তবে প্রতিবাদী। এ কারণেও কেউ কেউ তাকে পছন্দ করেন না। আলমগীর কুমকুম এসবের পরোয়াও করেন না, নিজের মতোই চলেন।
এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা ধরে রাখতে আলমগীর কুমকুম সব সময়ই সাহসী ভূমিকা রেখে চলেছেন। এলাকায় নিয়ম রয়েছে, পাড়ার ভেতরে কেউ রাত ১১টার পর গাড়িতে গান বাজাতে পারবে না। মোড়ের পাহারাদারদেরও তা জানা আছে। রাতে গাড়িতে করে পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ গান বাজালে নিষেধ করেন পাহারাদাররা। তবে একদল বেপরোয়া তরুণ সেদিন মানেনি এ নিষেধ। তারা নেমে আক্রমণ চালায় পাহারাদারদের ওপর। পাহারাদারদের একজন দৌড়ে আশ্রয় নেন আলমগীর কুমকুমের বাসায়। বেপরোয়া যুবকরাও ঢুকে পড়ে সে বাসায়। আগন্তুকদের ঠেকাতে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে শূন্যে গুলি ছুড়েন আলমগীর কুমকুম। পালিয়ে যায় আগন্তুকেরা। অবশ্য সরকার সমর্থক হওয়ায় নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে সেই তরুণরা উল্টো আলমগীর কুমকুমের বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ করে। পুলিশ আসে, আটক করে নিয়েও যায় আলমগীর কুমকুমকে। তিনদিন কারাগারে থাকতে হয় তাকে। একদফা কানাঘুষা, আলোচনার জন্ম দেয় বিষয়টি।
আলমগীর কুমকুম তার পোষা কুকুর টাইগারকে নিয়ে সশস্ত্র ছিনতাইকারীকে আটক করেও বেশ আলোচিত হন। ছোটখাটো এমন অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিয়ে তিনি তার এলাকায় কারো কাছে আতঙ্ক আবার কারো কাছে ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ছোটখাটো সমস্যায় কোথাও কোন প্রতিকার না পেলে এলাকার অনেকেই তার দ্বারস্থ হন। দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যা আলমগীর কুমকুম ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ মেথডে সমাধান করে দেন মুহূর্তেই।
আলমগীর কুমকুমকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় একটি মৃত্যু ঘটনায়। ১০ই আগস্ট তার বাসায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন নিয়মিত অতিথি সুবল বণিক। আলমগীর কুমকুম নিজেই তার এ বন্ধু ব্যবসায়ী সুবল বণিককে ক্লিনিকে ভর্তি করেন। সেখানেই মারা যান সুবল বণিক। সুবল বণিকের পরিবারে মৃত্যু নিয়ে কোন সন্দেহ না থাকলেও বিষয়টি পুলিশের কানে যায়। কানাঘুষা শুরু হলে পুলিশ ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেয়। যদিও পরিবার চাইছিলো লাশের যেনো কাটাছেঁড়া না হয়। পুলিশ সন্দেহ করলেও সুবল বণিকের পরিবারের কোন অভিযোগ ছিলো না আলমগীর কুমকুমের বিরুদ্ধে। বরং আলমগীর কুমকুমের কেনা কাপড়েই শেষকৃত্য হয় সুবল বণিকের। দুই বন্ধুর মাঝে কথা ছিলো তাদের মাঝে যে আগে মারা যাবেন তার শেষ পোশাকটি কিনে দেবেন বেঁচে থাকা বন্ধুটি।
আলমগীর কুমকুম না চাইলেও রহস্য যেনো বারবার তার সঙ্গী হতে ভালবাসে। এক শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ মসজিদে গেছেন। নামাজ শেষে ফেরার পথে জোরকণ্ঠে ‘মামা’ ডাকে পেছন ফেরেন তিনি। পুলিশের এক কর্মকর্তা ডাকছেন তাকে। থামতেই ঐ কর্মকর্তা বললেন, ‘আরে মামা! আপনি এভাবে একা বেরিয়েছেন কেনো?’ এমন প্রশ্নে খটকা লাগে আলমগীর কুমকুমের। ‘কেনো, কি হয়েছে?’-জানতে চান তিনি। পুলিশ কর্মকর্তা জবাব দেন, মামা আপনার ভয়াবহ বিপদ। জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে আপনার। আপনি তো আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের হিট লিস্টে। এভাবে একা বেরুনো ঠিক হয়নি। পুলিশের এমন সতর্ক বার্তায়ও খুব একটা ভয় পান না আলমগীর কুমকুম। জানেন কোন হিটলিস্টে ওঠার মতো কোন কিছুই করেননি তিনি।
তিনি ভয় না পেলেও পুলিশই উদ্যোগী হয়। তারা জানায় পত্রিকায় প্রকাশিত আনসারুল্লাহর ৮৪ জনের হিট লিস্টেও আলমগীর কুমকুমের নাম রয়েছে। তার নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে সিআইডির দু’জন সদস্যকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের নাম্বার দেয়া হয় আলমগীর কুমকুমের কাছে, প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য। আলমগীর কুমকুম একদিনও ফোন দেননি তাদের। তিনি মোটেও বিচলিত হননি। তিনি ব্যস্ত পাখিদের নিয়ে, পশুদের নিয়ে। মূল প্রতিবেদনঃ মানবজমিন