মাহমুদুর রহমানকে কারাদন্ড, খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর ও ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গ

Mahabubur Rahamanএম মাহাবুবুর রহমানঃ লন্ডন সময় সকাল পৌনে সাতটা। ঘুম থেকে উঠেই ফোন দিলাম এক সহকর্মীকে। জানালেন, ‘আশঙ্কাই সত্যি হলো। মাহমুদ ভাইকে (আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান) ওরা তিন বছরের কারাদন্ড দিয়েছে। অভিযোগ, সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা না দেয়া।’ পরে জানতে চাইলাম, বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে আসছেন কি-না। উত্তরে বললেন, ‘ওরা শেষ পর্যন্ত কি করে, কে জানে। সফরের প্রস্তুতির কথা শোনা যাচ্ছে। ভিসাও নিয়েছেন।’ পরে প্রশ্ন করলাম ‘ওরা’ কারা? সহকর্মীর জবাব, ‘সব সিদ্ধান্ত তো এক জায়গা থেকেই আসে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের বিশেষ সেল থেকে।’
সহকর্মীর এ কথায় প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ‘এক ব্যক্তি’। ‘ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক’ বলা যায় যাকে। বছর তিনেক আগে ওই ব্যক্তির দলের সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত বাবু ঘোষণা দিয়েই এ কথা বলেছেন। উক্তিটি ছিল এরকম ‘বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’।
অকুতোভয় সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সত্যিই ওই ব্যক্তির ফ্যাসিবাদের শিকার। তাঁর দেশবিরোধী ও ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি এখন কারাগারে। তাঁর স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করায় জীবন দিতে হলো হাজার হাজার নাগরিককে। অসংখ্য মানুষ গুম হলো।গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, প্রধান প্রতিপক্ষও (খালেদা জিয়া) না-কি এখন এই মহাক্ষমতাধরের নিয়ন্ত্রণে। তিনি কোথায় যাবেন, কখন যাবেন, কিভাবে যাবেন, কখন কতটুকু নি:শ্বাস নেবেন, এর নিয়ন্ত্রক না-কি ওই এক ব্যক্তি-ই। বছরের শুরুতে তিন মাস বালুর ট্রাক ও পুলিশ দিয়ে প্রকাশ্যেই সেটার উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্প্রতি না-কি অদৃশ্যভাবেই নিয়ন্ত্রণ চলছে। এক্ষেত্রে মামলা, নির্যাতন ও কারাগারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যাইহোক, বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের পরে এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়ার এখনই সময়। সময় ফুরিয়ে গেলে সবকিছুই আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাবে, তখন কিছুই করার থাকবে না।
প্রিয় পাঠক, আজকের লেখার শিরোনাম নিয়ে নিয়শ্চয়ই আপনাদের মনে প্রশ্ন আসছে- ‘সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কারাদন্ডের সাথে বেগম খালেদা জিয়া ও ১৫ আগস্টের সম্পর্ক কি?’
আপনারা বলতে পারেন, মাহমুদুর রহমান একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর অন্যায় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা বলে মানেন না। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে বাংলাদেশের মালিক বলে মানেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রের দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার বাকশালে প্রত্যাবর্তনকে রুখে দিতে চেয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর প্রহসনের নির্বাচনের সাড়ে পাঁচ বছর আগেই (২০০৮ সালে) তিনি এ ধরণের স্বৈরাচারি অবৈধ সরকারের আশঙ্কার কথা জাতিকে জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এর ফল হিসেবে মাহমুদুর রহমানকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায়ই কারাদন্ড নিশ্চিত করলেন তিনি। এমনকি এক্ষেত্রে দুদকের অনুসন্ধানী কর্মকর্তা জহিরুল হুদা সরকারের নির্দেশনা পুরোপুরি না মানলেও দন্ড ঠেকে থাকেনি। অনুসন্ধানী কর্মকর্তা আদালতে এসে সাক্ষ্য না দিয়েই নিজেকে অসুস্থ্য ঘোষণা করে চলে গিয়েছিলেন। হয়তো জহিরুল হুদা ভেবেছেন, এমন একজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াকু সৎ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য মুখে উচ্চারণ করতে পারবেন না। তাই আদালতে কিছু বলতে সম্মত হননি। এরপরও কেবল দুদকের বেআইনী নোটিশকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করার অপরাধে তিন বছরের কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা হলো সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের। প্রশ্ন আসতে পারে, এসবের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের সম্পর্ক কোথায়?
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমিও কোনো সম্পর্ক দেখি না। কিন্তু বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একজন দক্ষ শাসক। তিনি ফ্যাসিবাদকে নতুন আর্ট দিয়েছেন। দাবা বা ফুটবলের মাঠে যেভাবে খেলোয়াড়রা একটি ছক এঁকে খেলতে নামেন, শেখ হাসিনাও ৬২ মাসের শাসনে ছক এঁকেই সবকিছু করছেন। ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আত্মগোপনে পাঠানোর কৌশল আগে থেকেই যেন তার ঠিক করা ছিল। আবার হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরেও মির্জা ফখরুল যেন প্রকাশ্যে না আসেন, সেই স্টুপিডিয়াস সিদ্ধান্তটি যেন বঙ্গবন্ধু কন্যার-ই ঠিক করে দেয়া। একইভাবে মির্জা ফখরুলের আদালতে পৌঁছানোর কৌশল হিসেবে মিডিয়াকে দিয়ে অপপ্রচারের দায়িত্ব যেন আগেই বন্টন করে দেয়া ছিল। সেই একটি ঘটনা দিয়েই ইলিয়াস আলীর গুম হজম, বিএনপির মহাসচিব পদে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন সাদা মনের মানুষকে নিস্ক্রিয়করণ এবং বেশকিছু তাজা প্রাণকে কেড়ে নিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
এভাবে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির সেনা হত্যাকান্ড, বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে উচ্ছেদ, শাহবাগে মঞ্চ স্থাপন এবং সেটি নিয়ে মিডিয়ায় মহাপ্রচারণা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের আদলে একের পর এক ফাঁসি কার্যকর, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদকে গুম এবং ভারতে পাঁচার, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে কারাগারে হত্যা, আন্দোলন, উন্নয়ন ও অগ্রগতির সমন্বয়ের পথ রুখে দিতে পরিকল্পিতভাবে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি করানো সহ শ’শ ঘটনা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার গৌরবগাঁথা সাফল্য! থরে থরে সাজানো একটি ইস্যুর ওপর আরেকটি ইস্যু। ইস্যুতে ইস্যু চাপা দিয়ে শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাজনীতির মহাশক্তিধর ব্যক্তি।
ধরুন, ২০১৩ সালের কথা। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার এবং পত্রিকা বন্ধ করা হলো। আমরা প্রতিবাদে নামলাম। সারা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ৫ মে মতিঝিলে গণহত্যা চালালেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়কে সামনে নিয়ে এলেন। সব কিছু এক ঝলকে দেখলে মনে হবে – এ যেন একজন দক্ষ আর্টিস্টের কাজ। ভাল প্লানার, ভাল ডিজাইনার ও ভাল আর্টিস্ট দিয়েই সবকিছু রচিত!
মাহমুদুর রহমানকে তিন বছরের কারাদন্ড প্রদান, তারেক রহমানকে স্তব্ধ করে দেয়া এবং মামলার বেড়াজালে বেগম খালেদা জিয়াকে আটকে ফেলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেই আমার মনে হয়। সাবেক প্রধানন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামে দায়ের করা দুদকের মিথ্যা মামলাও যেভাবে দ্রুত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে, তাতে একইভাবে তাকেও সাজা দেয়ার চক্রান্ত বঙ্গবন্ধু কন্যার আছে। তিনি ক্ষমতায় থাকবেন-ই। এজন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গোল্লায় যাক। ধরুন, বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে এলেন। তার বিরুদ্ধে কোনো আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো। তখন জনগণের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কি পদক্ষেপ নেন, সেটি পরখ করে দেখতে চাইতে পারেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এটা সম্পূর্ণ অনুমান-নির্ভর কথা। যদিও কিছু মানুষ বলতে চাইছেন, ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করতে বেগম খালেদা জিয়ার ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের একটি চাপ আছে। হয়তো, সেই জন্যই তাকে ১৪ আগস্ট রাতে বিমানে তুলে দেয়া হবে লন্ডনের উদ্দেশ্যে! এই তথ্যটি আমি বিশ্বাস করি না। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন সফর স্থগিত করেছেন।
অবশ্য বেগম খালেদা জিয়া জন্মদিন পালন করবেন কি – করবেন না, এটা কারো নিয়ন্ত্রণে তিনি করবেন বলে মনে হয় না। আর যদি কোনো কুচক্রিমহল তাকে সেদিকে নিয়ে যেতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো- জনগণের নেত্রীকে আর আপস করাবেন না। আপনাদের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে ৭০ বছর বয়সী ‘গণতন্ত্রের আইকন’ এই নেত্রীকে। প্রতিবেশীর সাথে আপসের ঘোষণার পর যেমনি বিএনপিকে ‘নখদর্পহীন’ বিবেচনা করেছে সংশ্লিষ্টরা; তেমনি বাধ্য হয়ে যে কোনো আপস করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কন্যার ২০২১ সাল ও ২০৪১ সাল, এবার ৩০০১ সালে গিয়ে পৌঁছতে পারে!
যাইহোক, জন্মদিন পালন না করলে তেমন কিছু আসে যায় না। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট খালেদা খানম (পুতুল) জন্মগ্রহণ করেন। সেদিনটি তখন বাংলার মানুষের কাছে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সময়ের পরিক্রমায় খালেদা খানম (পুতুল) যখন বেগম খালেদা জিয়া হয়ে উঠেছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নেত্রী ও উন্নয়নের নেত্রী হয়ে উঠলেন, তখনই ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিনটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এরপরও জন্মদিন পালন না করলে কোনোই সমস্যা নেই।
পক্ষান্তরে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেভাবে স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি বঙ্গবন্ধু হত্যার শিকার হলেন, তাতে এ দিনটি সত্যিই বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই স্মরণীয়। কারো কাছে স্মরণীয় বাকশালের পতন ঘটায়, আবার কারো কাছে স্মরণীয় বঙ্গবন্ধুকে হারানোয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বেশী স্মরণীয় তিনি বাবা-মা, ভাই ও আত্মীয়দের হারিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে গত কয়েকবছর ধরে, এই দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত কষ্টের। এ দিনটিতে অনেক কিছু আমরা ভাবনায় আসে। মনে হয়, এমন একটি দিনকে স্মরণ করেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মানুষ হত্যায় দ্বিধা করছেন না। যেখানে বাবার পরিণতিকে শিক্ষা হিসেবে নেয়ার কথা, সেখানে তিনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন। মানুষ হত্যা করছেন প্রতিনিয়ত। বাবার মতোই গণমাধ্যম বন্ধ করছেন। সম্পাদককে কারান্তরীণ করছেন। ফ্যাসিবাদকে নুতন আর্ট দিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
প্রত্যাশা করি, এসবের অবসান হোক। ১৫ আগস্ট থেকে শেখ হাসিনা শিক্ষা নিন। আমরা আর ১৫ আগস্টের মতো কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা দেখতে চাই না! হত্যা দিবস নয়, অসংখ্য ভাল ও মহৎ মানুষের জন্ম দেখতে চাই। যেই মানুষেরা একটি সুন্দর ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। যেখানে গণমাধ্যম থাকবে মুক্ত। আইনের শাসন থাকবে। মাহমুদুর রহমানরা হবেন উন্নয়নের সহযাত্রী। পরামর্শ ও সমালোচনা চলবে একই গতিতে। রাজনৈতিক দলের ভেদাভেদ থাকবে, কিন্তু দেশের স্বার্থে সবাই আসবে একই প্লাটফর্মে। রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হবে না, রাজপথে হবে উন্নয়নের রোড শো।

লেখক : যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক ও গবেষক এবং
অ্যাডভাইজার, সিটিজেন অ্যাডভাইস ব্যুরো, যুক্তরাজ্য।